চীনে বর্তমানে অন্তত ১২৭ জন সাংবাদিক কারাগারে বন্দী আছেন। চীন বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ‘নিপীড়নের ভয়ঙ্কর কর্মসূচি’ চালাচ্ছে। যদিও চীন সাংবাদিক ও নাগরিক সাংবাদিকদের এই গ্রেপ্তারের স্বপক্ষে অজুহাত দেয় এই বলে যে, গ্রেপ্তারকৃতরা বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে উসকানি দিয়েছে। রিপোর্টার্স উইথআউট বর্ডার (আরএসএফ) নতুন এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাংবাদিক নিপীড়ক’। আর করোনা মহামারিকালে বিশ্বব্যাপী সংবাদপত্রের বিধিনিষেধ পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
করোনা নিয়ে প্রতিবেদন করায় উহানের অন্তত ১০ জন সাংবাদিক ও অনলাইন কমেন্টেটরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে একজন হলেন সাবেক আইনজীবী ঝ্যাং ঝান। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে করোনা প্রাদুর্ভাবের সময় উহানের জীবন নিয়ে স্থানীয় এক বাসিন্দার অনলাইন পোস্ট পড়ে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন।
কর্তৃপক্ষের হুমকি সত্ত্বেও সেখানে পৌঁছেই তিনি রাস্তাঘাট ও হাসপাতালে যা যা দেখেছেন তা লাইভ করতে ছিলেন এবং অনলাইনে সে সম্পর্কে লিখতে ছিলেন। তার করা ওই প্রতিবেদনগুলো সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে শেয়ার হয়েছিল। পরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় তিনি ‘ঝগড়া বাধানো ও সমস্যাকে উসকানি’ দিয়েছেন। তথ্য নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রচেষ্টাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হিসেবে দেশটিতে অ্যাক্টিভিস্ট ও তথ্য ফাঁসকারীদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তোলার ঘটনা নিয়মিতই ঘটে।
৪২ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে আরএসএফ এটাও দেখিয়েছে, চীনা কর্তৃপক্ষ কিভাবে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ স্লোগানকে ব্যবহার করে জিনজিয়াং নিয়ে প্রতিবেদন করা উইঘুর সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করেছে।
চীনের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ উইঘুর অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করা হয়। আর চীন বলে তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ইসলামি উগ্রপন্থীদের নির্মূল করে।
কোন কোন কৌশলে সাংবাদিকদের ওপর দেশটি নিপীড়ন চালায় তাও প্রতিবেদনে তালিকা করে দেখানো হয়েছে। যেমন—সাংবাদিকদের আক্রমণ করতে বিদেশে থাকা কূটনৈতিক মিশনকে ব্যবহার করা, সংবাদমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরা, বিভিন্ন বিষয়ের উপর নজরদারি আরোপ, জোরপূর্বক স্থানীয় সাংবাদিকদের কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শ পড়ানো, মুঠোফোনে প্রোপাগান্ডা অ্যাপ ডাউনলোড করানো এবং সাংবাদিকদের বহিষ্কার বা ভয় দেখানো।
আরএসএফ ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স-২০২১ এ চীনকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৭ নম্বরে রেখেছে। যা উত্তর কোরিয়া থেকে মাত্র দুই ধাপ উপরে।
চীনে বর্তমানে অন্তত ১২৭ জন সাংবাদিক কারাগারে বন্দী আছেন।
চলতি বছরের মার্চ মাসে প্রকাশিত আরএসএফের প্রতিবেদন মতে, ইন্টারনেটের ওপর অব্যাহতভাবে নজিরবিহীন সেন্সরশিপ, নজরদারি ও প্রপাগান্ডা চালিয়ে চীন সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। এমনকি লেখকদের জন্যও ‘বড় জেলারে’ পরিণত হয়েছে দেশটি।
এতে আরো বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৩ সালে চীনের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে অনলাইন সেন্সরশিপ, নজরদারি এবং প্রপাগান্ডাকে অনন্যমাত্রায় নিয়ে গেছেন। চীনের সাইবারস্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (সিএসি) সব কার্যক্রম জিনপিং স্বয়ং তত্ত্বাবধায়ন করেন। এই সংস্থা চীনের ৯৮৯ মিলিয়ন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর তথ্য নিয়ন্ত্রণ করে।
বিদেশি সাংবাদিকদের প্রতিবেদন তৈরিতে নানাভাবে বাধা দিয়েছে চীন। আর এ ক্ষেত্রে তারা করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে নেওয়া প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, ভয়ভীতি ও ভিসা–সংক্রান্ত প্রতিবন্ধকতাকে ব্যবহার করেছে। এসব কারণে দেশটিতে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় দ্রুত অবনতি’ ঘটছে। এমনটাই মনে করছে চীনে কর্মরত বিদেশি সাংবাদিকদের সংগঠন ফরেন করেসপনডেন্টস ক্লাব অব চায়না (এফসিসিসি)।
এফসিসিসি এক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে, টানা তিন বছরের মতো গত বছরও কোনো সাংবাদিক তাদের কর্মপরিবেশের উন্নতি হয়েছে বলে সংগঠনকে বলেননি। ১৫০ সাংবাদিকের ওপর পরিচালিত জরিপ ও ব্যুরোপ্রধানদের দেওয়া সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে এ প্রতিবেদন।
সংগঠনটির ভাষ্য, বিদেশি সাংবাদিক, তাদের চীনা সহকর্মী, এমনকি বিদেশি সাংবাদিকেরা যাদের সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছেন, তাদের হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখাতে রাষ্ট্রের সব শক্তিকে ব্যবহার করা হয়েছে। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য যে নজরদারি ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, এ ক্ষেত্রে তা-ও ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের স্পর্শকাতর এলাকাগুলোতে প্রবেশ করে প্রতিবেদন তৈরি করা থেকে সাংবাদিকদের বিরত রাখতে কর্তৃপক্ষ জনস্বাস্থ্যবিষয়ক উদ্বেগকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করায় এবং বাধ্যতামূলকভাবে কোয়ারেন্টিনে রাখার হুমকি দেওয়া হয়। খবর সংগ্রহে বাধা তৈরি করতে সাংবাদিকদের ভিসা–সংক্রান্ত বিধিনিষেধ দিয়ে চাপে রাখা হয়।
এফসিসিসি জানায়, অন্তত ১৩ সাংবাদিককে ৬ মাস বা তারও কম সময়ের জন্য পরিচয়পত্রের বৈধতা দেওয়া হয়। চীনভিত্তিক বিদেশি সাংবাদিকদের সাধারণত এক বছরের ভিসা দেওয়া হয় এবং প্রতিবছর তা নবায়ন করা হয়। অথচ দেশটি চীনের কূটনৈতিক বিরোধের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের ‘দাবার ঘুঁটি’ হিসেবে ব্যবহার করে।
গত বছর চীন বিভিন্ন মার্কিন গণমাধ্যমে কাজ করা এক ডজনের বেশি বিদেশি সাংবাদিককে বহিষ্কার করে। ওয়াশিংটন এর আগে দেশটিতে থাকা চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বড় চারটি গণমাধ্যমের সাংবাদিকের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয়।
এরই জবাবে চীন ওই পদক্ষেপ নেয়। এ ছাড়া একই বছরের সেপ্টেম্বরে অস্ট্রেলিয়া চীন থেকে তাদের দুজন সাংবাদিককে বের হয়ে আসতে সহায়তা করে। তাদের চীনের নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রণালয় জেরা করছিল।
গত বছর চীনা কর্তৃপক্ষ চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে কাজ করা অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক চেং লেইকে আটক করে। এরপর হাজে ফ্যান নামের চীনের নাগরিক যিনি ব্লুমবার্গের জন্য কাজ করতেন, তাকে আটক করে। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিপদজনক এমন আশঙ্কায় দুজনকে আটক করা হয়। তারা এখনো বন্দী আছেন।
বিদেশি সাংবাদিকদের গতিবিধি চিহ্নিত করে তাদের কার্যক্রম রুখতে জাতীয় নিরাপত্তা তদন্ত এবং নজরদারি ব্যবস্থা ব্যবহার করেছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি)। এ ছাড়া তাদের ভয়ভীতি দেখানো এবং মারধরেরও অভিযোগ রয়েছে।
চীনের মানবাধিকার অ্যাক্টিভিস্ট জিয়ানলি ইয়াং এ ব্যাপারে ম্যাগাজিন ন্যাশনাল রিভিউ-তে একটি প্রতিবেদন লেখেন। তিনি বলেন, চীনে বিদেশি সাংবাদিকরা প্রতিবেদন তৈরি করতে গেলে তাদের নজরদারিতে রাখার ইতিহাস দীর্ঘ সময়ের। এমনকি গত বছর করোনাভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে যাওয়ার মধ্যেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
জিয়ানলি ইয়াং লিখেছেন, চীনে বিদেশি সাংবাদিকদের রিপোর্টিংয়ের বিষয়টি নজরদারিতে রাখার ব্যাপারে সিসিপির দীর্ঘ সময়ের ইতিহাস রয়েছে। এমনকি ২০২০ সালে করোনাভাইরাস ছড়ানোর বছর এবং করোনা মহামারি আকারে দেখা দেওয়ার বছরেও কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। করোনাভাইরাস বিস্তার পর্যবেক্ষণ ও নজরদারিতে রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় নজরদারি ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়। বিদেশি সাংবাদিকদের যারা এ ব্যাপারে প্রতিবেদন প্রকাশের সঙ্গে জড়িত, তাদেরকেও ওই নজরদারি ব্যবস্থায় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল।
২০২০ সালে চীন দেশটি থেকে বিভিন্ন মার্কিন গণমাধ্যমে কাজ করা এক ডজনের বেশি বিদেশি সাংবাদিককে বহিষ্কার করে। এ ছাড়া একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে অস্ট্রেলিয়া চীন থেকে তার দুজন বিদেশি সাংবাদিককে বের হয়ে আসতে সহায়তা করে। তাঁদের দুজনকে চীনের নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রণালয় জেরা করছিল।
বিশেষ করে চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং থেকে প্রতিবেদন করা সাংবাদিকেরা কর্তৃপক্ষের প্রচণ্ড হয়রানির শিকার হন বলেও অভিযোগ করে এফসিসিসি।
জিনজিয়াংয়ে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠীর বসবাস। সেখানে তাদের ওপর চীনের ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৬
আপনার মতামত জানানঃ