বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্লাস্টিক দূষণ। এরইমধ্যে সামুদ্রিক মাছ ও প্রাণীর পেটে ক্ষুদ্র আকারের প্লাস্টিক বা মাইক্রো প্লাস্টিকের অস্তিত্ব মিলেছে। এমনকি লবণেও মিলছে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক। এতে ঝুঁকির মুখে মানব জীবন।
সমুদ্র দূষণের কারণে মাছের পেটে প্লাস্টিকের কণা পাওয়ার খবর নতুন নয়। তবে এবার অশোধিত লবণের মধ্যেও পাওয়া গেছে প্লাস্টিকের কণা।
গবেষকরা প্রতি কেজি লবণের মধ্যে ৭৮ থেকে ১৩৭টি পর্যন্ত প্লাস্টিকের কণা পেয়েছেন। তবে গবেষকরা বলছেন, যে পরিমাণ কণার উপস্থিতি পাওয়া গেছে তা মূলত কম ঝুঁকিপূর্ণ ক্যাটাগরিতে পরেছে।
আন্তর্জাতিক জার্নাল নেচার এ গত ৩০ নভেম্বর ‘মাইক্রোপ্লাস্টিকস পলিউশন ইন সল্ট প্যানস ফ্রম দ্য মহেশখালী চ্যানেল, বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়। গবেষণাটি বাংলাদেশ ও বিভিন্ন দেশের কয়েকজন গবেষকের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে।
গবেষণায় মহেশখালীর ৮টি লবণ সংগ্রহ কেন্দ্র থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এই নমুনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতি কেজি লবণের মধ্যে টেরিপথ্যালেট ৪৮ শতাংশ, পলিপ্রোপাইলিন ২০ শতাংশ, পলিথিলিন ১৭ শতাংশ এবং পলিস্টিরিন ১৫ শতাংশ প্লাস্টিকের উপাদান পাওয়া গেছে।
এই গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলকে বিশ্বের অন্যান্য লবণ গবেষণার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তবে আগের বেশিরভাগ গবেষণাই রিফাইন করা বাণিজ্যিক সমুদ্রের লবণের উপর হয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, লবণ শুকানোর সময় প্লাস্টিকের কভারের ব্যবহার ছাড়াও শিল্পায়ন, পর্যটন, মৎস্য উৎপাদনের বিভিন্ন কার্যক্রমের ফলে এ দূষণ হতে পারে। গবেষণাটি বাংলাদেশে সামুদ্রিক লবণে প্লাস্টিকের উপস্থিতি সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে ও দূষণ কমাতে সহায়তা করবে।
এদিকে গবেষণায় বিভিন্ন দেশের সমুদ্র লবণে কী পরিমাণ প্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে তার একটি চিত্রও তুলে ধরেছে।
এই চিত্র থেকে দেখা গেছে, ভারতের সমুদ্রিক লবণের মধ্যে ৫ ধরনের প্লাস্টিকের কণা পাওয়া গেছে। প্রতি কেজিতে কণার সংখ্যা ১০০-৫০০০ পর্যন্ত। অন্যদিকে মালয়শিয়ার অবস্থা অবার ঠিক উল্টো। দেশটির সামুদ্রিক লবণের মধ্যে মাত্র একটি প্লাস্টিকের কণা পাওয়া গেছে। সংখ্যার হিসেবে এটি প্রতি কেজিতে ০-১ টি। একই অবস্থা নিউজিল্যান্ড, জাপান, ফ্রান্স, সাউথ আাফ্রিকা সহ কয়েকটি দেশের।
তবে ভিয়েতনাম, স্পেইন, ক্রোয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা বেশ খারাপ। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের অবস্থা এখনো বেশ ভালো আছে বলে এ তুলনায় দেখিয়েছেন গবেষকরা।
গবেষক দলের একজন সদস্য নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও গবেষক মো. রিফাত জাহান রাকিব বলেন, ‘আমরা মহেশখালী এবং এর আশপাশের এলাকা থেকে অশোধিত লবণ সংগ্রহ করে এই গবেষণাটি পরিচালনা করেছি। এটা খুবই সুক্ষ্ম, আলাদাভাবে বোঝার কোন উপায় নাই এটা প্লাস্টিকের কণা’।
‘আমরা যখন এই অশোধিত লবণকে বিভিন্ন কেমিক্যালের মিশ্রণে নিয়ে এসেছি তখন প্রকৃত চিত্র উঠে এসেছে। প্লাস্টিকের কণা চিহ্নিত করতে পেরেছি। তবে আমাদের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, এই লবণ বাজারজাত করার আগে রিফাইনিং করার পরেও তাতে এই প্লাস্টিকের কণা থেকে যাচ্ছে কি না তা জানা সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যতে ফান্ড পেলে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা করতে আগ্রহী’।
প্রতি কেজি লবণের মধ্যে টেরিপথ্যালেট ৪৮ শতাংশ, পলিপ্রোপাইলিন ২০ শতাংশ, পলিথিলিন ১৭ শতাংশ এবং পলিস্টিরিন ১৫ শতাংশ প্লাস্টিকের উপাদান পাওয়া গেছে।
প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে আমাদের বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় পরিবেশ দূষণের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এমন তথ্যই জানিয়েছেন আমাদের মৎস্য ও কৃষি বিজ্ঞানিরা।
এক গবেষণা রিপোর্টে বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী দিয়ে বছরে ২০ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে এসে পড়ছে। চীন, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল ভূটান থেকেও এসব প্লাস্টিক বর্জ্য এসে পড়ছে আমাদের বঙ্গোপসাগরে। ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগর থেকে আহরিত বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও অণুজীবের পেটে ক্ষুদ্র আকারের প্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এমনকি পরিশোধিত-অপরিশোধিত উভয় প্রকার লবণেই ক্ষুদ্র প্লাস্টিকের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে বলে জানান তারা।
প্লাস্টিকের কণার উপস্থিতির কারণে মানব শরীরে ক্যান্সারসহ দুরারোগ্য নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে বলে জানান চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা।বঙ্গোপসাগরে এই প্লাস্টিক দূষণের ঘটনাকে ভবিষ্যত জনস্বাস্থের জন্য একটি ভয়াবহ ও মারাত্মক হুমকী হিসাবে দেখছেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা জানান, মাইক্রো প্লাস্টিক বা প্লাস্টিক কণা আকারে খুবই ছোট বলে মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণি এগুলোকে নিজেদের খাবার ভেবে ভুল করে খেয়ে ফেলে। আর প্লাস্টিক খাওয়া সেই মাছ আমরা ভক্ষণ করি। মানে পরোক্ষভাবে আমরাও প্লাস্টিক ভক্ষণ করি।
তারা বলেন, আমরা যেখানেই প্লাস্টিকের দূষণ করি না কেন, তা সাগরে গিয়ে পৌঁছায়। আর এসব প্লাস্টিকের মধ্যে বড় আকারের যেমন আছে, তেমনি আছে ৫ মাইক্রোমিটার বা তারও চেয়ে ক্ষুদ্র। আবার বড় প্লাস্টিকও সমুদ্রে গিয়ে ক্ষুদ্র আকারে ভেঙ্গে যায়।
সাগরে কিছু প্লাস্টিক ভাসমান আর কিছু প্লাস্টিক তলদেশে থাকে। এ উভয় প্রকার প্লাস্টিকই আমাদের সমুদ্রের প্রাণিকূলের জন্য ক্ষতিকর।
আরও বলেন, সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের পর তা পানির তোড়ে দীর্ঘদিন ধরে ভাঙে। ভাঙা অংশগুলো পুনরায় সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির প্রভাবে ভেঙে ন্যানো, মাইক্রো ও ম্যাক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়।
তারা বলেন, এই ভাঙনের ফলে সৃষ্ট প্লাস্টিকের কিছু উপাদান (ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য, যেমন—বিসফিনল-এ নির্গত হয়) মানুষের দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর । প্লাস্টিক-দূষিত মাছ খাওয়ার ফলে আমরা বিসফিনল-এ দূষণ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারি। মাছ ছাড়াও সমুদ্রের অমেরুদন্ডী প্রাণিও মাইক্রোপ্লাটিক ‘ফিল্টার করে’ গ্রহণ করে বলে জানান তারা।
এছাড়া সমুদ্রের ক্ষুদ্র প্রাণিকণা বা জু-প্লাঙ্কটন এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক ভক্ষণ করে। আবার এসব ক্ষুদ্র প্রাণিকণা বিভিন্ন মাছের খাদ্য বলে মাছ এদেরকে ভক্ষণ করে। আর আমরা সেই মাছ খেতে গিয়ে আমরাও মাইক্রোপ্লাস্টিক খাই।
বিজ্ঞানীরা জানান, মাছের পেটে ছোট-বড় প্লাস্টিক পাওয়া থেকে বুঝা যায়, কিছু কিছু মাছ সরাসরি প্লাস্টিক ভক্ষণ করে থাকে।
প্লাস্টিক বর্জ্য শুধু আমাদের বঙ্গোপসাগরের জন্য নয়, সারা পৃথিবীর নদ-নদী ও সমুদ্রগুলোর দূষণের জন্য প্রধান দায়ী। পৃথিবীর নদীগুলো থেকে সমুদ্রে প্রতিবছর ১২ থেকে ২৪ কোটি মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য যায় বলে জানান বিজ্ঞানীরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪১
আপনার মতামত জানানঃ