প্লাস্টিক পুরো বিশ্বেই বহুল ব্যবহৃত একটি সামগ্রী। প্লাস্টিকের গামলা, বালতি, চায়ের কাপ, স্ট্র, পানির বোতল, কোমল পানীয়ের পাত্র ইত্যাদি রান্নাঘরের কোণ থেকে শুরু করে ঘর-গৃহস্থালির সব জায়গাতেই ব্যবহার হয়। এমনকি জুস কিংবা চা সরবরাহের জন্য হোটেলগুলোতে প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার হয়ে থাকে।
অনেকেই বাসাবাড়িতে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য রাখার ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের পণ্য ব্যবহার করে থাকেন। অপেক্ষাকৃত সস্তা ও সহজলভ্য হওয়ায় প্রতিদিন আমরা নানাভাবে প্লাস্টিকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছি।
বিশেষ করে ওয়ান-টাইম ইউজ প্লাস্টিক (বোতল, কাপ, প্লেট, বক্স, চামচ, স্ট্র) দ্রব্যের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। মাছ-মাংস, শাক-সবজি, ডাল, চিনি, রসগোল্লা ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য শোভা পাচ্ছে প্লাস্টিকের মোড়কে।
আকার ও ওজনে সুবিধাজনক হলেও প্লাস্টিকের বোতল স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তা সত্ত্বেও প্লাস্টিকের বোতলে শুধু পানি, তেল, সস, বা জুস নয়, ওষুধ পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হয় যে, এটা প্লাস্টিকের যুগ।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিকের বর্জ্য উৎপাদিত হয় যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটির একজন নাগরিক গড়ে বছরে ১৩০ কিলোগ্রাম প্লাস্টিক নানাভাবে ব্যবহার করেন। মার্কিনদের পরে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিকের বর্জ্য উৎপাদনে দায়ী ব্রিটিশরা। ব্রিটেনের একজন নাগরিক গড়ে বছরে ৯৯ কিলোগ্রাম প্লাস্টিকের বর্জ্য উৎপাদন করেন।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারকে কংগ্রেসের দেওয়া এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
‘রিকনিং উইথ দ্য ইউএস রোল ইন গ্লোবাল ওশান প্লাস্টিক ওয়েস্ট’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে এ ব্যাপারে জাতীয় কৌশল প্রণয়নের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবিলার আহ্বান জানানো হয়েছে। ২০২০ সালে কার্যকর হওয়া ‘সেভ আওয়ার সিস ২.০ অ্যাক্ট’ অনুসারে বছরে এ ধরনের প্রতিবেদন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে কংগ্রেসের।
প্রাথমিকভাবে সাগর-মহাসাগরের বর্জ্যের জন্য জাহাজসহ সাগরভিত্তিক অন্যান্য উৎসকে দায়ী করা হতো। তবে স্থলভাগের বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের বর্জ্য নদীপথে সাগরে যায়। এতে সাগর দূষিত হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি মাছসহ হাজার হাজার জলজ প্রাণীর শরীরে প্লাস্টিক ঢুকছে। মানুষের খাদ্যতালিকায় রয়েছে সামুদ্রিক মাছ।
গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৪ কোটি ২০ লাখ মেট্রিক টন প্লাস্টিকের বর্জ্য উৎপাদিত হয়, যা চীনের প্রায় দ্বিগুণ এবং সম্মিলিতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোর চেয়েও বেশি। মার্কিনদের পরে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিকের বর্জ্য উৎপাদনে দায়ী ব্রিটিশরা। ব্রিটেনের একজন নাগরিক গড়ে বছরে ৯৯ কিলোগ্রাম প্লাস্টিকের বর্জ্য উৎপাদন করেন। দক্ষিণ কোরিয়ার একজন নাগরিক উৎপাদন করেন বছরে গড়ে ৮৮ কিলোগ্রাম।
কংগ্রেসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৬৬ সালে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকের বর্জ্য উৎপাদিত হয় ২ কোটি মেট্রিক টন, ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টনে। অর্থাৎ এই সময়ে প্লাস্টিকের বর্জ্য বেড়েছে ২০ গুণ।
প্লাস্টিক মাটি ও পানিতে ফেললে পচে না, গলেও না। প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার শেষে মাটি কিংবা পানিতে ফেলে দেয়ার পর তা থেকে যায় অনন্তকাল। প্লাস্টিকদ্রব্য এবং এর উপজাত, কণিকা বা নিঃসরিত অণুর সংযোজন জল ও স্থলে মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান ছড়ায়। এর ফলে মানুষসহ পুরো জীবজগত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ, মাটি ও পানিতে খাদ্যচক্রের প্রক্রিয়ায় প্লাস্টিক নিঃসৃত ভয়াবহ ক্ষতিকর পদার্থও মিশে যায়, যা খেয়ে মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণী এমনকি উদ্ভিদও নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
দেশটির একজন নাগরিক গড়ে বছরে ১৩০ কিলোগ্রাম প্লাস্টিক নানাভাবে ব্যবহার করেন। মার্কিনদের পরে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিকের বর্জ্য উৎপাদনে দায়ী ব্রিটিশরা। ব্রিটেনের একজন নাগরিক গড়ে বছরে ৯৯ কিলোগ্রাম প্লাস্টিকের বর্জ্য উৎপাদন করেন।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, এর বিরূপ প্রভাবে মানবদেহে ক্যান্সার, এ্যাজমা, অটিজম, হরমোনজনিত সমস্যাসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি হয়। পরিবেশবিদদের মতে, প্লাস্টিক দূষণ ইকোসিস্টেমের (বাস্তুতন্ত্র) জন্য অশনি সঙ্কেত হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। হুমকির মুখে পড়ছে মানুষসহ সমগ্র জীবজগত। তাই প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক না হলে রয়েছে মহা বিপদের শঙ্কা।
জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৮ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। বিশ্বে প্রতি বছর ৩৮১ কোটি টন প্লাস্টিক উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ৪৫ কোটি টনের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে যোগ হয়। এ বর্জ্যের ৫১ শতাংশ এশিয়া মহাদেশে।
অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্যরে সঙ্গে অতিবেগুনি রশ্মি এবং পরিবেশের অন্য উপাদানের মিথস্ক্রিয়ার ফলে মাইক্রো ও ন্যানো প্লাস্টিকের কণা এবং বিসফেনলসহ নানা রকম ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশে নির্গত হয়। এসব মাইক্রো ও ন্যানো কণা এবং নিঃসৃত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মানুষ ও অন্যান্য জীবের হরমোনাল সিস্টেম নষ্ট করতে পারে।
ফলে প্লাস্টিক দূষণ মানুষ ও অন্যান্য জীবের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করে এবং স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করে নানা রকম দূরারোগ্য ব্যাধি সৃষ্টি করে। এছাড়া প্লাস্টিকের ন্যানো কণা এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মানুষ ও অন্যান্য জীবের কোষাভ্যন্তরের ডিএনএ ও আরএনএ অণুর মধ্যে পরিবর্তন করে দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সার বা স্নায়ুতন্ত্র বিকল করতে পারে।
যেসব প্লাস্টিক পণ্য মানুষ ব্যবহার করে, সেগুলো তৈরি হয় তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে। দেশে প্রতিবছর মাথাপিছু প্রায় ১৫ কেজি প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহৃত হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে এর পরিমাণ ৩৪ কেজিতে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশ্বে মাথাপিছু গড়ে ব্যবহৃত হয় ৬০ কেজি প্লাস্টিক। উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ ও জাপানের মতো উন্নত দেশে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ১০০ কেজির বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্লাস্টিকের পাত্রে কিছু রেখে খাওয়া এবং প্লাস্টিকের বোতলে পানি পান করা ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। প্লাস্টিকের বোতলে থাকা রাসায়নিক পদার্থ খাবারের মধ্যে চলে যায়। এটি খাবার থেকে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে। শুধু তাই নয়, প্লাস্টিকের পাত্রে খাবার গরম করলে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান বের হয়ে খাবারের মধ্যে প্রবেশ করে। এর ফলে ক্রমাগত বাড়ছে ক্যান্সার, অ্যাজমা, অটিজম, হরমোনজনিত সমস্যা, গর্ভপাতসহ নানা জটিল রোগ। এসব সামগ্রীর সংস্পর্শে প্রতিবছর আনুমানিক এক লাখ বয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের গবেষণা রিপোর্ট অনুসারে, সারাবিশ্বে প্রতি বছর ১৬ কোটি ৫০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে পতিত হয়। সাগর থেকে মহাসাগর পর্যন্ত পতিত হয় বছরে অন্তত ১০ কোটি টন। যার ৮৫ শতাংশই ভূমি উৎস থেকে পতিত হয়। সাগরে বর্তমানে ৫ দশমিক ২৫ ট্রিলিয়ন মাইক্রো ও ম্যাক্রো প্লাস্টিকের কণা জমা রয়েছে।
এভাবে চলতে থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যে সাগরে মাছের চেয়ে প্লাস্টিক কণার সংখ্যা বেশি হবে। বর্তমানে প্রতি বর্গমাইল সমুদ্রে ৫০ হাজার প্লাস্টিক টুকরা জমা রয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে হিমালয় পর্বতও রক্ষা পাচ্ছে না। এর ক্ষতি থেকে কোন দেশ বা অঞ্চলই রক্ষা পাচ্ছে না। যেসব দেশ প্লাস্টিক পণ্য বেশি উৎপাদন বা ব্যবহার করে তারা এবং যেসব দেশ উৎপাদন ও ব্যবহার কম করে তারাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রেহাই পায় না।
এক সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, প্লাস্টিক উৎপাদনে বছরে ব্যবহার হয় ১৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেল। এক আউন্স পরিমাণ প্লাস্টিক বা পলিথিন প্রস্তুত করতে পাঁচ আউন্স কার্বন ডাইঅক্সাইড বায়ুতে নির্গত হয়। এতে ব্যাপক গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া হয়। এ ছাড়া প্লাস্টিক থেকে উৎপাদিত পণ্য ব্যবহারের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরিবেশবিদরা কিছুটা সোচ্চার হওয়ায় প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার নিয়ে সারাবিশ্বেই ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও ব্যবহার বন্ধে আন্দোলনও হচ্ছে। তবে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা কিছুটা বাড়ছে। যথাযথ আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগ করে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার হঠাৎ করেই বন্ধ করা যাবে না। তবে প্লাস্টিক রিসাইকেল উপযোগী করা গেলে অনেক কম ক্ষতিকারক হবে। কারণ, এই বর্জ্য রিসাইকেল করে পুনরায় ব্যবহার করা যাবে। এর ফলে পরিত্যক্ত অবস্থায় যেখানে-সেখানে আর প্লাস্টিক পণ্য পড়ে থাকবে না। আর তা হলে প্লাস্টিক বর্জ্য মাটি ও পানির সঙ্গে মিশে পরিবেশের ক্ষতি করতে পারবে না।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব নিশ্চিতে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের ওপর জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা পালনে দেশের জনগণকে সম্পৃক্ত করা দরকার।
তারা বলেন, সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশ প্রশাসন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, সততা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ এবং জবাবদিহিতার অভাব ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবে বর্তমানে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে গেছে। একইসঙ্গে রয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলা।
তারা বলেন, ‘আগামী বছরগুলোতে প্লাস্টিকের ব্যবহার কি বাড়বে? আমরা অনায়াসে বলতে পারি বাড়বে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে হাত মিলিয়েই বাড়ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। তারা বলেন, অর্থনীতিতে যত বেশি প্রবৃদ্ধি আসছে প্লাস্টিকের ব্যবহারও বাড়ছে। প্লাস্টিক ব্যবহার হচ্ছে নির্মাণে, অবকাঠামো উন্নয়নে, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস শিল্পে এবং পরিবহনে।
তারা বলেন, আপনার ছোট ছোট পদক্ষেপে সমুদ্র দূষণ কমতে পারে। সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং চারপাশের মানুষকেও সমুদ্রের গুরুত্ব সম্পর্কে জানাতে হবে। সমুদ্রে বেড়াতে গেলে আমরা জেনে বা না বুঝে বিভিন্ন খাবারের প্যাকেটসহ বোতল বা প্লাস্টিক ইত্যাদি পানিতে ফেলে দূষিত করি। এবিষয়েও সচেতন থাকতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৫
আপনার মতামত জানানঃ