পার্বত্য শান্তিচুক্তির দুই যুগ পূর্ণ হয়েছে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই যুগের অশান্ত পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে এক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়। পার্বত্য চুক্তির সময় ওই ভূখণ্ডে যে সব শিশুর জন্ম হয়েছে তারা এখন তরুণ-তরুণী। সে সময় যারা শান্তি বাহিনীর সদস্য হিসেবে অস্ত্র সমর্পণ করেছিলেন, তারা এখন প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশ ভূখণ্ডেই তাদের বসবাস। তবে বদলায়নি অনেককিছুই। আছে নিরাপত্তাহীনতা, আশ্রয়ের অভাব। অভাব আছে বৈধতারও। তাই ‘শান্তি চুক্তি’ নামে বহুল পরিচিত হলেও ২৪ বছর পরও পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত হয়ে আছে।
যে কারণে পার্বত্য চুক্তি
ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার একতরফাভাবে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক অবস্থাকে নড়বড়ে করে দেয়। এমনকি শাসনতন্ত্র থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় এলাকার মর্যাদা বাতিল করে দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। এই ক্ষোভ ও বঞ্চনা থেকে জন্ম শান্তিবাহিনীর।
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের প্রাক্কালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে পাহাড়ি জনগণের একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন এবং সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পরিচিতির স্বীকৃতি সম্পর্কিত কতিপয় দাবি পেশ করেন।
পাহাড়ি জনগণের দাবি মেনে নিতে সরকারের ব্যর্থতার ফলে তাদের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে এর সঙ্গে যোগ হয় শান্তি বাহিনী নামে একটি সামরিক শাখা।
১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ড জনসংহতি সমিতির ইতিহাসে এক সঙ্কটময় অবস্থার সূচনা করে। লারমা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যান। তবে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে শান্তি বাহিনী সামরিক দিক থেকে অধিকতর সংগঠিত হয়। এর সদস্য সংখ্যা দিনে দিনে বাড়তে থাকে। এরূপ অভিযোগ রয়েছে যে, শান্তি বাহিনী ভারতের ত্রিপুরায় ঘাটি স্থাপন করে সেখান থেকে অভিযান পরিচালনা করে।
১৯৭৭ সালে তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি সাঁজোয়া বহরের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ হামলার পর সেনাবাহিনী ঐ অঞ্চলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে ২৪তম ডিভিশনের জিওসির অধীনে আনা হয়। এরপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পাল্টা আক্রমণ শুরু করে।
সামরিক পদক্ষেপের পাশাপাশি সরকার পাহাড়ি জনগণকে শান্ত করার লক্ষ্যে সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা হয়। অবশ্য সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে পাহাড়ি জনগণ গভীর অবিশ্বাস ও সংশয়ের দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। কাপ্তাই হ্রদের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ যে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয় তা তাদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি করে। এই হ্রদের জন্য তাদের মূল ভূখন্ডের ৪০ ভাগ ভূমি হারাতে হয়। ফলে প্রায় ১ লাখ লোক গৃহহারা হয়ে পড়ে।
কেউ কেউ মনে করেন যে, এদের অনেকে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। সরকার পাহাড়িদের হারানো ভূমির জন্য পুরোপুরি ক্ষতিপূরণ দিতে পারেনি। এ আশঙ্কা ও ভুল বুঝাবুঝি থেকে তাদের মধ্যে জন্ম নেয় ক্ষোভ ও হতাশা। এরপর সরকার ১৯৭৯ সালে ঐ অঞ্চলে বাঙালি বসতি স্থাপনের এক কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই কর্মসূচি ছিল পার্বত্য জনগণের প্রথাগত জুমিয়া অধিকারের পরিপন্থী।
সরকার এতকালের গোষ্ঠী মালিকানাধীন জমিকে খাস জমি বা সরকারি মালিকানাধীন জমি ঘোষণা করে এসব জমিতে বাঙালি বসতি স্থাপন শুরু করলে বহু পাহাড়ি পরিবার উচ্ছেদ হয়। উচ্ছেদকৃত পাহাড়িদের অনেকেই সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। ১৯৯১ সাল নাগাদ পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালির সংখ্যা দাঁড়ায় মোট জনসংখ্যার ৪৮.৫%; অথচ বসতি স্থাপন কর্মসূচির আগে ১৯৭৪ সালে সেখানে বাঙালির সংখ্যা ছিল প্রায় ১১.৬%।
এভাবেই দীর্ঘ দুই যুগ ধরে চলে সংঘাত, উত্থান-পতন। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ তথা ক্ষমতাকাঠামোতে পাহাড়িদের অংশীদারত্ব নিশ্চিত করার আকাঙ্ক্ষায় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি।
প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
চুক্তির আগে সাধারণ মানুষের অনেক প্রত্যাশা ছিল। প্রথমত, পাহাড়ে সংঘাত বন্ধ হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে, ভারত থেকে শরণার্থীরা স্বদেশে ফিরে আসবে, তাদের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুরা ফেলে যাওয়া পৈতৃক ভিটা, জায়গাজমি ফিরে পাবে, হাটে–বাজারে নির্ভয়ে চলাফেরা করা যাবে, লেখাপড়া শিখে চাকরি পেতে সহজ হবে।
দ্বিতীয়ত, নিরাপত্তা বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পগুলো ফিরে যাবে। তৃতীয়ত, শান্তিবাহিনী বিলুপ্ত হবে এবং শান্তিবাহিনী সন্দেহে আর কোনো নিরীহ পাহাড়ি হেনস্তার শিকার হবে না, উৎপাদিত ফসল বাজারে বেচাবিক্রি বাড়বে এবং বেশি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য ক্যাম্প থেকে আর অনুমতি নিতে হবে না বা অহেতুক জবাবদিহি করতে হবে না এবং আরও অনেক কিছু।
মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একটি বড় রাজনৈতিক অর্জন। সেনাবাহিনী ব্যাপারটিকে সদর্থকভাবে গ্রহণ করে। ফলে জনসংহতি সমিতির অস্ত্র জমা দান প্রক্রিয়া সহজ হয়েছে। ভারতে মানবেতর জীবনযাপন করতে থাকা পাহাড়ি শরণার্থীরা স্বদেশে ফিরে আসতে পেরেছে। শান্তিবাহিনীর অনেক সদস্য যোগ্যতা অনুসারে পুলিশ বাহিনীসহ বিভিন্ন চাকরিতে নিযুক্ত হয়েছে। এসব নিশ্চয়ই চুক্তির প্রত্যক্ষ ফল। কিন্তু অপ্রাপ্তি যে নেই, তা নয়।
পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোতে এখনো নির্বাচন না হওয়ায় সেগুলো প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক হয়ে ওঠেনি। স্থানীয় পুলিশ নিয়োগের ক্ষেত্রে জেলা পরিষদের ক্ষমতার বিষয়টিও ঝুলে আছে। ভূমি সমস্যার সুরাহা হয়নি। উপজাতি-আদিবাসী-ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিচিতি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
কোনো কোনো সময় পাহাড়িদের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে, যেমন লংগদু ঘটনা। চুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও উচ্চতর সরকারি চাকরিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ নিয়ে জেএসএস ও সরকারের মধ্যে মতের অমিল দেখা গেছে। এ রকম বেশ কিছু গরমিল আছে।
চুক্তির দুর্বলতা
চুক্তির মধ্যে কিছু দুর্বলতা আছে। ভাষা ও কাঠামোগত দুর্বলতা যেমন আছে, তেমনি নীতিগত দুর্বলতাও আছে। প্রধান দুর্বলতা এ চুক্তির কোনো সাংবিধানিক নিশ্চয়তা নেই। এর যে ছোট্ট প্রস্তাবনা আছে, সেখানে চুক্তি স্বাক্ষরের প্রয়োজন কেন হলো, সেই পটভূমি উল্লেখ করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষমতাকাঠামোতে পাহাড়িদের অংশীদারত্ব নিশ্চিত করতে যে চুক্তি স্বাক্ষরের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, চুক্তিতে সে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
আছে কার্যক্রমেও দুর্বলতা। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন ঝুলে আছে স্থায়ী বাসিন্দার ভিত্তিতে ভোটার তালিকা না হওয়ায়। নির্বাচন কমিশন এ তালিকা তৈরির ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিয়েছে এমন শোনা যায়নি। চুক্তি অনুযায়ী ‘অ-উপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দা’ নির্ণয় করা জমি-জমার বৈধতার ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে জমি-জমার বৈধতা বা অবৈধতার বিষয়টি নিষ্পত্তি করার দায়িত্ব ভূমি কমিশনের। এ কাজটি যেহেতু হয়নি, স্থায়ী ভোটার তালিকা প্রণয়নও হয়নি।
১৯৯৯ সালে প্রথম ভূমি কমিশন গঠিত হয়েছিল অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আনোয়ারুল হককে চেয়ারম্যান করে। কার্যভার গ্রহণের আগেই তার মৃত্যু হয়। এরপর আরও চারজন চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন। কিন্তু ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ এগোয়নি। ২০১৬ সালে আইন সংশোধন করা হয়েছে, গেজেট হয়েছে। কিন্তু তার আলোকে বিধিমালা জারি হয়নি, জনবল নিয়োগ হয়নি। ফলে বিরোধ নিষ্পত্তির আবেদন গ্রহণ করেও সালিসি কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। বর্তমান ভূমি কমিশনকে সভা করতে গিয়ে অবরোধের সম্মুখীনও হতে দেখা গেছে।
শরণার্থীরা বেদখলে থাকা জমিতে ফিরতে পারেনি বা ফেরত পায়নি। ভূমি সমস্যার সঙ্গে শরণার্থী পুনর্বাসন ব্যাপারটির নিবিড় সম্পর্ক আছে। ভূমি সমস্যার নিষ্পত্তি না হলে শরণার্থীদের পুনর্বাসনও পূর্ণতা পাবে না।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ