ডিজেলের দাম বাড়ার পর কোনো ঘোষণা ছাড়াই পরিবহণ ধর্মঘট করে পরিবহন মালিকেরা সারাদেশ অচল করে দেন। মন্ত্রীরা বা বিআরটিএ সময় চাইলেও তারা সময় দেননি। তারা ইচ্ছেমত ধর্মঘট ডেকে খুশিমত ভাড়া আদায় করে নিয়েছেন। এদিকে নতুন ভাড়া আদায় নিয়েও চলছে নৈরাজ্য। যে যেভাবে পারছে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও বেশি আদায় করছে। কিলোমিটার অনুযায়ী কেউ ভাড়া নিচ্ছে না। কেউই তাদের এই নৈরাজ্য থামাতে পারছেন না কেন?
প্রসঙ্গত, মোট সিটের শতকরা ৭০ ভাগ বিবেচনায় নিয়ে বিআরটিএ বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে। এরপর প্রতিটি বাসে সামনের দিকে দুই-তিনটি অবৈধ সিট থাকে। উপরন্তু সিটের বাইরেও দাঁড়িয়ে কমপক্ষে ১৫ জন যাত্রী বহন করা হয়। ফলে বাস মালিকেরা তাদের প্রকৃত যে আয় হওয়ার কথা তার দ্বিগুণ আয় করে একই খরচে। অথচ শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে তারা বলছে ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
নৈরাজ্যের ছড়াছড়ি
শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিয়ে বাস মালিকেরা দাবি করছেন, অর্ধেক ভাড়া নিলে তাদের লোকসান হবে। একারণে তারা সরকারের কাছে প্রণোদনা ও ভর্তুকি দাবি করছেন। সেটা ছাড়া তারা শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া নিতে রাজি নন।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “এর বাইরে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বাড়তি ভাড়া ও কিলোমিটার চুরি তো আছেই। বাস মালিকেরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নিলে তো লোকসান হওয়ার কোনো কারণ নেই। একটি বাসে সর্বোচ্চ তিন-চারজন শিক্ষার্থী থাকে।”
তার মতে, “বাস মালিকদের কাছে সরকার ও সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছে। তারা টাকা ছাড়া আর কিছু বোঝে না। এই বাস মালিকেরা চাঁদার নামে যে কোটি কোটি টাকা তোলে তার একটি অংশ অসৎ রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালী ব্যক্তি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পায়। তারও এই বাস মালিকদের পক্ষে প্রশাসনসহ সব জায়গায় এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। ফলে বাস মালিকেরা এখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে।”
সরকার সমর্থিত দেশের শীর্ষ পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর আচরণ শুধু মানুষকেই বেকায়দায় ফেলেনি; সরকারকেও বিব্রত অবস্থায় ফেলেছে। তেলের দাম কমানোর অজুহাতে তারা হঠাৎ গণপরিবহন বন্ধ করে দেশ অচল করে দেয়ার তিন দিনের মাথায় তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে বাধ্য হয় সরকার।
এ প্রসঙ্গে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, “সরকারের প্রতিষ্ঠানই তো নিয়ম নীতি মানে না। সিটি কর্পোরেশনের গাড়িগুলো চালায় পরিচ্ছন্নকর্মী, ড্রাইভারদের লাইসেন্স নাই, গাড়ির ফিটনেস নাই। এটা দেখে তো বেসরকারি যানবাহনের মালিকেরা উৎসাহিত হন। আর বাসের মালিক কারা? সরকারের মন্ত্রী, এমপি, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। তাহলে কারা তাদের থামাবে?”
তিনি মনে করেন, “এই কারণেই এখন পরিবহন শ্রমিকেরা শিক্ষার্থীদের পেটাচ্ছে, হয়রানি করছে, ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু তারা যতই বাড়ুক না কেন তাদের অর্ধেক ভাড়ার দাবি মানতেই হবে। এটা শিক্ষার্থীদের অধিকার।”
তার মতে, “মালিকেরা এমনিতেই নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি নিচ্ছেন। আর ভাড়া নির্ধারণের সময় শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার বিষয়টি মাথায় রেখেই নির্ধারণ করা হয়। প্রতিবাদ করলে আমরা যাত্রীরা করব। মালিকেরা কেন? আমরা তো হাফ ভাড়া সমর্থন করি।”
তিনি বলেন, “ভাড়া নির্ধারণে মালিক থাকে কিন্তু যাত্রীদের কোনো প্রতিনিধি থাকেনা। ফলে তারা যা খুশি তাই করে।”
নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের
জানা গেছে, বর্তমানে দেশের পরিবহন সেক্টরের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে আবির্ভূত ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও বাংলাদেশ শ্রমিক পরিবহন ফেডারেশন। এ তিনটি সংগঠনই সরকার সমর্থিত। পরিবহন সংক্রান্ত যে কোন দাবি দাওয়া নিয়ে সরকারের সঙ্গে এ তিনটি সংগঠনই মূল ভূমিকা পালন করে। যে কারণে তাদের অঙ্গুলি নির্দেশেই গোটা দেশের পরিবহন যখন তখন বন্ধ হয়ে যায়, আবার চালু হয়ে যায়।
সাম্প্রতিক পরিবহন ধর্মঘটে সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানান, অথচ এই সংগঠনের নেতৃবৃন্দ জানায়, তারা ধর্মঘটের ডাকই দেয়নি। ঢাকা সড়ক পরিবহনের মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ও শ্রমিক ফেডারেশনের শাহজাহান খান সুস্পষ্ট বলেছেন, সংগঠনগুলো ধর্মঘটের ডাক দেয়নি। মালিকরা স্বেচ্ছায় গাড়ি বন্ধ করে দিয়েছেন। তাদের মুখে এমন মন্তব্য শুনে ভুক্তভোগীরাও বিস্মিত।
তাহলে মালিকদের ওপর কি তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। তাদের এই সংগঠনের কাজটা কী? তাদের অনুমতি ও সিদ্ধান্ত ব্যতীত কিভাবে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ দেশ অচল করার দুঃসাহস দেখিয়েছে মালিকরা? আবার রবিবার বিকেলে ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানানোর এক ঘণ্টার মধ্যেই সড়কে গাড়ি বের করে মালিকরা। যেন আগে থেকেই সব ঠিক ছিল।
এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, পরিবহন মালিক সমিতি হঠাৎ গাড়ি বন্ধ করে দেয়ায় দেশে যে ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা অবশ্যই এড়ানো যেতো। সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করে যদি দাবি আদায় না করা যেত, তখন সময় নিয়ে কর্মসূচী দিলে মানুষের এত ভোগান্তি ও ক্ষয়ক্ষতি হতোনা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭০০
আপনার মতামত জানানঃ