নানা চড়াই উৎড়াই পেড়িয়ে উনবিংশ শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে মানুষের কাঙ্খিত মহাকাশ যাত্রা সফলতার মুখ দেখে। পৃথিবীর বাইরের জগৎ অন্বেষণের জন্য মহাকাশযুগের সূচনার পর থেকে আমরা প্রতিনিয়ত পৃথিবীর কক্ষপথে মহাকাশ অভিযান পরিচালনা করছি। বিভিন্ন কক্ষপথের উদ্দেশ্য হাজার হাজার রকেট, কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করছি। কিন্তু নির্দিষ্ট কাজ করার জন্য এসব মহাকাশযান ও উপগ্রহগুলো তাদের কাজ সম্পাদন করে সেখানেই থেকে যাচ্ছে। মৃত বা বিকল হলে পড়ে আছে পৃথিবীর কক্ষপথে। এসব মৃত উপগ্রহ, রকেট বা তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ কক্ষপথে আবর্জনার সৃষ্টি করছে। যা বর্তমানে উপকারের থেকে ক্ষতিই বেশি করছে। হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে সমস্ত মহাকাশ ব্যবস্থাপনাকে। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন স্পেস জাঙ্ক বা মহাকাশ আবর্জনা।
বিজ্ঞানীদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মহাকাশ বর্জ্য। এগুলো পুনর্ব্যবহার করতে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা চলছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এবার মহাকাশে রকেটের জ্বালানি তৈরির সম্ভাবনার কথা বলছে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিষ্ঠান নিউম্যান স্পেস। মহাকাশের এই বর্জ্য সরাতে ইতিমধ্যে মহাকাশে গ্যাসস্টেশনের কথা ভাবতে শুরু করেছেন বিজ্ঞানীরা।
দ্য গার্ডিয়ান-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পৃথিবীর কক্ষপথে পুরোনো মহাকাশযানের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এ ছাড়া অব্যবহৃত কৃত্রিম উপগ্রহ ও রকেটের বিভিন্ন অংশ ঘণ্টায় ২৮ হাজার কিলোমিটার গতিতে ছুটে চলেছে। এগুলো কৃত্রিম উপগ্রহ ও আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের জন্য ঝুঁকি। এ গতিতে ছুটতে থাকা সামান্য একটি স্ক্রুও আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন বা নভোচারীদের জন্য হুমকি হতে পারে।
গত সপ্তাহে রাশিয়া একটি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করে নিজেদের কৃত্রিম উপগ্রহ ধ্বংস করেছে। সেখান থেকেও বর্জ্য ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, এ বর্জ্য মহাকাশে সবার স্বার্থকে হুমকির মুখে ফেলেছে। পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেলে কক্ষপথ ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে উঠবে।
নিউম্যান স্পেস বলছে, তারা মহাকাশে ‘বৈদ্যুতিক প্রপালশন সিস্টেম’ তৈরি করবে। প্রপালশন সিস্টেম হচ্ছে এমন একটি যন্ত্র, যা বস্তুকে সামনের দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য শক্তি জোগায়। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে মহাকাশ মিশন দীর্ঘায়িত করার পাশাপাশি কৃত্রিম উপগ্রহকে কক্ষচ্যুত করা যাবে।
এই প্রপালশন সিস্টেমের জন্য জ্বালানি হিসেবে মহাকাশে পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশকে গ্যাসে পরিণত করার পরিকল্পনা করেছে নিউম্যান স্পেস। এ লক্ষ্যে আরও তিনটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছে তারা।
এরই মধ্যে স্যাটেলাইটের সাহায্যে কীভাবে মহাকাশে পরিত্যক্ত বস্তু ধরা যায়, তা দেখিয়েছে জাপানের স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রোস্কেল।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ন্যানোরকস্ এসব ধ্বংসাবশেষকে কক্ষপথেই কেটে-ছেঁটে ছোট ছোট টুকরা করে সংরক্ষণ বা এক জায়গায় মজুতের পরিকল্পনা করছে। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে অত্যাধুনিক রোবট ব্যবহার করছে তারা।
যুক্তরাষ্ট্রেরই আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিজলুনার মহাকাশে ঘুরে বেড়ানো পরিত্যক্ত ধ্বংসাবশেষকে গলিয়ে ধাতব রড তৈরির চেষ্টা করছে। এই ধাতব রডগুলোকেই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করবে নিউম্যান স্পেসের প্রোপালশন সিস্টেম।
নিউম্যান স্পেসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হার্ভে অ্যাস্টায়ার জানান, ইতিমধ্যে প্রকল্পটি শুরু করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার মঞ্জুরি পেয়েছেন তারা।
মহাকাশে কোনো বস্তু পাঠানো হলে তা যদি কক্ষচ্যুত না হয় বা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুড়ে না যায়, তবে সেখানে চিরকাল তা থেকে যাবে। মহাকাশে বর্জ্য সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চুম্বক পদ্ধতি থেকে শুরু করে নানা পদ্ধতিতে তা সরাতে কাজ শুরু করেছেন।
বিজ্ঞানীদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মহাকাশ বর্জ্য। এগুলো পুনর্ব্যবহার করতে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা চলছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এবার মহাকাশে রকেটের জ্বালানি তৈরির সম্ভাবনার কথা বলছে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিষ্ঠান নিউম্যান স্পেস। মহাকাশের এই বর্জ্য সরাতে ইতিমধ্যে মহাকাশে গ্যাসস্টেশনের কথা ভাবতে শুরু করেছেন বিজ্ঞানীরা।
সেবার অ্যাস্ট্রোনাটিকস নামের একটি প্রতিষ্ঠান মহাকাশে পাল ব্যবহার করে বর্জ্য ধরে আনার জন্য নাসার অনুদান পেয়েছে। সিডনির ইলেকট্রো অপটিকস সিস্টেমে ক্যানবেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মিলে লেজার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন, যাতে বর্জ্যের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়ানো যায়। তবে বর্জ্য ধ্বংস করে না ফেলে তা রিসাইক্লিং করার বিষয়টি নতুন পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অ্যাস্টায়ার বলেন, ‘এটা এখনো ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি। তবে সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। অনেক মানুষ এখন মহাকাশ বর্জ্যে বিনিয়োগ করছে। বর্জ্য সংগ্রহ করে তা কাজে লাগানো গেলে ব্যবসার দৃষ্টিকোণ থেকে তা সম্ভাবনাময়। কারণ, সেখানে জ্বালানি পাঠাতে হচ্ছে না। এটা মহাকাশে গ্যাসস্টেশন তৈরির মতো বিষয়।’
পৃথিবীর কক্ষপথ ক্রমেই হাজার হাজার স্যাটেলাইট দ্বারা পূর্ণ হয়ে উঠছে এবং প্রতিনিয়তই আরও নতুন নতুন স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনের পরিকল্পনা চলছে। কিন্তু মহাকাশে থাকা পুরোনো রকেটের বিভিন্ন অংশ কিংবা কৃত্রিম উপগ্রহের বিভিন্ন ভগ্নাংশ প্রবল বেগে অনিয়ন্ত্রিতভাবে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। রকেট বা স্যাটেলাইটের সঙ্গে এসব মহাকাশ বর্জ্যের সংঘর্ষের সম্ভাবনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কৃত্রিম উপগ্রহ বা রকেটের বড় বড় ধ্বংসাবশেষ ছাড়াও ছোট ছোট নাট-বল্টুর মতো বিপুল পরিমাণ বর্জ্য ঘিরে আছে আমাদের পৃথিবীকে।
মহাকাশের বর্জ্য সমস্যা পর্যবেক্ষণ ও সমাধান করতে Orbital Debris Program Office – বা ODPO – নামে NASA – র একটি বিশেষ শাখা রয়েছে। তাদের পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়, টেনিস বলের মতো প্রায় বিশ হাজার বর্জ্য পৃথিবীর আশেপাশে ঘুরছে। এসব বর্জ্যের গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় আটাশ হাজার কিলোমিটার। এছাড়া প্রায় পাঁচ লক্ষ মারবেলের সমান এবং দশ কোটিরও বেশি অতি ক্ষুদ্র আবর্জনা রয়েছে মহাকাশে। পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে থাকা আবর্জনার মধ্যে যেগুলোর আকার প্রায় ১০ সে.মি. ও তার বেশি সেগুলোকে শনাক্ত করছে যুক্তরাষ্ট্রের– US Space Surveillance Network। মহাকাশ নিরাপত্তার স্বার্থে অপেক্ষাকৃত বড় আকারের আবর্জনার অবস্থান পর্যবেক্ষণ করা হলেও অতিক্ষুদ্র অনেক বর্জ্য রয়েছে যাদেরকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। শুধু বর্জ্যই নয়, ক্রমবর্ধমান কৃত্রিম উপগ্রহও আমাদেন পৃথিবীর চারপাশের মহাকাশকে বিপজ্জনক করে তুলেছে।
সম্প্রতি, রাশিয়ার উৎক্ষেপিত একটি উপগ্রহের ওপরে সেই ক্ষেপণাস্ত্রেরই পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করে রসকসমস। তবে উপকারের বদলে তার পরিণতি হল ভয়ঙ্কর। বলা যায়, হিতে বিপরীত। মিশাইলের আঘাতে শূন্যে ভেসে থাকা উপগ্রহটি টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা মহাকাশে। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি দৃশ্যমান খণ্ডে বিভক্ত হয়ে গেছে সংশ্লিষ্ট উপগ্রহটি। তাছাড়াও তৈরি হয়েছে কয়েক লক্ষ ধূলিকণা। যে কণাগুলি মহাকাশচারীর স্পেসস্যুটকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পক্ষে যথেষ্ট। অন্যদিকে দৃশ্যমান বড়ো টুকরোগুলি পৃথিবীকে প্রদক্ষিণরত অন্যান্য উপগ্রহ তো বটেই, এমনকি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনকেও রীতিমতো ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
কয়েকদিন আগেই বড়োসড় ফাটল লক্ষ করা গিয়েছিল আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে। সেই ফাটল সম্পূর্ণভাবে মেরামত করা সম্ভব নয় বলেই জানিয়েছিলেন গবেষকরা। তার ওপরে এই ধরনের মহাকাশ বর্জ্যের সামান্যতম আঘাতও বড়ো বিপত্তি ডেকে আনতে পারে, এমনটাই অভিমত বিজ্ঞানীদের। তাছাড়াও এই ধরনের বর্জ্যের কারণে বিঘ্ন ঘটতে পারে আবহাওয়ার পূর্বাভাস নির্ণয়, টেলিভিশন সম্প্রচার, মোবাইল নেটওয়ার্ক-সহ একাধিক পরিষেবা। কিন্তু তারপরেও এমন একটি পরীক্ষার জন্য অন্যান্য মহাকাশ সংস্থাগুলির সঙ্গে কেন কোনোরকম পূর্ব-আলোচনার পথে হাঁটল না রসকসমস, তা নিয়েই উঠছে প্রশ্ন। রাশিয়ার মহাকাশ সংস্থার এই কর্মকাণ্ডে ইতিমধ্যেই সমালোচনার ঝড় উঠেছে বিশ্বজুড়ে। এর আগে ২০০৭ সালে একই ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছিল চিনও। একের পর এক ভুলের পুনরাবৃত্তির পরেও আদৌ কি কোনো শিক্ষা নেবে মানবসভ্যতা? জানা নেই উত্তর।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৫
আপনার মতামত জানানঃ