দেশের বাজারে মার্কিন ডলারের সংকটের কারণে হু হু করে বাড়ছে দাম। বিক্রি করেও ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সোমবার (২৩ মে) প্রতি মার্কিন ডলারের দাম ৪০ পয়সা বাড়িয়ে পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে এক দিনেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরও ৪০ পয়সা কমে গেল।
এ নিয়ে চলতি মে মাসেই তৃতীয়বারের মতো কমানো হলো এই মান। তিন দফায় ডলারের দাম বাড়ল ১ টাকা ৪৫ পয়সা।
এখন থেকে ব্যাংক চ্যানেলে ডলারের দাম ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা ঠিক করে দেয়া হয়েছে। তবে ব্যাংকগুলোকে ৮৮ টাকায় আমদানি বিল আদায়ের সুযোগ দেয়া হয়েছে।
যদিও ৯৫ টাকার নিচে এখনো ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। কেননা ডলারের সংকট কাটেনি।
এ নিয়ে চলতি বছর ষষ্ঠবারের মতো বাড়ল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মুদ্রাটির মান। অর্থাৎ ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমল ছয় দফা।
গত জানুয়ারির শুরুতে ডলারের বিনিময় মূল্য ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২৩ মার্চ তা আবার ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সা করা হয়। গত ২৭ এপ্রিল বাড়ানো হয় আরও ২৫ পয়সা। তখন ১ ডলারের বিনিময় মূল্য দাঁড়ায় ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা। ৯ মে ডলারের বিনিময় মূল্য ২৫ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়।
এরপর গত ১৬ মে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক দিনে সবচেয়ে বড় অবমূল্যায়ন করা হয় টাকার। সেদিন টাকার মান ৮০ পয়সা কমিয়ে ডলারের বিপরীতে করা হয় ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা।
অবশ্য খোলা বাজারে ডলার কিনতে গেলে এর চেয়ে অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। সম্প্রতি তা ইতিহাসের রেকর্ড ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। টাকার মান আরও কমবে— এমন ধারণা ছড়িয়ে পড়ার পর ১০৪ টাকাতেও ডলারে কেনার ঘটনাও প্রকাশ পায়।
তবে মুনাফা করার আশায় গুড়েবালি হয়েছে। বিদেশযাত্রায় সরকার লাগাম পরানোর পর খোলা বাজারে ডলারের চাহিদা কিছুটা কমায় দামও কমে ৯০-এর ঘরে চলে এসেছে।
মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ডলার কিনতে সোমবার ৯৮ দশমিক ২০ টাকা গুনতে হয়েছে ক্রেতাদের। এর আগে গত ১৭ মে খোলা বাজারে ডলারের দাম ১০২ টাকায় উঠেছিল।
দাম বাড়ানোর পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক বিপুল পরিমাণ ডলার বিক্রিও করেছে। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ৫৫০ কোটি ডলার বাজারে ছেড়েছে তারা।
এ রকম পরিস্থিতিতে আয় বাড়াতে এবার বিদেশ থেকে ডলার আনার প্রক্রিয়া উদার করে দিয়েছে সরকার। ফলে প্রবাসী আয় বাবদ দেশে যত পরিমাণ ডলার পাঠানো হোক না কেন, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবে না এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো। আবার এর বিপরীতে আড়াই শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনাও দেওয়া হবে।
এর আগে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার বা পাঁচ লাখ টাকার বেশি আয় পাঠাতে আয়ের নথিপত্র জমা দিতে হতো। যে কারণে এর চেয়ে বেশি অর্থ একবারে পাঠাতে পারতেন না বিদেশে থাকা বাংলাদেশিরা। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে বিদেশ থেকে তাদের অবাধে টাকা আনতে আর কোনো বাধা থাকবে না। এ নিয়ে বিদেশেও কেউ প্রশ্ন করবে না, আর দেশে তো করবেই না। সরকারের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল সোমবার এ ব্যাপারে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পাঁচ হাজার ডলার অথবা পাঁচ লাখ টাকার বেশি প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে প্রণোদনা প্রদানে রেমিটারের কাগজপত্র বিদেশের এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে প্রেরণের বাধ্যবাধকতা আছে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বৈধ উপায়ে দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণের বিপরীতে রেমিট্যান্স প্রণোদনা প্রদানে রেমিটারের কাগজপত্র ছাড়াই আড়াই শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা প্রযোজ্য হবে। গতকাল থেকেই এ নির্দেশনা কার্যকর হয়েছে।
১২ মে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, ‘দেশ থেকে যেসব টাকা দেশের বাইরে চলে গেছে (পাচার হয়েছে), তা আবার ফেরত আসবে। বিদেশে টাকা রাখলে লাভের বদলে ব্যাংকগুলোকে সার্ভিস চার্জ বাবদ টাকা দিতে হয়। এতে লাভের চেয়ে লোকসান বেশি হয়।’ এরপরই গতকাল সরকারি সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর ফলে দেশে প্রবাসী আয় বাড়বে। কিন্তু প্রকৃত উপকার পাবেন দুর্নীতিবাজ আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ। তারা অবৈধ টাকা বিদেশে পাঠিয়ে বৈধ চ্যানেলে তা দেশে নিয়ে আসবেন। এতে তাদের কালোটাকা সাদা হয়ে যাবে।
ডলারের দাম আরও বাড়ায় রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা লাভবান হবেন। অন্যদিকে আমদানিকারকদের খরচ বাড়বে। আর আমদানি খরচ বাড়া মানে ভোক্তাদের একই পণ্যের জন্য আরও বেশি খরচ করা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে ব্যাপক হারে আমদানির চাপ বেড়েছে। ফলে আমদানির দায় পরিশোধে বাড়তি ডলার লাগছে। কিন্তু সেই তুলনায় রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়েনি। ফলে ব্যাংক ব্যবস্থায় ও খোলাবাজারে মার্কিন ডলারের ওপর চাপ বাড়ছে। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ কারণে টাকার বিপরীতে বাড়ছে ডলারের দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যাংকগুলোর চাহিদার বিপরীতে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ডলারের দাম পুনঃনির্ধারণ করে ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা করা হয়েছে। বিশ্ব বাজারে জ্বালানিসহ অন্যান্য দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও দেশের আমদানির চাপ বেড়ে যাওয়ায় ডলারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, বাজারের পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সরবরাহ করছে। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর কাছে ৫ দশমিক ৬ বিলিয়নের বেশি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। যখনই প্রয়োজন হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার সরবরাহ করছে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০ সালের জুলাই থেকে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু এরপর থেকে বড় ধরনের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়ে ডলার সংকট শুরু হয়, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে।
২০২১ সালের আগস্টের শুরুতেও আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলারের মূল্য একই ছিল। ৩ আগস্ট থেকে দু-এক পয়সা করে বাড়তে বাড়তে গত বছরের ২২ আগস্ট প্রথমবারের মতো ৮৫ টাকা ছাড়ায়। এ বছরের ৯ জানুয়ারি এটি বেড়ে ৮৬ টাকায় পৌঁছে। এরপর ২২ মার্চ পর্যন্ত এ দরেই স্থির ছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে আমদানি দায় শোধ করা যাচ্ছে না। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্য, জ্বালানি, মূলধনি যন্ত্র ও কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে জাহাজভাড়াও। এতে সংকট হয়েছে ডলারের। বেড়ে গেছে ডলারের দামও। যার প্রভাব পড়েছে খাদ্যপণ্যের দামে। চাপে পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি।
সংকট কাটাতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ সফর বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। আর ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি গাড়ি ও ইলেকট্রনিকস ব্যবহার্য পণ্য আমদানিতে ৭০ শতাংশ টাকা জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। পাশাপাশি বিলাসপণ্য আমদানি বন্ধের চিন্তাভাবনা চলছে সরকারি পর্যায়ে। ইতিমধ্যে ডলারসংকট কাটাতে গাড়ি, মুঠোফোন, সিগারেটসহ ৩৮ পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করেছে পাকিস্তান।
এটি অবশ্য কেবল বাংলাদেশের চিত্র নয়। করোনা পরিস্থিতির উন্নতির পর আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য ক্রমেই বেড়ে চলার পরিপ্রেক্ষিতে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে দেশে দেশে। ডলারের টান পড়ায় দেশে দেশেই মুদ্রার মান কমছে।
প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে মুদ্রার মান বরং কমেছে সবচেয়ে কম হারে। ভারতের মুদ্রার মান কমেছে বাংলাদেশের দ্বিগুণ হারে। আর পাকিস্তানে কমেছে বাংলাদেশের প্রায় ১০ গুণ হারে। মিয়ানমারে কমেছে পাঁচ গুণ হারে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘এর ফলে দেশে প্রবাসী আয় বাড়বে। কিন্তু প্রকৃত উপকার পাবেন দুর্নীতিবাজ আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ। তারা অবৈধ টাকা বিদেশে পাঠিয়ে বৈধ চ্যানেলে তা দেশে নিয়ে আসবেন। এতে তাদের কালোটাকা সাদা হয়ে যাবে। তবে সংকট কাটাতে এই অর্থ দেশের জন্য উপকারে আসবে। কারণ, ডলারের ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছে, তা কাটাতে ডলার প্রয়োজন।’
আপনার মতামত জানানঃ