মহামারি সংক্রমণের দেড় বছর পার হয়েছে। ঋণের জালে জড়িয়ে এবং সঞ্চয় হারিয়ে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী দৈনন্দিন জীবন চালাতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছে। করোনাকালে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে আড়াই কোটি মানুষ। চলমান করোনা মহামারিতে দেশে মোট শ্রমশক্তির অনেক লোক কর্ম হারিয়েছেন। চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন অনেকে। অনেক প্রতিষ্ঠান করোনার ধাক্কা সামাল দিতে না পেরে এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। করোনা মহামারিকালে যেখানে সাধারণ মানুষের আয় কমে গেছে, সেখানে দেশে নতুন করে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে গেছে। দেশে বছরে পাঁচ হাজারের বেশি ব্যক্তি নতুন কোটিপতি হচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার (৯ ডিসেম্বর) মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে। দেশে দৃশ্যমান উন্নয়ন হলেও ধনী-গরিবের বৈষম্য বেড়েছে বলে মত প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
আজ (১০ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। এ বছর মানবাধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য ‘সমতা-অসমতা কমানো, মানবাধিকারের অগ্রযাত্রা’। এ উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার এমএসএফ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা বলেছে।
দেশের প্রবৃদ্ধি গুটিকয় মানুষ ভোগ করে উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে এমএসএফ বলেছে, ক্রমাগত বৈষম্য বৃদ্ধি ও অসমতা সামাজিক এবং মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়েরই বহিঃপ্রকাশ।
সংস্থাটি বলেছে, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদন-২০২১ অনুযায়ী, নারী-পুরুষের সমতার ক্ষেত্রে ১৫৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ৬৫তম। পরিবারের মধ্যে মানবাধিকার সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে এই বৈষম্য কমানো সম্ভব।
সংস্থাটি আরও বলেছে, পরিবার থেকে কেউ সমান অধিকারের শিক্ষা পেলে সেটি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানেরও ভূমিকা অনেক। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সর্বস্তরে মানবাধিকার সংস্কৃতির চর্চা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে অসমতা কমিয়ে আনা দরকার উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এ জন্য ব্যক্তি পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত প্রত্যেকের সুস্থ ও মর্যাদাপূর্ণভাবে বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক অধিকার পূরণ করতে হবে।
করোনা মহামারিকালে যেখানে সাধারণ মানুষের আয় কমে গেছে, সেখানে দেশে নতুন করে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২১ সালের জুন ভিত্তিক হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে জানায়, দেশে এখন কোটি টাকার ব্যাংক হিসাবের (অ্যাকাউন্ট) সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। যা ছয় মাস আগেও ছিল প্রায় ৯৪ হাজার।
সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৯১৮টি। দেশে মহামারি শুরুর আগে গত বছরের মার্চে কোটি টাকার আমানতের হিসাব ছিল ৮২ হাজার ৬২৫টি। অর্থাৎ মহামারিতে ১৭ হাজার ২৯৩টি কোটি টাকার হিসাব বেড়েছে।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। শুরু হয় লকডাউন-বিধিনিষেধ। বন্ধ হয়ে যায় বেশিরভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান। মহামারির কারণে গোটা বিশ্বের মতো দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেকে কাজ হারিয়েছেন আবার অনেকে কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতেও আমানতকারীর সঙ্গে কোটি টাকা জমার হিসাবের সংখ্যা বাড়ছে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল পাঁচ জন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৯৮টি। এর পর ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪ জন, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭টি এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি। ২০২০ সালে ডিসেম্বর শেষে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টিতে।
১২ বছরে দেশে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে।
দেশের প্রবৃদ্ধি গুটিকয় মানুষ ভোগ করে উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে এমএসএফ বলেছে, ক্রমাগত বৈষম্য বৃদ্ধি ও অসমতা সামাজিক এবং মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়েরই বহিঃপ্রকাশ।
২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। ভাইরাসের সংক্রমণের হার বাড়তে থাকলে তা রোধে সরকার ওই মাসের ২৬ তারিখ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এতে দেশ লকডাউনের মতো অবস্থায় চলে আসে। কৃষি খাতে শস্য উৎপাদন, সংগ্রহ ও বিপণন কার্যক্রম সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চালু থাকলেও অন্য প্রায় সব খাতের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। এতে চাকরিচ্যুতি, বেতন/মজুরি হ্রাস, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে অনেকের, বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের আয় কমে যাওয়ায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা এবং দারিদ্র্যহার বেড়ে যায়।
কোভিডের আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে এই নতুন দরিদ্র শ্রেণির সংখ্যা জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ হয়েছে। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত যা ছিল ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ।
২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশান রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) করা যৌথ গবেষণার তৃতীয় ধাপে পাওয়া গেছে এমন তথ্য।
৭ জুন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ভার্চুয়ালি মিডিয়া ব্রিফিং উপলক্ষ্যে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, দেশে দারিদ্র্যহার ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৭৭ লাখের উপরে।
আর ৮ জুন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, করোনা সংক্রমণ রোধে সরকার ঘোষিত ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটিতে ৫ কোটি ১০ লাখ নিম্নমধ্যবিত্তের মধ্যে ১ কোটি ১৯ লাখ দরিদ্র হয়েছে। গত বছর আগস্টে প্রকাশিত আইসিডিডিআর’বি এবং অস্ট্রেলিয়া ওয়াল্টার এলিজা হল ইনস্টিটিউটের যৌথ গবেষণায় বলা হয়, করোনা মহামারি ঠেকাতে সরকার ঘোষিত দুমাসের সাধারণ ছুটিতে ৯৬ শতাংশ পরিবারের গড় মাসিক উপার্জন হ্রাস পায়; ৯১ শতাংশ নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল মনে করে এবং ৪৭ শতাংশ পরিবারের আয় দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘বর্তমানে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে অনেকে লাভবান হয়েছেন, যা ব্যাংকে রাখছেন। আবার প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় নেয়া ঋণের একটা অংশও ব্যাংকে আমানত হিসেবে রাখা হতে পারে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকায় অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যে টাকা খাটাচ্ছে না। এই টাকাগুলোই ব্যাংকে আসছে আমানত হিসেবে।
তারা বলেন, মহামারির মধ্যেও প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক। একই সঙ্গে গত ১০ বছর ধরে বাংলাদেশের আয়বৈষম্য ব্যাপক হারে বেড়েছে। যখন আয় বাড়ে সঙ্গে সঙ্গে আয়বৈষম্য বাড়ে, তখন উচ্চআয়ের মানুষের অর্থের যোগান বেড়ে যায়
এখন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না। এক সময় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ২১ থেকে ২২ শতাংশ উঠেছিল। গত অর্থবছরে এটা ৮/৯ শতাংশে নেমে এসেছে। যখন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কম হয়, তখন উদ্বৃত্ত অর্থ থেকে যায়। ওই অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার সুযোগ থাকে কিন্তু সবাই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয়, কারণ এখানে ঝুঁকি থাকে। এছাড়া সঞ্চয়পত্রের বিভিন্ন শর্তের কারণে সবাই যেতে চায় না। তাই সহজে ব্যাংকে আমানত হিসাবে জমিয়ে থাকে। এসব কারণেই বড় আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ছে বলে তারা জানান।
আরও বলেন, ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি মানে টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে না, কর্মসংস্থানও হচ্ছে না। এর ফলে সমাজে বৈষম্য বাড়ছে।
দেশে আশঙ্কাজনকভাবে গরিবের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া নিয়ে তারা বলেন, কোভিডকালে সামাজিক সুরক্ষা নামমাত্র ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এটিকে এখন অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। শহরের দরিদ্র শ্রেণি এবং নতুন দরিদ্রদের জন্য বর্তমানে থাকা সুরক্ষা কর্মসূচির পাশাপাশি কার্যকর ও প্রযুক্তিভিত্তিক নতুন ও তাৎপর্যপূর্ণ আরো কর্মসূচি হাতে নেওয়া উচিত।
আরও বলেন, আমাদের পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের কর্মহীনতার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এমনিতেই দেশের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ কম। আর কোভিড-সৃষ্ট এই অবস্থা নারীদের শ্রমবাজার থেকে আরো ছিটকে ফেলছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৮
আপনার মতামত জানানঃ