করোনা মহামারিতে দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নানা কারণে ঝরে পড়ছে বহু শিক্ষার্থী। এদের একটি বড় অংশ শিকার হয়েছে বাল্যবিয়ের। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ছাত্রীরা বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এক বিদ্যালয়েই শতাধিক ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে এমন তথ্যও আছে। আবার একই গ্রামে একাধিক বাল্যবিয়ের ঘটনাও আছে। উপকূলীয় ও হাওড়াঞ্চলে অনেক ছাত্রীর মাথায় সংসারের বোঝা চেপেছে। অভাব-অনটনের কারণে বাবা-মা অনেকটা গোপনেই অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছেন সন্তানদের। এই ছাত্রীদের আর ক্লাসে ফেরার সম্ভাবনা নেই।
জানা গেছে, নাটোরের বাগাতিপাড়া মহিলা মাদরাসার কোনো শিক্ষার্থী এবার দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন না। অথচ ১৪ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া দাখিল পরীক্ষায় এ মাদরাসা থেকে ১৫ শিক্ষার্থী অংশ নেওয়ার কথা ছিল।
ওই মাদ্রাসা সুপার জানান, করোনা মহামারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সব পরীক্ষার্থীদের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় কেউ পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উপজেলার পেড়াবাড়িয়া মাদরাসা কেন্দ্রে এবার পাঁচ মাদরাসার ৯৮ শিক্ষার্থী দাখিল পরীক্ষা অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু ওই কেন্দ্রে প্রতিদিন ৮৩ জন উপস্থিত হন। অনুপস্থিত ১৫ পরীক্ষার্থীর সবগুলোই বাগাতিপাড়া মহিলা মাদরাসার ছাত্রী। কোনো পরীক্ষায় ওই মাদরাসার একজন শিক্ষার্থীও অংশ নেননি। তবে মাদরাসা সুপার সব শিক্ষার্থীর প্রবেশপত্র সংগ্রহ করেছেন।
কেন্দ্র সচিব ইব্রাহিম হোসাইন জানান, তার কেন্দ্রের অধীনে ৫ টি মাদরাসার ৯৮ জন পরীক্ষার্থীর প্রবেশপত্র পেয়ে সংশ্লিষ্ট সুপারদের কাছে সবগুলো বিতরণ করা হয়। সবশেষে বাগাতিপাড়া মহিলা মাদরাসা সুপারকে ১৫ জন পরীক্ষার্থীর সবগুলোর প্রবেশপত্র দেয়া হয়েছে। তবে পরীক্ষার্থী প্রতি ৩০০ টাকা কেন্দ্র ফি প্রদানের কথা থাকলেও ৪ হাজার ৫০০ টাকার পুরো ফি বকেয়া রেখে পরীক্ষার্থীদের স্বার্থে প্রবেশপত্র দেয়া হয়েছিল।
এদিকে মানবিক গ্রুপের আল কোরআন এবং হাদিস শরীফ দুটি বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু ওই মাদরাসা থেকে কেউ অংশ নেয়নি। এ বিষয়ে মাদরাসার সুপারের সাথে যোগাযোগ করেও লাভ হয়নি।
এ বিষয়ে বাগাতিপাড়া মহিলা মাদরাসা সুপার আব্দুর রউফ জানান, মাদরাসা থেকে এবার ১৫ জন ছাত্রীর পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনায় সব ছাত্রীর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় কেউই পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। প্রবেশপত্র হাতে পেয়ে এসব পরীক্ষার্থীদের বাড়ি গিয়ে ছাত্রীদের পরীক্ষায় অংশ নিতে বলা হয়েছিলো। কিন্তু কেউ তাতে সাড়া দেয়নি।
মাদরাসা থেকে এবার ১৫ জন ছাত্রীর পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনায় সব ছাত্রীর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় কেউই পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। প্রবেশপত্র হাতে পেয়ে এসব পরীক্ষার্থীদের বাড়ি গিয়ে ছাত্রীদের পরীক্ষায় অংশ নিতে বলা হয়েছিলো। কিন্তু কেউ তাতে সাড়া দেয়নি।
এর বাইরে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বাল্যবিয়ে হয়েছে। ঝরে পড়া, বিদ্যালয়ে না আসা হতদরিদ্র পরিবারের অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রীদের বিয়ে হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে কি পরিমাণ বাল্যবিয়ে হয়েছে তার সঠিক তথ্য নেই কোনও দপ্তরে।
একটি পরিসংখ্যান বলছে, করোনার কারণে ২০২০ সালে কমপক্ষে পাঁচ লাখ অপরিণত বয়সের মেয়েকে বিয়ে দেয়া হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হতে পারে আরো অতিরিক্ত ২৫ লাখ মেয়ে। গত ২৫ বছরের মধ্যে এবারই বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি।
ইউনিসেফ, ইউএনএফপি ও প্লান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সহায়তায় ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সাত মাসে দেশের মোট ৬৪টি জেলার মধ্যে ২১টি জেলার ৮৪টি উপজেলায় বাল্যবিয়ের মাত্রা নিয়ে পরিচালিত জরিপের ফল সংস্থাটি প্রকাশ করে। যাতে দেখা যায়— ওই সময়ে এ জেলাগুলোতে অন্তত ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। জরিপে বলা হয়, যে সব শিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে তাদের ৫০ দশমিক ৬ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ১৭ বছর, ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছর এবং ১ দশমিক ৭ শতাংশের বয়স ১০ থেকে ১২ বছর। করোনাকালে মানুষের আয় হ্রাস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা ও নিরাপত্তাহীনতাকে বাল্যবিয়ের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
ব্র্যাকের গবেষণায় বলা হয়েছে, ৮৫ শতাংশ বাল্যবিয়ে হয়েছে মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে। ৭১ শতাংশ হয়েছে মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য। বাইরে থেকে আসা ছেলে হাতের কাছে পাওয়া ৬২ শতাংশ বিয়ের কারণ ছিল। করোনা ঠেকাতে ব্যস্ত প্রশাসনের বিয়ে ঠেকানোর কড়াকড়িতে যে শৈথিল্য আছে, তা ব্র্যাকের গবেষণায় স্পষ্ট। জোর করে বিয়ে দেয়ার ঘটনা আগের চেয়ে বেড়েছে। আর আমাদের সহযোগী সংগঠনগুলো জানিয়েছে, প্রত্যন্ত এলাকায় বাল্যবিয়ে বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন, বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে ২১টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। অথচ বাংলাদেশসহ বিশ্ব নেতারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অধীনে ২০৩০ সালের মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতা, বাল্যবিয়ে নির্মূলের অঙ্গীকার করেছিলেন।
জাতিসঙ্ঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, বাল্যবিয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থতম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে মেয়েদের ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ৬৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের বিয়ে হচ্ছে ১৫ বছরের আগেই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ ছেলেদের সমান বা কিছু বেশি হলেও উচ্চশিক্ষা এবং চাকরিতে অনেক পিছিয়ে মেয়েরা। বর্তমানে সরকারি চাকুরেদের মধ্যে নারী মাত্র ২৭ শতাংশ।
আর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ। মেয়েদের এই পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ বাল্যবিয়ে। শিশু মেয়ে হয় শিশু মা। ফলে বাড়ে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার। বাল্যবিয়ে বন্ধে এখনই উদ্যোগ না নিলে চ্যালেঞ্জ হবে এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে। বিশ্বজুড়ে ১৮ বছরের বেশি বয়সে বিবাহিত মেয়েদের তুলনায় ৫০ শতাংশের বেশি শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ১৫ বছরের কম বয়সী বিবাহিতা মেয়েরা।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দারিদ্র্য দেশে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। করোনা মহামারি দরিদ্রের সংখ্যা আরও বাড়িয়েছে। অভাবের কারণে দরিদ্র পরিবারের অভিভাবক অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে সংসারের খরচ কমাতে চান। বিয়ের পর মেয়েটির স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়।
তারা বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সব সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করা, প্রতি মাসে উপবৃত্তি প্রদান নিশ্চিত করা এবং দুপুরের খাবার নিয়মিত দেওয়া হলে দরিদ্র অভিভাবকরা মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী হবেন। তারা তখন আর মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইবেন না। এতে বাল্যবিয়ে কমবে, নারী শিক্ষার হারও বাড়বে।
আরও বলেন, বাল্যবিয়ে স্থায়ীভাবে প্রতিরোধ করতে প্রথমেই প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। বাল্যবিয়ের কুফল সব অভিভাবককে বুঝতে হবে, অথবা তাদের বোঝাতে হবে। ছেলেমেয়েদেরও বোঝাতে হবে যে, অল্প বয়সে বিয়ে করা ভালো নয়। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সর্বত্র প্রচার-প্রপাগান্ডা চালিয়ে যেতে হবে। যেসব কারণে বাল্যবিয়ে হয়, তা দূর করার জন্য অভিভাবক, সমাজ ও সরকারকে সমন্বিতভাবে কাজ করে যেতে হবে। একইসঙ্গে জেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ের বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটিগুলোকে কার্যকরভাবে সক্রিয় রাখা প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২৩
আপনার মতামত জানানঃ