
অং সান সু চি ও তার সরকারের সঙ্গে উত্তেজনা চলছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর, এর ফলে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারির সকালে মিয়ানমারে একটি সেনা অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। ২০২০ সালের ৮ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি ৮৩ শতাংশ আসনে জয়ী হয়। ২০১১ সালে সেনা শাসনের অবসানের পর এটি ছিল দ্বিতীয় দফা নির্বাচন। তবে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সংকটের শুরুটা মূলত এখান থেকেই।
সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত ও ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকে মিয়ানমারে অস্থিতিশীলতা জারি রয়েছে।এই ঘটনার পর দেশটিতে তীব্র গণ-আন্দোলন শুরু হয় এবং সামরিক ক্ষমতার জোরেই বার্মিজ সেনাবাহিনী তা দমনের চেষ্টা করে। এতে নিহত হচ্ছে শিশু নারীসহ অনেক বেসামরিক মানুষ।
সম্প্রতি মিয়ানমারের একটি গ্রামে ১১ জনকে গুলি করে ও পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে দেশটির সেনাদের বিরুদ্ধে।
সাগাইং নামে একটি গ্রামে বর্বর এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সেনা অভ্যুথানের পর সেনাবাহিনীর বিরোধিতা করে দেশটিতে গড়ে ওঠা মিলিশিয়াদের সাথে ওই গ্রামে এর আগে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, গুলি করে শরীরে আগুন দেওয়ার সময়ও কয়েকজন জীবিত ছিলেন।
গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর ওই এলাকায় জান্তা সরকারবিরোধী একটি মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। এই বাহিনীর সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর লড়াই চলছে।
এসব ঘটনার ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে মিয়ানমার নাউসহ বেশ কিছু গণমাধ্যম। তবে রয়টার্স এসব ভিডিওর সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি। এ বিষয়ে জানতে জান্তা সরকারের এক মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তিনি টেলিফোন ধরেননি। তবে ওই এলাকায় কাজ করেন এমন এক স্বেচ্ছাসেবী ত্রাণকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গতকাল মঙ্গলবার সেনারা দন তাও গ্রামে প্রবেশ করেন। এরপর বেলা ১১টার দিয়ে ওই হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। তিনি বলেন, সেনারা যাকে সামনে পেয়েছেন, তাকেই হত্যা করেছেন। তবে তিনি এটা নিশ্চিত করতে পারেননি, নিহত ব্যক্তিরা মিলিশিয়া সদস্য, নাকি জনসাধারণ।
দন তাও গ্রামে সেনাবাহিনীর হামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন সেখানকার মিলিশিয়া বাহিনী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের সদস্য খিয়াও উন্না। তিনি বলেন, সেনাসদস্যরা ওই গ্রামে ঢুকে গুলি চালিয়েছেন, এই খবর তিনি শুনেছেন।
স্থানীয় লোকজন জানায়, সেনাবাহিনীর বহর লক্ষ্য করে দুটি বোমা বিস্ফোরণের পরিপ্রেক্ষিতে আশপাশের গ্রামে অভিযান চালানো হয়। এর মধ্যে একটি বোমা পেতে রাখতে গিয়ে বিস্ফোরিত হলে ঘটনাস্থলেই গণতন্ত্রপন্থী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেসের দুই স্বেচ্ছাসেবীর মৃত্যু হয়। এরপর পেতে রাখা আরেকটি বোমা বিস্ফোরিত হলে পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেসের দুজনকে আটকের পর গুলি করে মারেন সেনা সদস্যরা। এরপর সংলগ্ন গ্রামগুলোতে অভিযান, সাঁড়াশি অভিযান ও ধরপাকড় চালায় সেনাবাহিনী। এ সময় ছয় পুরুষ ও পাঁচ কিশোরকে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে যায় তারা। ওই ১১ জনকে গুলি করে পরে মরদেহে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তাদের দগ্ধ দেহ পাওয়া যায় গত মঙ্গলবার।
এদিকে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, এই গ্রামে ১৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১ জনকে পোড়ানো হয়েছে। যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ছয়জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং পাঁচ কিশোর।
গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানে গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে অং সান সু চিকে বন্দি করে সেনাবাহিনী। বিভিন্ন অভিযোগে সু চির বিরুদ্ধে মামলা চলছে এবং এরই মধ্যে দুটি অভিযোগে তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এদিকে অভ্যুত্থানের পর থেকে চলমান সহিংসতায় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে কমপক্ষে এক হাজার ৩০৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১০ হাজার ৬০০ জনকে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভকারীদের পাশাপাশি রয়েছে আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
তবে জান্তা সরকারের নির্যাতনের শিকার সবচেয়ে বেশি নারী ও শিশুরা। গেল দশ মাসে অন্তত ৯৮ শিশু ও ৮৯ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। হত্যার এ ঘটনাকে পূর্ব পরিকল্পিত বলে অভিযোগ উঠেছে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে।
ক্ষমতাসীন জান্তা বিক্ষোভ দমনে প্রথমে লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ও জলকামানের ব্যবহার অনুমোদন করলেও এক পর্যায়ে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়। তারপর থেকেই দেশটিতে বাড়তে শুরু করে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যা।
গ্রামগুলোতে অভিযান, সাঁড়াশি অভিযান ও ধরপাকড় চালায় সেনাবাহিনী। এ সময় ছয় পুরুষ ও পাঁচ কিশোরকে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে যায় তারা। ওই ১১ জনকে গুলি করে পরে মরদেহে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তাদের দগ্ধ দেহ পাওয়া যায় গত মঙ্গলবার।
নিজ দেশের জনগণের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার করে দমনপীড়নের জন্য বিশ্বজুড়ে সমালোচিত হয়েছেন জান্তাপ্রধান হ্লাইং। পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের সেনাসদস্য ও সেনাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এরপরও কমেনি জান্তার দমনপীড়ন। পাল্টা-আক্রমণের পথ বেছে নিয়েছেন সেনাশাসনের বিরোধীরা। দেশটিতে প্রায় প্রতিদিনই দুই পক্ষের সংঘর্ষ চলছে। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমার দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
এদিকে দেশের উত্তরাঞ্চলে হাজার হাজার সৈন্যের সমাবেশ ঘটাচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক সরকার৷ এমন তথ্য উল্লেখ করে সেখানে বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে৷
২০১৬ ও ২০১৭ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংস হামলার আগে সেখানে যেভাবে সৈন্য জড়ো করা হয়েছিল একইভাবে এবার মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে সৈন্য জড়ো করা হচ্ছে৷ জাতিসংঘে জমা দেয়া এক প্রতিবেদনে মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত টম এন্ড্রুস এমন তথ্য জানিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন৷ সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে জমা দেয়া প্রতিবেদনে তিনি দেশটিতে আরো রক্তপাত, নিপীড়ন ও নির্যাতনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন৷
প্রতিবেদনে টম অ্যান্ড্রুস বলেন, ‘আরো নৃশংস অপরাধ সংগঠিত হওয়ার ব্যাপারে প্রস্তুত থাকা উচিত, যেমনটা মিয়ানমারের ওই অঞ্চলের মানুষও প্রস্তুত রয়েছেন৷ আমি খুব করে চাই যেন আমার আশঙ্কা ভুল হয়’৷
মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে অ্যান্ড্রুস বলেন, উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে লাখো সেনা ও ভারি অস্ত্র জড়ো করার তথ্য তিনি পেয়েছেন৷ যার প্রেক্ষিতে সেখানে জান্তা সরকারের সম্ভাব্য মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে৷
টম অ্যান্ড্রুস৷ বলেন, ‘এই তথ্যগুলো ২০১৬ ও ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের উপর চালানো গণহত্যার আক্রমণের পূর্বের সামরিক সমাবেশের ভীতিকর কৌশলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়’।
উল্লেখ্য নিরাপত্তা বাহিনীর দমনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালে রাখাইন থেকে অন্তত সাত লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন৷
প্রতিবেদনে তিনি সামরিক জান্তাকে অর্থ, অস্ত্র ও বৈধতা না দিতে সব দেশের প্রতি আহ্বান জানান৷ এই চাপ অব্যাহত রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০৫
আপনার মতামত জানানঃ