বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই নারীরা উত্ত্যক্ত বা যৌন হয়রানি ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এসব ঘটনা ক্রমে বেড়েই চলেছে। অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল পার্লামেন্টের ৫১ শতাংশ কর্মচারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টের সাবেক একজন কর্মী ব্রিটনি হিগিন্স অভিযোগ তোলার পর বিষয়টি সামনে আসে। ব্রিটনির অভিযোগ, একজন মন্ত্রীর কার্যালয়ে সহকর্মীর দ্বারা তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
এ বছরের শুরুর দিকে তিনি অভিযোগ তোলার পর চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। লিঙ্গবৈষম্য বিষয়ক কর্মকর্তা কেট জেনকিন্স এ ব্যাপারে বলেছেন, ভুক্তভোগীরা বেশির ভাগই নারী।
‘সেট দ্য স্টান্ডার্ড’ নামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক-তৃতীয়াংশ কর্মী কোনও না কোনও ভাবে হয়রানি, যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। এক হাজার ৭২৩ ব্যক্তি ও ৩৩টি সংস্থার সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি করা প্রতিবেদনটি মঙ্গলবার (৩০ নভেম্বর) পার্লামেন্টে উপস্থাপন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে ৬৩ শতাংশ নারী পার্লামেন্টারিয়ানের যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতা রয়েছে। রাজনৈতিক কর্মীদের বেলায় এই হার আরও অনেক বেশি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আইনপ্রণেতা ওই প্রতিবেদনে বলেন, ‘সংস্কৃতি এটা অনুমোদন করছে, উৎসাহ দিচ্ছে।’
যৌন হয়রানি কমাতে প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে নেতৃত্ব এবং জেন্ডার ভারসাম্যে উন্নতি করা এবং অ্যালকোহল ব্যবহারের সংস্কৃতি কমিয়ে আনা।
অস্ট্রেলিয়ায় মেয়েদের বাইরে থেকে মনে হয় স্বর্গসুখে আছেন তারা৷ আসলে ঘরের কোণে, পথে-প্রান্তরে, অফিস-আদালতে অস্ট্রেলীয় নারী আর উপমহাদেশ, আফ্রিকা বা আরব অঞ্চলের নারীদের মাঝে খুব বেশি পার্থক্য নেই৷ অস্ট্রেলিয়ায় ১৮ থেকে ৬৪ বছর বয়সী নারীদের অনেকে পাঁচ বছর আগেই জানিয়েছেন পুরুষ কতটা নির্মম আচরণ করে আসছে তাদের ওপর৷ সে দেশের ব্যুরো অফ স্ট্যাটিসটিকস এক জরিপ চালিয়ে দেখেছে দেশময় নীরবে চলছে ভয়াবহ নারী নির্যাতন, ধর্ষণ,যৌন নিপীড়ন৷ শারীরিক নির্যাতন মুখ বুঁজে সহ্য করতে হচ্ছে নারীদের৷
অস্ট্রেলিয়ায় নারীর প্রতি যৌন নির্যাতনের হার ভারতীয় উপমহাদেশের চাইতেও কম নয়। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অব হেলথ অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার জানিয়েছে, অস্ট্রেলিয়ায় প্রতি ছয় নারীর একজনকে শারীরিক বা যৌন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। ওই নারীরা তাদের সঙ্গীদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
এআইএইচডব্লিউ জানায়, অস্ট্রেলিয়ায় পনেরো লাখেরও অধিক নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। প্রতি ছয় নারীর একজন সঙ্গীর হাতে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। প্রতি চারজনের তিনজনই পুরুষের হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা জরিপ সংস্থা আইভিএডাব্লিউএস জানিয়েছে, অস্ট্রেলিয়ায় অবিবাহিত নারীরাও সাবেক বা বর্তমান ছেলে বন্ধু বা সঙ্গীর কাছে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অহরহ৷ কোনো সম্পর্ক নেই এমন পুরুষের নির্যাতনের শিকার হারই বরং কম, কোথাও কোথাও নাকি ছয় জনে মাত্র একজন৷
প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে ৬৩ শতাংশ নারী পার্লামেন্টারিয়ানের যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতা রয়েছে। রাজনৈতিক কর্মীদের বেলায় এই হার আরও অনেক বেশি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আইনপ্রণেতা ওই প্রতিবেদনে বলেন, ‘সংস্কৃতি এটা অনুমোদন করছে, উৎসাহ দিচ্ছে।’
নির্যাতকদের কদর্যতা ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা বাংলাদেশের কথাই মনে করিয়ে দেয়৷ প্রেমিকা বা সঙ্গিনীকে বলা হচ্ছে, ‘‘শরীর দেখা যায় এমন পোশাক কখনো পরবেনা, অন্য পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা করবেনা, টেলিফোনে যার-তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ” ।
এদিকে বিয়ে করলে বিবাহিত জীবনে নারীদের অনেক ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা বলতে তেমন কিছু থাকেনা৷ সন্তান হলে অস্ট্রেলিয়ার অনেক মেয়েও ছেড়ে দেয় চাকরি৷ তারপরই শুরু হয় বিপদ৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে বলেছেন স্বামী সব রকমভাবে তাদের বন্দি করে রাখতে ক্রেডিট কার্ড কেড়ে নিয়ে বাতিল করেছে, মোবাইল ব্যবহারেও জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা, যখন তখন বাইরে বেরোনো অনেক মায়ের কাছে যেন বেশি কিছু চাওয়া, এমনকি বাবা-মায়ের কাছে যাওয়াও নিষিদ্ধ৷
অবশ্য নারীর অবস্থা এবং অনেক পুরুষের আচরণের সঙ্গে মিল দেখা গেলেও নারীর নিরাপত্তা বিধানে সরকারের ভূমিকা দেখলে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা বাংলাদেশের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার পার্থক্য মানতেই হবে৷ পরিস্থিতি সামাল দিতে কিছু আইন করেছে অস্ট্রেলিয়া সরকার৷ ঘরে নির্যাতনের শিকার হয়েছে জানালে পুলিশি ব্যবস্থার নিশ্চয়তা তো আছেই, এ কারণে বিশেষ ছুটিও অচিরেই পাবেন নির্যাতিতারা৷ এছাড়া নারী এবং শিশুদের নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা দিতে ১২ বছর মেয়াদি এক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছে অস্ট্রেলিয়া সরকার৷
কদিন আগেই এসবের বিরুদ্ধে স্মরণকালের সেরা এক প্রতিবাদ ঘটে গেছে অস্ট্রেলিয়ায়।
যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ জানাতে এবং নারীদের সমতা নিশ্চিত করার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় এক লাখের বেশি নারী বিক্ষোভ করেছেন। ক্যানবেরা, সিডনি, মেলবোর্নের মতো বড় শহরসহ প্রায় ৪০টি শহরে সে দেশের নারীরা পদযাত্রায় অংশ নেন।
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি যৌন নির্যাতনের ঘটনা সামনে আসে। এ ঘটনার জেরে সে দেশের নারীরা ‘বিচারের জন্য পদযাত্রা’ করছেন। এতে অংশগ্রহণকারীদের অনেককে নানা স্লোগানসংবলিত প্ল্যাকার্ড বহন করতে দেখা যায়। যেমন কোনোটিতে লেখা ছিল, ‘আপনারা শুনছেন না’, কোনোটিতে ছিল, ‘আপনারা কতজন ভুক্তভোগীর খবর রাখেন?’ অধিকাংশ বিক্ষোভকারীর পরনে ছিল কালো পোশাক।
বিবিসির খবরে বলা হয়, সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টসহ বিভিন্ন স্থানে যৌন নির্যাতনের অভিযোগের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এর প্রতিবাদের অংশ বিক্ষোভ করেছেন তারা।
খবরে বলা হয়, দেশটিতে ধর্ষণের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বেড়েছে। এ নিয়ে সেখানকার রক্ষণশীল সরকার অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে রয়েছে। এ অবস্থার মধ্যেই এই বিক্ষোভ হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিকভাবে নারীদের যৌন হয়রানি বা নির্যাতনের মতো ঘটনা প্রতিরোধে এগিয়ে আসার সময় হয়েছে। পৃথিবী নারীদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে। এসব প্রতিরোধে এখনি এগিয়ে আসতে হবে। সভ্য ও আধুনিক পৃথিবীতে নারীর প্রতি এহেন আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫৩
আপনার মতামত জানানঃ