মহামারির সঙ্কটের মধ্যে চলতি অর্থবছরের বাজেটে অর্থনীতির মূলস্রোতে অর্থ প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যে আয়কর অধ্যাদেশে দুটি ধারা সংযোজন করা হয়। এতে ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। সেই সুযোগ নিয়েই কালো টাকা সাদা করতে থাকে অনেকে।
এবারও কালোটাকা সাদা করার সুযোগে সাড়া মিলছে খুব কমই। অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকাকে অর্থনীতির মূল ধারায় আনতে ও দেশে বিনিয়োগ চাঙা করতে চলতি অর্থবছরে যে সুযোগ দিয়েছে সরকার, তাতে দেখা গেছে, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মাত্র ১২২ জন টাকা বৈধ করেছেন। তারা মাত্র ১৫ কোটি টাকা সাদা করেছেন। এর বিপরীতে সরকার কর পেয়েছে ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
অর্থনীতিবিদ ও রাজস্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের কঠোর শর্তের কারণে সাড়া মিলছে না তেমন। উচ্চ হারে কর আরোপের কারণে এ সুযোগ নেয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না করদাতারা।
এবার যে কয়েকটি খাতে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়, তার অন্যতম হচ্ছে শেয়ারবাজার।
এনবিআরের হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে শেয়ারবাজারে মাত্র একজন ৩০ লাখ টাকা সাদা করেছেন। এর বিনিময়ে সরকারি কোষাগারে কর হিসেবে জমা হয়েছে ১ লাখ টাকা।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে শেয়ারবাজারসহ বিভিন্ন খাতে প্রযোজ্য কর হার এবং তার সঙ্গে ‘অতিরিক্ত’ ৫ শতাংশ জরিমানা দিয়ে টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। কেউ এই শর্ত মেনে সরকারের দেওয়া এ সুযোগ গ্রহণ করলে এনবিআরসহ অন্য কোনও গোয়েন্দা সংস্থা তার আয়ের উৎস সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন করবে না।
এর আগের অর্থবছরে শেয়ারবাজার, নগদ টাকা, ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা, সঞ্চয়পত্র, জমি ক্রয়ে শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে ঢালাওভাবে কালোটাকা বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ নতুন নিয়মে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বহাল রাখা হলেও শর্ত কঠোর করা হয়েছে।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, আগের বছর প্রায় ১২ হাজার জন সাদা করেছেন ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ঘোষিত টাকা থেকে সরকার কর পেয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদ ও রাজস্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের কঠোর শর্তের কারণে সাড়া মিলছে না তেমন। উচ্চ হারে কর আরোপের কারণে এ সুযোগ নেয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না করদাতারা।
এবারের বাজেটের বাইরে আরও তিনটি খাতে (আগে থেকেই) কালোটাকা বৈধ করার সুযোগ বহাল রয়েছে: সেগুলো হলো ১০ শতাংশ কর দিয়ে হাইটেক পার্কে বিনিয়োগ করলে আয়ের উৎস সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন করা হবে না। রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে বিনিয়োগে একই সুবিধা দেওয়া রয়েছে। এ ছাড়া সিটি ও পৌর করপোরেশনের মধ্যে এলাকাভেদে ফ্ল্যাটে প্রতি বর্গমিটারে নির্ধারিত কর দিয়ে টাকা বৈধ করা যায়।
ঢালাওভাবে সুযোগ দেয়ার পরও গতবার তেমন সাড়া মেলেনি শেয়ারবাজারে। মাত্র ২৮৬ জন সাদা করেছিলেন গতবার। আর সাদা হয়েছিল ৪০০ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘ঢালাওভাবে সুযোগ দেয়া ঠিক না। এটা করা হলে যারা নিয়মিত কিংবা সৎ করদাতা, তাদের প্রতি অবিচার করা হয়। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে জরিমানার বিধান রেখে সুযোগ দেয়া হয়।’
অর্থনীতিবিদরা বলেন, বিদ্যমান নিয়মে কালোটাকা সাদা করতে হলে একজন করদাতাকে প্রায় ২৭ শতাংশ পর্যন্ত কর পরিশোধ করতে হবে। এই হার অত্যন্ত বেশি। এত বেশি উচ্চ হারে কর দিয়ে টাকা বৈধ করতে অনেকেই নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে প্রত্যাশিত সাড়া মিলছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া সৎ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অন্যায়ের শামিল। তবে এই টাকাটা দেশের ভেতরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। আবাসন খাতসহ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হচ্ছে। শেয়ারবাজারে এখন দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে বলে মনে করেন তারা। বলেন, ২০০৯ সালেও এ রকম হয়েছিল, পরে বাজার ধপাস করে পড়ে যায়।
তারা বলেন, কালো টাকার চক্র আছে। মাদক, অস্ত্র, রিয়েল এস্টেট ব্যবসাসহ নানা ক্ষেত্রে এ চক্র সক্রিয়। রাজনীতিতে নীতির ঘাটতির কারণে চক্রটি শক্তিশালী। জমি, প্লট, ফ্ল্যাটের মতো কালো টাকার উৎসেই আবার তা বিনিয়োগ করে সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এই নীতি থেকে বের না হলে কালো টাকার উৎস বন্ধ হবে না।
তারা আরও বলেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ মৌলিক অধিকার এবং সুশাসনের পরিপন্থি। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে দক্ষ রাজস্ব প্রশাসন দরকার। পাশাপাশি অন্যান্য খাতেও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। প্রথমে কালো টাকা ও অপ্রদর্শিত আয়ের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট করতে হবে। অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ বাড়ানো সম্ভব নয়।
তারা বলেন, হুন্ডি ও বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে কালোটাকা সাদা হচ্ছে। দুদক, এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এর জন্য দায়ী। কালোটাকা প্রতিরোধের সবচেয়ে টেকসই উপায় হিসেবে তারা বলেন, এনবিআরকে শক্তিশালী করতে হবে। সে জন্য দরকার বিনিয়োগ। কিন্তু কোনো সরকারই এ খাতে বিশেষ নজর দেয়নি। উন্নয়ন যা হয়েছে, তা দাতাদের জোরাজুরিতে। সরকারের তাতে বিশেষ অংশগ্রহণ নেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ