চতুর্থ ধাপের ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ভোটের তারিখ পিছিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামী ২৩ ডিসেম্বর এ ধাপের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠান তারিখ নির্ধারিত থাকলেও তা পিছিয়ে অনুষ্ঠিত হবে ২৬ ডিসেম্বর। ইতিমধ্যেই কেন্দ্র দখল, ব্যালটে সিলমারা, ককটেল বিস্ফোরণ, দফায় দফায় সংঘর্ষ, টেঁটাযুদ্ধ, গুলি ও মারামারির মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সচেতন নাগরিক সমাজ। তবে সব সমালোচনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার আর স্বেচ্ছাচারিতার নতুন নজির গড়তেই মন আর মনোযোগ আ’লীগ নেতাদের।
কেন্দ্র দখলের হুমকি আ’লীগ নেতার
আওয়ামী লীগের টিকিট নিয়ে আপনাদের কাছে এসেছি, আপনাদের কাছে ভোট দাবি করছি, আপনারা আগামী ২৬ তারিখে আমাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবেন। কোন কেন্দ্র উনি নিজের হাতে নিয়ে যাবে, এগুলো খামাখা (ভুয়া) কথা। ‘কেন্দ্র দখল করলে আমরা করব, জোর করে ভোট নিলে আমরা নেব, কারণ আমরা সরকারের প্রতিনিধি, ইনশাআল্লাহ।’
গতকাল রোববার রাতে এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। যা মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়।
সূত্র মতে, শনিবার সন্ধ্যায় নির্বাচনী কার্যালয় উদ্বোধনকালে নোয়াখালীর সদর উপজেলার দাদপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাওয়া নৌকা প্রতীকের প্রার্থী দেলোয়ার হোসেন দেলু তার বক্তব্যে এসব কথা বলেন। তিনি সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি।
এ বিষয়ে দাদপুর ইউনিয়নের নৌকার প্রার্থী দেলোয়ার হোসেন দেলু এমন বক্তব্য দিয়েছেন স্বীকার করে বলেন, ‘আমি অন্য সূত্র ধরে এ কথা বলেছি। ফেসবুকে ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়েছে বলে আমি জানতে পেরেছি। এটি আমার ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) প্রার্থী মিজানুর রহমান শিপনের কাজ। এ ঘটনায় সোমবার তিনি থানায় অভিযোগ করবেন বলে জানান।’
দেলু আরও বলেন, ‘আমি কথাগুলো ওইভাবে বলিনি। আমি বলেছিলাম আমার প্রতিপক্ষ স্বতন্ত্র প্রার্থী মিজানুর রহমান শিপন বলেছিল ভোট গ্রহণের দিন ১২টার পর কেন্দ্র দখল করে নিবে। ওই কথার ভিত্তিতে আমি বলেছিলাম ‘আমরা সরকার প্রতিনিধি, কেন্দ্র কাটলে আমরা কাটব, দখল করলে আমরা করব, আপনারা নির্ভয়ে কেন্দ্রে ভোট দিতে আসবেন, আপনাদের নিরাপত্তা আমরা দেব। কিন্তু আমার ওই বক্তব্যকে কেটে খণ্ডিত করে মিজানুর রহমান শিপন তাঁর লোকজন দিয়ে প্রচার করছে। এ বিষয়ে আমি থানায় অভিযোগ দেব।’
আ’লীগ প্রার্থীর অভিযোগের বিষয়ে বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) প্রার্থী মিজানুর রহমান শিপন বলেন, ‘তিনি নিজ মুখে কেন্দ্র দখলের কথা বলেছেন, যার ভিডিও ইতিমধ্যে সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি কেন ওনার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করব। এছাড়াও চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় তিনি অনেক অনিয়ম করেছেন। এখন আবার ভোটের দিন কেন্দ্র দখল করাসহ আমার লোকজনকে বিভিন্নভাবে হুমকি ধামকি দিচ্ছেন। আমি এসব বিষয়ে থানায় জিডি করে রেখেছি।’
নৌকা পেয়ে বোমা ফাটিয়ে উদযাপন
রাজবাড়ীর পাংশায় নৌকার মনোনয়ন পাওয়ার আনন্দে বোমা ফাটিয়ে উদযাপন করার অভিযোগে ইউপি চেয়ারম্যানের ছেলেসহ দুজনকে আটক করেছে পুলিশ। গতকাল শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে ইউনিয়নের বাগদুলি বাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের সামনে ব্রিজের ওপর থেকে তিনটি হাতবোমাসহ তাদের আটক করা হয়। আজ রোববার তাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, মৌরাট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও আসন্ন ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মো. হাবিবুর রহমান প্রামাণিকের ছেলে শামীম প্রামাণিক (৩৬) ও চরহরিনাডাঙ্গা গ্রামের ইসলাম মণ্ডলের ছেলে মো. জালাল মণ্ডল (৩০)।
পাংশা মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘নৌকার মনোনয়ন পাওয়ার সংবাদ পেয়ে প্রায় ২৫-৩০টি মোটরসাইকেল নিয়ে সাবেক চেয়ারম্যান মো. শওকত আলী সরদারের বাড়ির পাশে ব্রিজের ওপর বোমা ফাটিয়ে আনন্দ উল্লাস করছিলেন তারা। এ সময় তিনটি হাতবোমাসহ দুজনকে আটক করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইনে মামলা করা হয়েছে।’
পাংশা মডেল থানার তদন্ত কর্মকর্তা উত্তম কুমার ঘোষ বলেন, ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বোমা ফাটানোর বিষয়টি জানতে পারি। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনটি বোমাসহ তাদের গ্রেপ্তার করেছে। সেখানে একটি বিস্ফোরিত বোমার আলামত পাওয়া গেছে।’
এ ছাড়া একই দিন পুলিশের পৃথক অভিযানে নিয়মিত মামলার আরও চার আসামিকে আটক করেছে পুলিশ।
কারাগারে জেনেও খুনের আসামিকে মনোনয়ন
ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে মারা ঘটনায় দুদিন আগে সাভারের আমিনবাজার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) বর্তমান চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। সেই চেয়ারম্যানকে আসন্ন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দিয়ে গতকাল শনিবার রাতে তালিকা প্রকাশ করে আওয়ামী লীগ।
অবশ্য এর ঘণ্টাখানেক পরেই তা সংশোধন করে রাকিব আহম্মেদ নামের একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। প্রথম বিজ্ঞপ্তিতে মনোনীত প্রার্থীর পরিবর্তে ভুল নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত আরেক বিজ্ঞপ্তিতে সংশোধনী দেওয়া হয়।
বর্তমান চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন ২০১১ সালে আমিনবাজারের কেবলারচরে ডাকাত আখ্যা দিয়ে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা মামলার অন্যতম আসামি। গত ২ ডিসেম্বর আলোচিত এই হত্যা মামলার রায়ে আনোয়ার হোসেনসহ ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসিনা দৌলা বলেন, ‘উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আনোয়ার হোসেনসহ কেন্দ্রে বেশ কয়েকজনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। সেই প্রস্তাব থেকে আনোয়ার হোসেনকে প্রথমে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। তখন তাকে আদালত থেকে দণ্ডিত করা হয়নি। তবে তিনি জেল হাজতে ছিলেন। বিষয়টি জানার পর মনোনয়ন বোর্ড সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে অন্য জনকে মনোনীত করেছে।’
মৃতব্যক্তি পেল মনোনয়ন
ঋণখেলাপীর দায় এড়াতে নিজেকে মৃত দেখিয়েছেন নৌকার প্রার্থী। প্রতীক বরাদ্দের আগেই এলাকায় নৌকায় ভোট কামনা করে চালাচ্ছেন প্রচারণাও।
জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার গুনারীতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গুনারীতলা ইউনিয়নের নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান আদালতে নিজেকে মৃত দেখানোর তথ্য গোপন করায় আবু শোয়েব নামে এক ভোটার জেলা নির্বাচন অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী ও মোসলেমাবাদ গ্রামের মৃত আফছার আলীর ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান মেসার্স ফাতেমা আফসার এগ্রো কমপ্লেক্স লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক্যুইটি অ্যান্ড অন্ট্র্যাপ্র্যানারশীপ ফান্ড (ইইএফ) ইউনিট-ইইএফ (ব্যবস্থাপনায় ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ) এর সহায়তায় ২০১২ সালের ২৯ এপ্রিল ৩০ লাখ, একই বছরের ১৬ অক্টোবর ৫১ লাখ ও ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ২১ লাখ ২১ হাজারসহ সর্বমোট ১ কোটি ২ লাখ ২১ হাজার টাকা ঋণ নেন। কিন্তু তিনি নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধ না করায় খেলাপী হন।
ঋণ খেলাপী ও ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় মোস্তাফিজুরসহ ৫ জনের নামে ঢাকার পঞ্চম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা হয়। পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে সমন জারি হয়।
কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তি মামলা ও ঋণ থেকে মুক্তি পেতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তায় তিনি মারা গেছেন মর্মে আদালতে মৃত্যুসনদ দেন। ২০২০ সালের ৩ মার্চ আদালতকে অবহিত করা হয় মোস্তাফিজুর রহমান ও তার বাবা আফছার আলী মিয়া মারা গেছেন। আফছার আলীর মৃত্যুর খবর সঠিক থাকলেও তার ছেলে মোস্তাফিজুরের মৃত্যুর খবরটি ছিল মিথ্যা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬২০
আপনার মতামত জানানঃ