করোনা মহামারিতে বিশ্বে বিপর্যস্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত একটি। করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর পাশাপাশি লকডাউনের কারণে নাজেহাল অবস্থায় রয়েছে দেশটি। এরইমধ্যে জলবায়ু সংকটের কবলে পড়েছে দেশটি। একদিকে বায়ুদূষণ এবং বায়ুদূষণের ফলে দৃষ্টিসীমা কমে আসা, দূষণে শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের সমস্যা, অন্যদিকে ভারী বর্ষণ ও বন্যা।
ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে ভারী বর্ষণ থেকে সৃষ্ট বন্যায় ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। বন্যার পানিতে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ রয়েছেন আরও শতাধিক মানুষ। তীর্থস্থান তিরুপতিতে পানিবন্দী রয়েছেন কয়েকশ পুণ্যার্থী। ভারতীয় বিমানবাহিনী, এসডিআরএফ ও দমকলের কর্মীরা সম্মিলিতভাবে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছেন।
ভয়াবহ বন্যায় মন্দিরের শহর তিরুপতিতে কয়েকশ তীর্থযাত্রী আটকাও পড়েছেন বলে একাধিক ছবি ও ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে।
এনডিটিভি জানিয়েছে, দুর্যোগকালীন পরিস্থিতির কারণে তিরুমালা পাহাড়ে যাওয়ার ঘাট সড়ক ও অন্যান্য পায়ে হাঁটার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই পাহাড়েই বিখ্যাত ভেঙ্কটেশ মন্দিরের অবস্থান।
তিরুপতির উপকণ্ঠে স্বর্ণমুখী নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে; জলাধারগুলোর পানি উপচে পড়ছে।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় জাতীয় ও রাজ্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দলগুলোকে মোতায়েন করা হয়েছে; উদ্ধার অভিযানও চলছে পুরোদমে। বন্যায় অসংখ্য সড়ক ও রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রায়ালাসিমা অঞ্চলেই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর মধ্যে আছে চিতোর, কাড়াপা, কুর্ণল ও অনন্তপুর।
গতকাল শুক্রবার ফ্লাইট চলাচলের জন্য তিরুপতি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে তীর্থস্থান তিরুমালা পাহাড়ের দিকে যাওয়ার দুটি সড়ক এখনো বন্ধ রাখা হয়েছে। তিরুমালা থেকে আলিপিরি যাওয়ার সিঁড়িপথটি বন্যা ও ভূমিধসে প্রচণ্ড রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর তাতে ওই পাহাড়ে ওঠা পুণ্যার্থীরা সেখানে আটকে পড়েছেন। তাদের জন্য বিনা মূল্যে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে তিরুমালা তিরুপতি দেবাসথানামের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী জগন্মোহন রেড্ডি।
পার্শ্ববর্তী অনন্তপুরম জেলায় ভেলদুরথি গ্রামে বন্যার পানিতে আটকে পড়া ১০ ব্যক্তিকে উদ্ধার করেছেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর সদস্যরা। নির্মাণকাজে ব্যবহৃত একটি খননযন্ত্রের ভেতর আটকে পড়েছিলেন তারা। বিমানবাহিনীর সদস্যরা এমআই-১৭ হেলিকপ্টার ব্যবহার করে তাদের উদ্ধার করেন। ওই এলাকায় বন্যার পানিতে আটকে পড়া একটি গাড়ি থেকে চার ব্যক্তিকে উদ্ধারের জন্যই গতকাল ওই খননযন্ত্রকে সেখানে নেওয়া হয়েছিল। তবে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় খননযন্ত্রটি আটকা পড়ে যায়। এতে সেই খননযন্ত্রে আগে থেকে থাকা ৬ জন, উদ্ধার হওয়া ৪ জনসহ ১০ জন আটকে পড়েন। অনন্তপুরম জেলা প্রশাসক ভারতীয় বিমানবাহিনীর কাছে সহায়তার আবেদন জানালে সফলভাবে সে উদ্ধারকাজ সম্পন্ন হয়।
কাড়াপা জেলায় ৩৩টি ত্রাণশিবির খোলা হয়েছে। সেখানে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ১ হাজার ২০০ মানুষকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। আজ শনিবার মুখ্যমন্ত্রী উড়োজাহাজে করে বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে যাবেন বলে জানিয়েছে তার কার্যালয়। সাউথ সেন্ট্রাল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১১টি যাত্রীবাহী ও এক্সপ্রেস ট্রেনের চলাচল বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া ৫টি ট্রেনের চলাচল আংশিক বাতিল এবং ২৭টির চলাচলের পথ পাল্টে দেওয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার থেকে টানা বৃষ্টিতে অন্ধ্রের ছেয়েরু নদীর উপচে পড়া পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে। বন্যায় অন্নময় সেচ প্রকল্পেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
বায়ুদূষণের কারণে দিল্লির বাসিন্দাদের বাড়ছে বায়ু বাহিত রোগ। এর মধ্যে প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে ফুসফুসের সমস্যা। ভারতের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর হিসেবে উঠে আসছে দিল্লির নাম। প্রবল ধোঁয়াশার কারণে দিল্লির কয়েকটি শুক্রবার দৃশ্যমানতা নেমে আসে ৫০ শতাংশে।
বায়ুদূষণের কারণে দিল্লিতে বাড়ছে বায়ু বাহিত রোগ
বায়ুদূষণের কারণে দিল্লির বাসিন্দাদের বাড়ছে বায়ু বাহিত রোগ। এর মধ্যে প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে ফুসফুসের সমস্যা। ভারতের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর হিসেবে উঠে আসছে দিল্লির নাম। প্রবল ধোঁয়াশার কারণে দিল্লির কয়েকটি শুক্রবার দৃশ্যমানতা নেমে আসে ৫০ শতাংশে।
ভারতের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দিল্লির বাতাসে ২.৫ মাইক্রন ঘনত্বের সূক্ষ্ম ধূলিকণার (পিএম ২.৫) বাড়ার কারণে ফুসফুসের সমস্যা বাড়ছে। বাতাসে ভাসমান সাধারণ ১০ মাইক্রন ঘনত্বের ধূলিকণা (পিএম ১০) নাকের ভিতরে রোমে আটকে গেলেও পিএম ২.৫ বা সূক্ষ্ম ধূলিকণা সরাসরি পৌঁছে যেতে পারে ফুসফুস পর্যন্ত।
প্রাথমিক ভাবে বায়ু দূষণের কারণ হিসেবে পড়শি উত্তরপ্রদেশ এবং হরিয়ানার কৃষি জমিতে খড়বিচালি পোড়ানোকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রের দেয়া তথ্য জানাচ্ছে, দিল্লির দূষণের মাত্র ১০ ভাগ হচ্ছে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতে খড়বিচালি পোড়ানো ফলে। যানবাহন, ডিজেল চালিত জেনারেটর এবং শিল্প থেকে বায়ু দূষণের পরিমাণ তার চেয়ে অনেক বেশি।
শীতের গোড়ায় বায়ুদূষণের ফলে বাড়ছে অসুস্থতার ঘটনাও। চোখ জ্বালা, চোখ দিয়ে জল গড়ানো, কাশি-কফের সমস্যার পাশাপাশি শ্বাসনালী ও ফুসফুসে সংক্রমণের ঘটনাও বাড়ছে।
দিল্লি সরকারের পক্ষে দূষণ মোকাবিলায় কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলার কথা বলা হয়েছে শহরবাসীকে। বাইরে বেরলে গলায় স্কার্ফ এবং চোখের জ্বলুনি কমাতে সানগ্লাস পরার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমনকি, ঘরে থাকাকালীনও প্রয়োজন বুঝে মাস্ক পরার কথাও বলা হয়েছে। শিল্প দূষণ কমাতে ইতিমধ্যেই দিল্লির ১১টি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ছয়টি বন্ধ রাখা হয়েছে।
শিল্প দূষণ কমাতে ইতোমধ্যেই দিল্লির ১১টি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ছয়টি বন্ধ রাখা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কেন্দ্র ও দিল্লি সরকার একাধিক পদক্ষেপ করলেও তা এখনো স্বস্তি দিতে পারেনি দিল্লিবাসীকে।
প্রায় প্রতি বছরই ভারত সরকার অথবা দেশটির সুপ্রিম কোর্ট আতশবাজি পোড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি করে থাকে। তবে মাঠপর্যায়ে তা খুব কমই কার্যকর হতে দেখা যায়। এর সঙ্গে যোগ হয় দিল্লির প্রতিবেশী পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় কৃষকদের খড় পোড়ানোর মৌসুম। পরবর্তী বছরে চাষের জন্য মাঠ প্রস্তুত করতে পুরোনো খড়কুটোয় আগুন ধরিয়ে দেন কৃষকরা। দিল্লির বায়ুদূষণের জন্য অন্তত ৩৫ শতাংশ দায়ী এ থেকে তৈরি ধোঁয়া।
ভারত সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নজর দিতে গিয়ে তারা বায়ুদূষণ রোধে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। গত ১ নভেম্বর স্কটল্যান্ডে কপ২৬ সম্মেলনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা দিয়েছেন, ভারত ২০৭০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনবে। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবিলার এই লক্ষ্যমাত্রায় ভারত অন্তত দুই দশক বেশি সময় নিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা জানান, অবস্থানগত কারণে দিল্লির এই সমস্যা গুরুতর হচ্ছে৷ আশেপাশে কোনো জলাধার না থাকায় ও আবহাওয়ার ধাঁচ শীতপ্রধান ও শুষ্ক হওয়ায় দূষিত বাতাস পালাবার জায়গা পায় না৷ এছাড়া, তীব্র বেগে চলা বাতাস প্রায়ই সাথে করে আরো বাড়তি ধোঁয়া নিয়ে আসে, যা আরো খারাপ করে পরিস্থিতি৷
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রভাব পড়ছে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার ওপর। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঋতুবৈচিত্র্য ও বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বিভিন্ন রোগের সম্পর্ক আছে এবং একই রোগ ভিন্ন ধরন ও লক্ষণ নিয়ে দৃশ্যমান হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সংক্রামক রোগের বিস্তার ঘটছে। যা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যুহার বেড়েই চলেছে। বিশ্বে জলবায়ুগত দুর্যোগের শিকার হয়ে লাখ লাখ মানুষ খোলা আকাশের নিচে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে কোনো না কোনোভাবে বিভিন্ন রোগের বিস্তারে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব ভূমিকা রাখছে। নিম্নমানের বসবাস, সেবা ও ঘনবসতিপূর্ণ নগর এলাকায় মশা মানুষের খুব কাছে চলে আসছে বলে মনে হয়! শুধু মশা নয়, জলবায়ু পরিবর্তনে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে অন্যান্য কীটপতঙ্গ প্রজননের উর্বর ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, পৃথিবীর আবহাওয়া পাল্টে যাবার কথা অনেকদিন থেকেই আলোচনায়। বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছিলেন। ওজোনস্তর ফুটো হয়ে যাবার কথাও অনেক পুরোনো। কিন্তু সেই পুরোনো কথার গুরুত্ব কেউ দেয়নি। আর দিলেও তা যে যথাযথভাবে দেওয়া হয়েছে, এমন বলার সুযোগ নেই।
বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা মানুষ শুনেছে। রাষ্ট্রপ্রধানরা তহবিল সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন ফোরামের নানা আয়োজনে উত্তেজক কথাবার্তা বলে হাততালি নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন। একে অন্যকে দোষারোপের সংস্কৃতিও রয়েছে। আর ধনী রাষ্ট্রগুলো যেভাবে কার্বন নিঃসরণ করছে, তার বিপরীতে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো রীতিমতো অসহায়। ফলে একদিকে দোষারোপের সংস্কৃতি, দরিদ্র দেশগুলোর আহাজারি, পৃথিবীব্যাপী সচেতন মানুষদের আর্তনাদ অন্যদিকে বায়ুমণ্ডলে অবিচ্ছিন্নভাবে কার্বন নিঃসরণ চলতে থাকে। ফলে বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তাও ফলতে শুরু করেছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, হিমালয়ের বরফ গলছে। সেই পানি ধেয়ে আসছে সমুদ্রে। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। আর ওজোনস্তরের ফুটো বাড়তে থাকারও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
বিশ্বের তাপমাত্রার যে পরিবর্তন তাও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। পেছনের একশ বছরের তাপমাত্রা মিলিয়ে দেখে, বায়ুমণ্ডল এবং পৃথিবীপৃষ্ঠ উষ্ণ হয়ে ওঠার প্রমাণও হাতেনাতে ফলতে শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দুর্ভাগ্য, পৃথিবীর তাপমাত্রা অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ঠিক করার কাজটি নিয়ে যত সময়ক্ষেপণ হবে, মতানৈক্য থাকবে, তত বেশি মোকাবেলা করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি এড়ানোর পথ একটাই, সেটা হল শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোকে এক টেবিলে বসিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫২
আপনার মতামত জানানঃ