প্রতিদিন একটু একটু করে জনজীবন গ্রাস করে নিচ্ছে এক পুরনো মহামারি। ম্যালেরিয়া বা কলেরা নয়, এইডসও নয়। এ মহামারির নাম সড়ক দুর্ঘটনা। আর এই মহামারির উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলো এবং সেখানকার শিশুরা। গরিব দেশগুলোর শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার জন্য যানবাহনে চড়ার সুযোগ সীমিত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব শিশুকে হেঁটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে হয়। এ কারণে এসব দেশের শিশুদের সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি অন্য দেশগুলোর তুলনায় বেশি।
জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও ঐতিহ্যবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং (জিইএম) শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
ইউনেসকো রিপোর্টে স্কুলে যাওয়া শিশুদের দুর্ঘটনা কমাতে বিভিন্ন দেশের গৃহীত ব্যবস্থা তুলে ধরেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সময় সড়কে শিশুর মৃত্যু রোধে কয়েকটি দেশ কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে। শিশুদের ট্রাফিক আইন ও সড়কে চলাচলের নিয়মকানুন সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। সড়কে বসানো হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি দুর্ঘটনা প্রতিরোধী ব্যবস্থা। শিশুদের সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে এসব কার্যকর উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে ইউনেসকো বলছে, ৬০টি দেশের প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার কিলোমিটার সড়কে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, সেখানে প্রায় ৮০ শতাংশ যানবাহন প্রতি ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে চলে। পথচারীদের চলাচলের জন্য নেই ফুটপাত। মহাসড়কের অবস্থাও বেহাল। বেশির ভাগ গরিব দেশে মহাসড়কের পাশেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থান। অনেক জায়গায় ব্যস্ত মহাসড়ক পার হয়ে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যেতে হয়। এসব কারণে হেঁটে বিদ্যালয়গামী শিশুদের সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার ও মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়।
শিশুদের সড়ক ব্যবহারের নিয়ম শেখানো ও ব্যবস্থাপনাগত পরিবর্তন—সড়কে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারে বলে মনে করছে ইউনেসকো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিশুদের জন্য নিরাপদ সড়ক তৈরিতে সমন্বিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। শিশুদের সড়ক ব্যবহারের শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার নিরাপদ রুট প্রণয়ন করেছে দেশটি। এমন উদ্যোগের ফলে দেশটির সড়কে শিশুদের হতাহতের ঘটনা ১৯৮৮ সালের তুলনায় ২০১২ সালে ৯৫ শতাংশ কমে এসেছে। গরিব দেশগুলোও এমন সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে সড়কে শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে পারে।
আফ্রিকার দেশ কেনিয়ার সরকার গ্লোবাল রোড সেফটি পার্টনারশিপ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ সহায়তায় মহাসড়কে যানবাহনের গতি কমিয়ে আনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হতাহতের ঝুঁকি কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। থাইল্যান্ডে ১০ লাখের বেশি শিশু মা–বাবার মোটরসাইকেলে করে বিদ্যালয়ে যায়। তাদের মধ্যে মাত্র ৭ শতাংশ হেলমেট ব্যবহার করে। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে তাদের সচেতন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের সড়ক ব্যবহারে সচেতন করতে বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে উরুগুয়ে সরকার। উগান্ডার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একই ধরনের উদ্যোগ নিতে চাইছে দক্ষিণ আমেরিকার অন্য দেশগুলো।
বাংলাদেশের মতো অনেক দেশেই সড়ক দুর্ঘটনার হার খুব বেশি৷ দুর্ঘটনায় অনেক শিশুও মারা যায়৷ অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, শিশুরা কখনও পথচারী, কখনও সাইক্লিস্ট এবং কখনও গাড়ির যাত্রী হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়। তবে সবচেয়ে বেশি হয় পথচারী হিসেবে। গবেষণাটি বলছে, দুর্ঘটনায় যত শিশু মারা যায় তার শতকরা ৮০ ভাগই পথচারী হিসেবে, যাদের বয়স ৫ থেকে ১০ দশ বছরের মধ্যে। শিশু পথচারীদের প্রায় অর্ধেক মারা যায় রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় এবং প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ রাস্তা পার হতে গিয়ে।
বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা যায় তার উল্লেখযোগ্য অংশ শিক্ষার্থী এবং শিশু।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ছয় হাজার ৬৮৬ জন, যার মধ্যে ৭০৬ জন শিক্ষার্থী ও ৫৪১টি শিশু— যা মোট মৃত্যুর প্রায় ১৯ ভাগ।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন গত সপ্তাহে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে উঠে আসে যে গত ১০ মাসে বাংলাদেশে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যায় ১,৭৫৮ জন, যার মধ্যে ৬৪৯ জনই শিক্ষার্থী। অর্থাৎ গত ১০ মাসে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের প্রায় ৩৭ ভাগই শিক্ষার্থী।
ডব্লিউবি-এর রিপোর্টে আরও বলা হয়, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের ৬৭ শতাংশই ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী। এক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে মূলত ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ব্যক্তিরা। এছাড়া, সড়ক দুর্ঘটনায় পুরুষ ও নারীর মৃত্যুর অনুপাত ৫:১।
বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা যায় তার উল্লেখযোগ্য অংশ শিক্ষার্থী এবং শিশু।
বিশ্বব্যাংকের মতে, উচ্চ আয়ের দেশগুলোর তুলনায় নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার তিনগুণ বেশি। এসব কারণে দেশে সেবছর ১১ হাজার ৬৩০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে বলে জানায় তারা। সে বছর সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে বাংলাদেশের জিডিপির ৫.৩ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও উল্লেখ করে তারা।
প্রতিনিয়তই ঘটছে এ রকম দুর্ঘটনা। আর ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য তাজা প্রাণের সঙ্গে বেশ কিছু তরুণ-প্রাণ। যে কোনো অপমৃত্যুই বেদনার। কিন্তু শিশুদের অপমৃত্যু যেন মেনে নেওয়া যায় না কোনোমতেই। শিশুরা জাতির ভবিষ্যত। আমাদের অবহেলার কারণে সেই সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ অকালেই পতিত হবে মৃত্যুর অন্ধকারে, এর থেকে হৃদয়বিদারী আর কিছু হতে পারে না।
সড়কে শিশুহত্যা কীভাবে ঠেকানো যাবে? গবেষণা বলছে, যে উপাদানগুলো সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে শিশুদের জড়িত করে ফেলে তার মধ্যে রয়েছে, চালক এবং শিশু উভয়েরই ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ; সড়কে শিশুদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে যে প্রকৌশল-পদ্ধতি তার অপ্রতুলতা ও অকার্যকারতা; অপর্যাপ্ত শিক্ষা আর অসন্তোষজনক আইন-প্রয়োগ কাঠামো। শিশুদের সড়ক নিরাপত্তার শিক্ষা দেওয়া হলে তা দীর্ঘমেয়াদে প্রতিরোধ করতে পারে সড়ক দুর্ঘটনা, বাঁচিয়ে দিতে পারে অসংখ্য তরুণ-প্রাণ।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, শিশুদের জন্য সড়ক নিরাপত্তার শিক্ষা কী? এটি হচ্ছে এমন একটি দীর্ঘমেয়াদী শিখন-পদ্ধতি যা সড়কে শিশুদের আচরণ পাল্টে দিয়ে তাদের দুর্ঘটনায় পড়ার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস করতে পারে। এটা পুরোপুরি একটা বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতি, যা শিশুর বয়োঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধাপে ধাপে তাকে তৈরি করে দেয় একজন নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী হিসেবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শিশুদের বাঁচানোর কিছু উপায় জানিয়েছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, রাস্তার কাছে কোনো শিশু দেখলে তার দিকে বড়দের নজর রাখা উচিত৷ শিশুরা অবুঝ বলেই অনেক সময় ব্যস্ত রাস্তাও পার হতে যায়৷ এ কারণে অনেক শিশু মারাও যায়৷ ডব্লিউএইচও বলছে, বড়রা সতর্ক হলে সড়ক দুর্ঘটনা থেকে শিশুদের রক্ষা করা সম্ভব৷
যানবাহন বেশি দ্রুত চালালে দুর্ঘটনার শঙ্কা বাড়ে৷ তাই নিয়ন্ত্রিত গতিতে চালানো সবার জন্যই মঙ্গলজনক৷ শিশুদের জন্য তা আরো বেশি দরকার৷ দ্রুত চালালে কোনো শিশু যদি হঠাৎ গাড়ির সামনে চলে আসে, চালক চট করে গাড়ি থামাবেন কী করে!
পথে নামলে কী কী দিকে খেয়াল রাখতে হয়, তা শিশু যত তাড়াতাড়ি শিখবে ততই ভালো৷ বিশেষ করে শিশু যেন রাস্তার কোনদিক থেকে যানবাহন আসছে তা দেখতে শেখে এবং রাস্তা ফাঁকা না হলে পার হওয়ার চেষ্টা না করে—এইটুকু সব বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনেরই শিশুদের জরুরি ভিত্তিতে শেখানো উচিত৷
রাস্তাঘাট ভালো না হলেও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে৷ তাই রাস্তাঘাট ভালো করাটা দুর্ঘটনার রোধের খুব গুরুত্বপূর্ণ উপায়৷ তাছাড়া প্রতিটি রাস্তায় সতর্কতা সংকেত, রাস্তা পারাপারের চিহ্ন, জেব্রা ক্রসিং—এ সব থাকা জরুরি৷ শিশুদের জন্য চিহ্নগুলো বেশি দরকার, কেননা, ছবি দেখে তারা যেমন সব কিছু দ্রুত শিখতে পারে, সেভাবে নানা রংয়ের সংকেত দেখেও নিজেকে নিরাপদ রাখতে শেখে শিশুরা৷
যানবাহন চালানো খুব দায়িত্বশীল কাজ৷ একজন চালকের ওপর অনেকের জীবন নির্ভরশীল৷ তাই অবশ্যই লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তিকেই যানবাহন চালানোর সুযোগ দিতে বলেছে ডব্লিউএইচও৷ এর সঙ্গে মানবিক শিক্ষার ওপরও জোর দিতে বলা হয়েছে৷ নিজের জীবনের পাশাপাশি অন্যের জীবনের গুরুত্ব না বুঝলে লাইসেন্সধারী চালকও তো কারো জন্য নিরাপদ নয়!
সড়ক দুর্ঘটনার পর খুব তাড়াতাড়ি চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায় না বলেও অনেক শিশু মারা যায়৷ তাই রাস্তার কাছেই প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা এবং শিশুদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল বাড়ানোর দিকে প্রতিটি দেশকে নজর দিতে বলেছে ডব্লিউএইচও৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৬
আপনার মতামত জানানঃ