ইন্টারনেট সুবিধাসহ প্রযুক্তির নানামাত্রিক ব্যবহার যতোই সহজলভ্য হচ্ছে ততোই সাইবার জগতে নারীদের সহিংসতার ঘটনা বাড়ছে। দেশের ৬৮ শতাংশ নারী সাইবার জগতে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া এই নারীদের বেশির ভাগই তরুণী। ১৮-২৪ বছর বয়সী এসব তরুণীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ঘটছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এদিকে সাইবার হয়রানির শিকার ৮৮ শতাংশ নারীই মামলা করেন না।
সাইবার জগতে নারীদের হয়রানি প্রতিরোধে গত বছর ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ নামের একটি সেবা চালু করে পুলিশ সদর দপ্তর। প্রতিষ্ঠার পর থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১২ হাজার ৬৪১ জন ভুক্তভোগী নারী সাইবার জগতে হয়রানিসংক্রান্ত বিষয়ে যোগাযোগ করেছেন এ সেবায়। তাদের মধ্যে সেবা পেয়েছেন ৮ হাজার ২২১ জন। কিন্তু অভিযোগকারীদের বেশির ভাগই মামলা বা জিডি করতে চান না। শুধু হয়রানি করা ফেক আইডি কিংবা কনটেন্ট ডিলিটের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন প্রতিষ্ঠার পর ১৭ হাজার ২৮০ জন সেবাপ্রত্যাশী যোগাযোগ করেছেন। এর মধ্যে হয়রানিসংক্রান্ত ১২ হাজার ৬৪১ অভিযোগের মধ্যে ৮ হাজার ২২১ জনকে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তিগত ও আইনগত পরামর্শ এবং সহায়তা দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ করা ১২ হাজার ৬৪১ জন ভুক্তভোগীর মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ জিডি বা মামলা করেছেন। অর্থাৎ ৮৮ শতাংশ ভুক্তভোগী মামলা করেননি। যে ১২ শতাংশ ভুক্তভোগী মামলা করেছেন, তাদের মধ্যে আবার ৮৭ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযুক্তের পরিচয় ও অবস্থান শনাক্তের পর তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনগত প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে সহযোগিতায় আগ্রহী ছিলেন না।
জানা গেছে, পুলিশ সদর দপ্তরের এলআইসি শাখার অধীনে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের সেবা কার্যক্রমটি পরিচালিত হয় নারী অফিসারদের দ্বারা।
এলআইসি শাখা সূত্র জানায়, সাইবার অপরাধ করা হয় বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের মাধ্যমে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অভিযুক্ত আইডির বিষয়ে সব সময়ে তথ্য পাওয়া যায় না, যা সাইবার অপরাধ তদন্তে অন্যতম বাধা। এ বিষয়ে সম্প্রতি ফেসবুকের বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ, বিটিআরসি, বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার ও এজেন্সির সঙ্গে পুলিশের বৈঠক হয়েছে। ফেসবুকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যে ইস্যু বা অভিযোগ তুলে আইডির তথ্য চাওয়া হয়, সেটি সংশ্লিষ্টের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের মধ্যে পড়ে না। তাই তারা অনেক আইডির তথ্য দিতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি থাকলে তখন তারা তথ্য সরবরাহ করতে অনেকটা বাধ্য থাকেন। তাই চুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশসহ উভয়ে ইতিবাচক রয়েছে। যে কোনো সময় এ চুক্তি হতে পারে।
এলআইসি শাখার তথ্য অনুযায়ী, ভুয়া আইডি ব্যবহারে মাধ্যমে হয়রানি করার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি, যা মোট অভিযোগের ৪৩ শতাংশ বা পাঁচ হাজার ৪৭৫ জন। এ সময়ের মধ্যে ভুক্তভোগীদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে ১ হাজার ৮৮৪ জন নারীকে, আর আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও পাঠিয়ে হয়রানির করা হয় ৯৯২ জনকে। অন্যান্য উপায়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৫১৮ জন।
ঢাকা বিভাগ থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক ভুক্তভোগী এই সেলে অভিযোগ করেছেন, যা মোট অভিযোগের ৬৪ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে ১৭ শতাংশ; খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগ থেকে ৪ শতাংশ; বরিশাল থেকে ৩ শতাংশ ও ময়মনসিংহ থেকে ২ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন।
পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনে বিভিন্ন বয়সি নারী ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। তবে অভিযোগকারীর শতকরা ১৬ ভাগ ভুক্তভোগী ১৮ বছরের কম বয়সি। শতকরা ৫৮ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছর। ২৫-৩০ এর মধ্যে ভুক্তভোগী ২০ ভাগ এবং ৬ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ৪০ বছরের বেশি।
ঢাকা বিভাগ থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক ভুক্তভোগী এই সেলে অভিযোগ করেছেন, যা মোট অভিযোগের ৬৪ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে ১৭ শতাংশ; খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগ থেকে ৪ শতাংশ; বরিশাল থেকে ৩ শতাংশ ও ময়মনসিংহ থেকে ২ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন।
এলআইসি শাখা জানিয়েছে, নারীদের জন্য চালু করা এ সেলে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক অভিযোগ আসছে। বর্তমানে থাকা লোকবল দিয়ে ভুক্তভোগীদের সেবা দেয়া অনেকটা কষ্টসাধ্য। আরো দক্ষ জনবল প্রয়োজন। দিন দিন সাইবার অপরাধের ধরন পাল্টাচ্ছে। তাদের মোকাবিলা করতে হলে দক্ষ জনবলের বিকল্প নেই। এছাড়া ভুক্তভোগী অভিযোগকারীর সংখ্যাও দিন দিন বেড়েই চলছে। তাই নারীদের নিয়ে কাজ করা এই সেলের পরিধিও বাড়ানো উচিত। এলআইসি শাখাও মনে করে, এই সেলটি একসময় পুলিশের একটি ইউনিট হিসেবে রূপ পাবে।
এদিকে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন সার্ভিসের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে পুলিশ সদর দপ্তরের হল অব ইন্টেগ্রিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘সাইবার জগৎ আমাদের জীবন সহজতর করেছে। পাশাপাশি এ কথাও সত্য, প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধীরা নানা অপরাধ করছে।’
তিনি বলেন, এখন শুধু শহরের মানুষ নয়, গ্রামের মানুষও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছেন। এতে অনেকে সাইবার বুলিং বা সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন। শুধু ব্যক্তি বা সমাজ নয়, অনেক সময় রাষ্ট্রও এর ভিকটিম হচ্ছে।
আইজিপি বলেন, নারীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। এটা দিন দিন বাড়ছে। একজন নারী যখন সাইবার হামলার শিকার হন, তখন ওই নারী ও তার পরিবারে কী বিপর্যয় নেমে আসে, তা শুধু ভুক্তভোগীই জানেন। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে অধিকতর সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত কিংবা পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যুক্ত না হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি আরও বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বল্প পরিচয়ের সূত্র ধরে কারও সঙ্গে বাইরে বের হলে ঝুঁকিও রয়েছে।
অনুষ্ঠানে সেবা পাওয়া ভুক্তভোগী নারীরা তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন সার্ভিসে সহায়তার জন্য যোগাযোগের পর তারা অনেক দ্রুত সেবা পেয়েছেন এবং তাদের সমস্যার সমাধান হয়েছে। এ সার্ভিস থেকে শুধু আইনি সহায়তাই নয়, তাদের মানসিক সহায়তাও দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পারিবারিক বা সামাজিক কারণে ভিকটিম নারীদের ফেক আইডি বা কন্টেন্ট ডিলিটের মাধ্যমে আপসে খুশি না হয়ে আইনগতভাবে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। তাহলে সাইবার অপরাধীরা বেপরোয়া হতে পারবে না। এতে করে নারীদের সাইবার হয়রানির সংখ্যাও অনেক কমে আসবে।
তারা বলেন, বাংলাদেশে খুব সহজে নারীদের হয়রানি করা যায়। এসব নিয়ে ভুক্তভোগী নারীদের মধ্যে সঠিক উপায়ে প্রমাণাদি রাখার প্রবণতা কম। ঘটনার পর প্রত্যেকের উচিত রিপোর্ট করা। টিকটক বা লাইভ ভিডিওভিত্তিক বিনোদনের জন্য ঠিক আছে। কিন্তু যদি সেটা অপরাধ প্রবণতাকে উস্কে দেয় তাহলে তা এড়িয়ে যেতে হবে। সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য এসব অভ্যাস এখন মানসিক অশান্তির কারণ হিয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারা বলেন, টিকটকের মতো বিষয়গুলোকে মানুষ এখন অন্ধভাবে অনুসরণ করছে, যা মোটেই উচিত নয়। এসব সামাজিক অবক্ষয়ের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সোচ্চার হলেও প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের নিজেদের সচেতনতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধু বেছে নেবার ক্ষেত্রেও নিজেকে এবং পরিবারকে সচেতন হতে হবে। পরিচিত ব্যক্তির থেকে নারীরা সহিংসতার শিকার হয়, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রকাশ করে না। এই ট্রমা থেকে সারাজীবন রক্ত ঝরে। তাই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার শিকার হলে সবার আগে সবচেয়ে কাছের মানুষ কিংবা পরিবারকে জানাতে হবে। সাহস নিয়ে মানুষগুলোর মুখোশ খুলতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩৫
আপনার মতামত জানানঃ