দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে নতুন আঙ্গিকে জোরদার অভিযান শুরু হচ্ছে। অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করে শতাধিক ব্যক্তিকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) তালিকা করে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। তালিকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছাড়াও নৌপরিবহন অধিদপ্তর, রেল ভবন, গণপূর্ত অধিদপ্তর, ওয়াসাসহ আরো বেশ কিছু সরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম রয়েছে। এরই মধ্যে ৪৫ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এর আগে গত বছর দেশজুড়ে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করে। করোনা মহামারির কারণে তা স্থবির হয়ে পড়েছিল। এই ফাঁকে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে দুর্নীতির মচ্ছব শুরু করে দেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যান। তাঁদের ধরতেই এবার জোরদার অভিযান শুরু হচ্ছে।
শীর্ষপর্যায়ের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, চুনোপুঁটিদের ধরে জিজ্ঞাসাবাদে রাঘব বোয়ালদের নাম বেরিয়ে আসছে। এখন ‘সবুজ সংকেত’ পেলেই ওই সব রাঘব বোয়াল ধরতে অভিযান শুরু করা হবে। সূত্র বলছে, দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটসহ র্যাব, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ (সিআইডি) আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য সংস্থা দ্রুতই জোরদার অভিযানে নামছে। এ ক্ষেত্রে দুদকের তৈরি করা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর তালিকা গুরুত্ব পাবে। অভিযুক্তরা যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন সেদিকেও নজর রাখা হচ্ছে।
চুনোপুঁটিদের ধরে জিজ্ঞাসাবাদে রাঘব বোয়ালদের নাম বেরিয়ে আসছে। এখন ‘সবুজ সংকেত’ পেলেই ওই সব রাঘব বোয়াল ধরতে অভিযান শুরু করা হবে।
দুদকের মহাসচিব মোহাম্মদ দেলোয়ার বখত জানান, বদলি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজিসহ নানা কায়দায় বিপুল অবৈধ সম্পদ ও অর্থের মালিক হওয়া ৪৫ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। গোয়েন্দারা এরই মধ্যে তাঁদের ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। দুর্নীতিবাজদের প্রতিরোধ করতে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে সুপারিশও করা হয়েছে। এখন সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। তবে অনুসন্ধানে তথ্য পেলেই দুদক মামলা করে ব্যবস্থা নিচ্ছে। অনুসন্ধান শেষে যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ মিলবে, তাঁদেরই গ্রেপ্তার করা হবে।
অভিযানের বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। তবে এ ক্ষেত্রে সাধারণত দুদককে অনুসরণ করা হয়। দুদকের তালিকা ধরে এ ধরনের দুর্নীতিবাজদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হবে। এ ক্ষেত্রে দুদক যখনই সহযোগিতা চাইবে র্যাব এগিয়ে যাবে। এর বাইরেও অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীদের ধরতে তৎপর রয়েছে।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, ‘দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের এই চলমান প্রক্রিয়ায় কাউকেই ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে দুর্নীতিবাজদের তালিকাটা সাধারণত দুদকই করে থাকে। তাদের করা তালিকা ধরে আগেও আমরা অভিযুক্ত অনেককে গ্রেপ্তার করেছি। আর দুদকের বাইরে অভিযোগ পেলে বা মামলা হলে তদন্ত করে অভিযুক্তদের এর আগেও ধরেছে ডিবি। তবে এ ক্ষেত্রে দুদকের ভূমিকা বেশি।’
সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল বলেন, ‘সাধারণত অবৈধ সম্পদ পাচারের কোনো তথ্য পেলেই আমরা মানি লন্ডারিংয়ের মামলা দায়েরের জন্য অনুসন্ধান শুরু করি। তবে দুদক চাইলে আমরা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাব।’
দুদক সূত্র বলছে, নতুন করে শুরু হতে যাওয়া অভিযানে সবচেয়ে বেশি ধরা পড়তে পারেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মীরা। দুদকের তালিকা ধরে অনুসন্ধানে এই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তা এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বেশি দুর্নীতির তথ্য মিলেছে।
অভিযুক্ত এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে রয়েছেন—জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুন্সী সাজ্জাদ হোসেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কবির আহমেদ চৌধুরী ও হুমায়ুন কবীর, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আলীমুজ্জামান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অফিস সহকারী খাইরুল আলম, সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের হিসাবরক্ষক মজিবুর রহমান, শহীদ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ওয়াহিদুজ্জামান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার উচ্চমান সহকারী রেজাউল ইসলাম, মহাপরিচালক দপ্তরের সহকারী প্রধান জোবায়ের হোসেন, সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের প্রধান সহকারী এম কে আশেক নওয়াজ, কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান, মুগদা মেডিক্যাল কলেজের হিসাবরক্ষক আবদুল্লাহ হেল কাফি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফারুক হাসান, প্রধান সহকারী আশরাফুল ইসলাম, সাজেদুল করিম, উচ্চমান সহকারী তৈয়বুর রহমান ও সাইফুল ইসলাম, চট্টগ্রাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচ্চমান সহকারী ফয়জুর রহমান, রংপুর মেডিক্যাল কলেজের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আলিমুল ইসলাম, সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজের ল্যাব সহকারী আব্দুল হালিম ও সুব্রত কুমার দাস, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সচিব আনায়ার হোসেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক শাহজাহান, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের সিনিয়র স্টোর কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম ও স্টোর কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন, কুড়িগ্রাম হাসপাতালের হিসাবরক্ষক আব্দুল মজিদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্টোর ম্যানেজার হেলাল তরফদার, ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের স্টোরকিপার সাফায়েত হোসেন, গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিক্যাল কলেজের স্টেনোগ্রাফার সাইফুল ইসলাম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগের পরিচালক কার্যালয়ের সহকারী প্রধান পরিসংখ্যান কর্মকর্তা মীর রায়হান আলীম এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষণ কর্মকতা মজিবুল হক মুন্সি ও তাঁর স্ত্রী রিফাত আক্তার, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর তোফায়েল আহমেদ ভূইয়া ও তাঁর স্ত্রী খাদিজা আক্তার, গাড়িচালক আব্দুল মালেক ও তাঁর স্ত্রী নার্গিস বেগম, গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ওবাইদুর রহমান এবং তাঁর দুই স্ত্রী বিলকিচ রহমান ও রেহেনা আক্তার (ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজের স্টাফ নার্স), রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হিসাবরক্ষক ইমদাদুল হক ও তাঁর স্ত্রী উম্মে রুমান ফেন্সী, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহমুদুজ্জামান ও তাঁর স্ত্রী সাবিনা ইয়াছমিন, গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্টোর অফিসার নাজিম উদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী ফিরোজা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ বিভাগের অফিস সহকারী কামরুল হাসান ও তাঁর স্ত্রী ডা. উম্মে হাবিবা।
আপনার মতামত জানানঃ