মামুন আব্দুল্লাহ : হঠাৎ করেই আবার ইরান ও পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক উত্তপ্ত হচ্ছে, কেননা ইরান থেকে বড় ধরণের একটি সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে যে তাদের শীর্ষ নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্টকে হত্যা করা হয়েছে। ২৭ শে নভেম্বর রাত থেকেই এর নিশ্চয়তা দিয়ে ইরানের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম খবর প্রচার করতে থাকে। কিন্তু এর পরপরই ইরান ইজরায়েল ও ইউএসএর বিরুদ্ধে অভিযোগ আরোপ করে যে, হত্যাকাণ্ডে ঐ দুই দেশের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে।
অনেকের মনে থাকতে পারে গত জানুয়ারি মাসে ইরানে আরও একটি হত্যাকাণ্ড ঘটে। ইরানের জেনারেল কাশেম সুলেমানী আমেরিকার ড্রোন হামলায় নিহত হলে ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তখন বেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তখন থেকে এখন পর্যন্ত ইরান ও আমেরিকা বিভিন্ন ইস্যুতে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ উত্থাপন করে আসছিল। কিছু স্ট্রাটেজিক অ্যাফেয়ার্সের এক্সপার্টদের মতে, কাশেম সোলামানীর চাইতেও বিজ্ঞানীর হত্যাকাণ্ডটি আরও বড় করে দেখা হবে কারণ তিনি ছিলেন এমন একজন বিজ্ঞানী যিনি ইরানের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামকে সরাসরি তদারকি করতেন।
গত পাঁচ বছর ধরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সম্পর্ক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বারাক ওবামা। সেই বছর তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সই করেন। চুক্তির নাম জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব একশন 2015, সংক্ষেপে JCPOA Accord; এই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ইরানের উপরে যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল সেগুলো ধীরে ধীরে তুলে ফেলবে কারণ ঐ বিধিনিষেধের ফলে ইরানের অর্থনীতি অনেকটাই পঙ্গু হয়ে যায় এবং তাদের তেল রপ্তানি প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। বিনিময়ে ইরানকে এই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, তারা তাদের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামিং ২০২৫ সাল পর্যন্ত সীমিত করবে। ২০১৬ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ নেন, শপথ নিয়ে তিনি মাত্র দুই বছরের মাঝে যে বিতর্কিত সিদ্ধন্তগুলো নিয়েছিলেন তার মাঝে একটি হ’ল, JCPOA চুক্তি থেকে আমেরিকাকে বের করে নিয়ে আসেন এবং এও বলেন, ‘এটা আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ চুক্তি।’
ঐ ঘটনার পর দুইটি বড় ঘটনা ঘটে। প্রথমত, ৩ জানুয়ারি ২০২০ সালে অর্থাৎ চলতি বছরের শুরুতে ইরাকের বাগদাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইরানের জেনারেল কাশেম সোলেমানীকে হত্যা করা হয় ইউএস ড্রোন দ্বারা। দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক ইরানের শীর্ষস্থানীয় নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্টকে অ্যামবুশে হত্যা করা হয়। তাহলে কে ছিলেন সেই বিজ্ঞানী? কেন তিনি এত গুরুত্বপূর্ণ যে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম ঢালাউ করে তা প্রচার করছে?
তার নাম মোহসেন ফাখরিজাদে। তিনি ইরানের মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্সের হেড অব রিসার্চ ইনোভেশন। এবং ধারণা করা করা হয় দেশের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামিংয়ে তার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া তাকে নিয়ে আলোচনা বহু সংবাদ মাধ্যম ও রাজনীতিবিদেরা অনেকবার করেছেন। ২০১৫ তে নিউ ইয়র্ক টাইমস তার তুলনা করেছিল জে. রবার্ট অপেনহাইমারের সাথে। অপেনহাইমার বিশ্ব ইতিহাসে খুবই পরিচিত একটি নাম। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এটমিক বোমা প্রস্তুতের জন্য ম্যানহাটন প্রোজেক্ট পরিচালনাকারী পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন। এমনকি ২০১৮ সালে কিছু ইজরায়েলি গোপন নথিপত্র প্রকাশ পায় যেখানে উল্লেখ ছিল, মোহসেন ফাখরিজাদে নিউক্লিয়ার ওয়েপন তৈরির জন্য একটি প্রজেক্টের নির্দেশনা দিচ্ছেন। তবে সবচেয়ে বড় বোমটা ফাটিয়েছেন খুব সম্ভবত ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। তিনিও ২০১৮ এর একটি প্রেজেন্টেশনে বলেন, ‘প্রজেক্ট আমাদ ড. মোহসেন ফাখরিজাদের দ্বারা শুরু হয়, এবং ইরানের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের মূল চাবিকাঠি যাদের হাতে আছে তারা সবাই তার নিচে কাজ করেন।’ (চিত্র-২)
ঐ প্রেজেন্টেশনের একটি খুবই আগ্রহ সৃষ্টিকারী বিষয় হ’ল, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু খুবই নাটকীয় পদ্ধতিতে বলেন, ‘মোহসেন ফাখরিজাদে, এই নামটা মনে রাখবেন।’ অতএব দেখা যাচ্ছে, ইজরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের মতে বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদে ইরানের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম নিয়ন্ত্রণ করছেন। কিন্তু ইরানের দাবী সম্পূর্ণ আলাদা। তারা বলছে, ‘ফাখরিজাদে একটি এয়ার ডিফেন্স প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছিলেন, যা রেডার সিস্টেম ব্যাবহার না করেই স্পাই এয়ারক্রাফট সনাক্ত করতে পারবে। এবং ইজরায়েল খুব ভালো করেই জানে তিনি এমন কিছুর সাথে জড়িত ছিলেন না যা ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যায়।’ কিন্তু তাদেরই এক্সিওস নামের সবচেয়ে প্রভাবশালী একটি সংবাদ সংস্থার দাবী তিনি একজন নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট ছিলেন। তারা রিপোর্ট করে ‘Iran confirm assassination of top nuclear scientist Mohsen Fakhrizadhe’ (1) তারা স্থানীয় তাসনিম নিউজের বরাত দিয়ে বলে, ইরানের উত্তরে অবস্থিত রাজধানী তেহরান থেকে ৬০ কিলোমিটার পূর্বে ইসলামিক আজাদ ইউনিভার্সিটির দামাবন্দ ক্যাম্পাসে তিনি হামলার শিকার হোন। আহত আবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
সংবাদটি ছড়িয়ে পড়লে ইরানের সবকটি অফিশিয়াল এটি নিয়ে উস্কানিমূলক বিবৃতি দিতে থাকে। ইরানের ফরেন অ্যাফেয়ার মিনিস্টার জাওয়াদ জরিফ টুইট করেন, Terrorists murdered an eminent Iranian scientist today. This cowardice– with serious indication of Israel role– shows desperate warmongering of perpetrators. Iran also call an International community and especially EU to end their shameful double standards and condemned this act of state terror.’
তাছাড়া ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আমির হাতামি জাতীয় টেলিভিশনে বলেছেন, ‘The killing was clearly linked to the US assassination of General Qassem Soleimani by drone in January.’
এই ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন কোণা থেকে, বিভিন্ন বিভাগ থেকে প্রতিশোধের আহ্বান শোনা যাচ্ছে। গবেষকদের মতে কাশেম সোলেমানির হত্যার পর জনগণের মাঝে যে ক্ষোভ দেখা গিয়েছিল একই রকম ক্ষোভ আবার দেখা দিতে পারে। তখন সোলেমানিকে হত্যার কিছু পরেই ইরান মার্কিন সেনাদের উপরে গুলিবর্ষণ করে, মিসাইল দ্বারা ইরাকে মার্কিন ঘাটিতে হামলা চালায়। এমনকি, অন্ধের মতো বোমা মেরে নিজেদের বেসামরিক বোয়িং ভূপাতিত পর্যন্ত করে ফেলে। মার্কিন সেনারা অক্ষত থাকলেও বহু ইরানি নাগরিক নিহত হয়। তেমন কিছু ঘটার সম্ভাবনা এবারও আছে, ইরান ছেড়ে কথা বলবে না তা বোঝাই যাচ্ছে।
ইরানের মন্ত্রীরা ছাড়াও আরও কিছু অফিশিয়াল ড. ফাখরিজাদের হত্যাকে ইস্যু বানিয়ে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরণেরই বিবৃতি দিচ্ছে। ইরানের আর্মড ফোর্সের চীফ মেজর জেনারেল মোহাম্মেদ বাঘেরি বলেছেন, তারা এর প্রতিশোধ নিবেনই। এছাড়া ইরানে অবিস্থিত জাতিসংঘের এম্বাসেডর মাজিদ তখতে রাবাঞ্চি বলেছেন, তারা যেন এমন কোন পদক্ষেপ না নিয়ে বসে যাতে আমেরিকা-ইজরায়েলের সাথে তাদের সম্পর্ক আরও খারাপ হয়। তিনি আরও বলেন, এখন আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল ট্রানজেকশন চলছে, অর্থাৎ ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারিয়ে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। কিন্তু তিনি এখনও প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেননি। এক দুই মাসের মধ্যে তিনি শপথ নিয়ে নেবেন, তখন তিনি পুরোপুরি প্রেসিডেন্ট হয়ে যাবেন ততদিন পর্যন্ত আমেরিকায় ট্রানজেকশন চলা অবস্থায় পরিস্থিতি সেখানেও অতটা স্থির না। কাজেই তারা যেন অপেক্ষা করে।
ইরান ইজরায়েল ও আমেরিকার প্রতি সরাসরি অভিযোগ আরোপ করেছে কিন্তু এটা বলা যাবে না তারা প্রমাণ ছাড়া বা হুট করেই করে বসেছে। ইরানের সংবাদ সংস্থা এক্সিওস ড. মোহসেন ফাখরিজাদের উপরে হামলা হওয়ার ঠিক দুই দিন পূর্বে অর্থাৎ ২৫ শে নভেম্বর তারা রিপোর্ট করে: “Scoop: Israeli military prepares for possibility Trump will strike Iran.” (2)
অর্থাৎ এক্সিওস দাবী করছে, ইজরায়েলের সেনাবাহিনী এ ধরণের একটা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে ট্রস্পের ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই। ট্রাম্পের আর এক থেকে দেড় মাসের সময় রয়েছে, সেই সময়কেই উদ্দেশ্য করে এক্সিওস এই সংবাদটি বানিয়েছে। এটাকে ইরানেরই ষড়যন্ত্র বলে যেকোনো তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব তবে ইরানের মিডিয়া এজেন্সিগুলো মনে করে, হত্যাকাণ্ড এমন স্পর্শকাতর সময়ে ঘটল যখন ট্রাম্প তার লাটাইয়ের সুতা গুটিয়ে নিচ্ছেন। আবার ওদিকে জো বাইডেন ইতোমধ্যে বলেই দিয়েছেন, ‘আমরা কোন না কোন ভাবে ইরানের সাথে আমাদের সম্পর্ক ঠিক করতে পারি কিন্তু যাওয়ার আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন কিছু করে না বসেন যাতে সেই সুযোগ আমাদের হাত ফসকে যায়।” (3)
এই সমস্ত কারণেই ইরান মনে করে এই হামলার পিছনে ইজরায়েল ও আমেরিকার সরাসরি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, কেননা পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ইরান ও আমেরিকার দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটালেও ঘটাতে পারতেন। অপরদিকে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, আমেরিকার অফিশিয়াল ও সিআইএ এখন পর্যন্ত কোন প্রকার বিবৃতি ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। তাই মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি এখন বেশ খানিকটা অস্থির। শুধু ইরান ও আমেরিকার বিরুদ্ধে না, ইরান ও ইজরায়েলের মাঝেও দ্বন্দ্ব এখন চরমে উঠেছে। কিন্তু কোথাকার জল কোথায় গড়ায় সেটাই দেখার বিষয়।
তথ্যসূত্র :
- Iran confirms assassination of top nuclear scientist Mohsen Fakhrizadhe
- Scoop: Israeli military prepares for possibility Trump will strike Iran
- Iran Hopes for a Change in ‘Destructive U.S. Policies’ After Biden Win
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত সকল মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ