নিম্নমান ও ত্রুটিপূর্ণ সোলার প্যানেল স্থাপন এবং সরঞ্জাম কেনার নামে গত ১০ বছরে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ লুটপাট হয়েছে দেশে। শহর ও গ্রামে গড়ে ওঠা শত শত ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিম্নমানের প্যানেল আমদানি করে বেশি দামে বিক্রি করছে। যার অধিকাংশই বসানোর কিছুদিনের মধ্যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেক প্যানেল দিয়ে একদিনও বাতি জ্বালানো সম্ভব হয়নি। অথচ প্রতিবছর সোলার প্যানেল স্থাপন কর্মসূচিতে যে পরিমাণ চাল বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে টাকার অঙ্কে তা ২ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা।
দুর্নীতি আর লুটপাট
এতে প্রতারিত হচ্ছে গ্রাহকরা। জানা গেছে, ২০১০ সাল থেকে রাজধানীসহ সারা দেশের বহুতল ভবনের ছাদে যেসব সোলার প্যানেল বসানো হয়েছিল তার কোনোটিই এখন আর কার্যকর নেই। বেশির ভাগই ছিল নামসর্বস্ব। এসব প্যানেল বসাতে একেকজন গ্রাহকের খরচ হয়েছে গড়ে ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা।
গ্রাহক প্রতারণার পাশাপাশি ব্যাহত হয়েছে গ্রাম পর্যায়ে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার সরকারি উদ্যোগ। একই সঙ্গে অযথা খরচ যাচ্ছে বিপুল অঙ্কের অর্থ।
অভিযোগ উঠেছে দুর্নীতি, লুটপাট আর নিম্নমানের সোলার প্যানেল অবাধে বিক্রি হওয়ায় উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। বসানোর পরপরই যন্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ, ব্যাটারি নষ্ট হওয়াসহ নানা কারণে অধিকাংশ প্যানেল অকেজো হয়ে গেছে।
জানা গেছে, ২০১৭ সালে বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে একটি জরিপ চালানো হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, ঢাকা সিটিতে আবাসিক গ্রাহকদের সোলার প্যানেলের সংখ্যা ছিল ৬০ হাজারের বেশি। তার মধ্যে ৫০ হাজারের বেশি নষ্ট।
এর মধ্যে ডিপিডিসি, পিডিবি ও ডেসকোর অধীনে থাকা বেশির ভাগ সোলারই নষ্ট। অপরদিকে ২০১৭ সালের পর যেসব ভবনে সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে তার সবগুলোই ছিল নামসর্বস্ব। মূলত বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়ার জন্য জোড়াতালি দিয়ে এসব প্যানেল বসানো হয়।
তবে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (আরইবি) ও নর্দার্ন পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) অধীনে থাকা সোলার প্যানেলগুলো চলছিল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কিন্তু চলতি বছরে শতভাগ বিদ্যুতায়ন হওয়ায় গ্রামে অনেক প্যানেলের এখন আর অস্তিত্ব নেই।
সূত্র মতে, শুধু বহুতল ভবন নয়, দেশব্যাপী স্থাপন করা বেশির ভাগ সোলার প্যানেল এখন নষ্ট। কোথাও কোথাও প্যানেল থাকলেও সেগুলোতে আলো জ্বলছে না। অনেকে বাড়ির ছাদ থেকে হাওয়া হয়ে গেছে প্যানেল। এ অবস্থায় দেশব্যাপী খেলাপি হয়ে পড়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ।
এর মধ্যে শুধু ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) ১৪শ কোটি টাকা। ঋণ আদায় করতে না পেরে সংস্থাগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বেকার হওয়ার পথে ৫শর বেশি কর্মী।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি
বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলোর দাবি ছিল একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের দেওয়া অর্থ থেকে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। এজন্য সরকার ১৯৯৭ সালে ইডকল নামে একটি কোম্পানি গঠন করে।
বর্তমানে ইডকলের সঙ্গে ৫৭টি সৌরবিদ্যুৎ কোম্পানি কাজ করছে। কিন্তু অভিযোগ উঠছে খোদ ইডকল ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া বেশির ভাগ সোলার প্যানেলের মান খুবই খারাপ।
ব্যাটারির ক্ষেত্রে ৩ বছরের ওয়ারেন্টি এবং পুরো প্যানেলের ওয়ারেন্টি ২০ বছর থাকলেও ৬ মাসের মধ্যে বেশির ভাগ প্যানেল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সোলার কোম্পানি গ্রিনফিনিটি এনার্জির এক কর্মকর্তা বলেন, চীন থেকে আনা ৮০-১০০ ওয়াটের প্যানেলে স্টিকার বসিয়ে তা ১২০-১৫০ ওয়াটের বানানো হচ্ছে।
ডিপিডিসি, ডেসকো, বিএসটিআই, বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ইডকল কারও কাছেই কোনো টেস্টিং ল্যাব কিংবা ফ্যাসিলিটিজ নেই। যে কারণে নিম্নমানের প্যানেল বসানোর বিষয়টি প্রায় কেউই ধরতে পারছে না
বঞ্চিত হতদরিদ্ররা
অপরদিকে কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) খাত থেকে বড় অঙ্কের অর্থ নিয়ে সোলার প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়েও গ্রামের হতদরিদ্র মানুষজনকে নির্মমভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এ খাতে হাজার কোটি টাকা গচ্চা যাওয়ায় লাখ লাখ হতদরিদ্র মানুষ মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রতিবছর সোলার প্যানেল স্থাপন কর্মসূচিতে যে পরিমাণ চাল বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে টাকার অঙ্কে তা ২ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। যার অর্ধেক ১ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা সোলার প্যানেলসহ জরুরি নয় এমন কাজে খরচ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০২১ সাল পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে কমপক্ষে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা। এজন্য এ খাতে ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে পাওয়া গেছে মাত্র এক থেকে দেড়শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। বাকি সাড়ে ৩শ মেগাওয়াটের টাকা হাওয়া। অথচ এই পরিমাণ টাকা খরচ করে জাতীয় গ্রিডে যোগ করা যেত কমপক্ষে ৫শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। যার স্থায়িত্ব হতো কমপক্ষে ২০ বছরের বেশি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭১৮
আপনার মতামত জানানঃ