বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে আফগানিস্তান। গত আগস্ট মাসে তালিবানরা দেশটির ক্ষমতা দখলের পর থেকে মানবিক পরিস্থিতির তীব্র অবনতি হতে শুরু করে। বিশেষ করে দেশটি নারীদের জন্য এক আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে।
এমনিতে অর্থনীতি একপ্রকার ভেঙে পড়েছে দেশটির। দীর্ঘ দুই দশক যুদ্ধ চলাকালে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা দেশটিকে সহায়তা করে আসছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সরকারকে আগস্টে তালিবান ক্ষমতাচ্যুত করার পর ওই সব সহায়তাও বন্ধ হয়ে যায়। আর এর ফলেই সমূহ বিপদে পড়েছে দেশটি।
এ বিষয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতদিন যেসব আন্তর্জাতিক সহায়তার মাধ্যমে দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতি টিকে ছিল সেটা বন্ধ হয়ে গেছে এবং তালিবান সরকারের সঙ্গে কীভাবে কাজ করবে সে বিষয়ে বিশ্বজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
আর এর মধ্যেই আফগানবাসী পৃথিবীতেই নরকের যন্ত্রণা ভোগ করছেন। ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর জানান, আফগানিস্তানে ২০ দিন বয়সী মেয়েশিশুদের বিয়ের জন্য প্রস্তাব দিচ্ছে পরিবার। এনডিটিভি অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
গতকাল শনিবার হেনরিয়েটা ফোর এক বিবৃতিতে জানান, যৌতুকের বিনিময়ে ভবিষ্যতে বিয়ের জন্য ২০ দিন বয়সী মেয়েশিশুদের পরিবার প্রস্তাব দিচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, আফগানিস্তানের হেরাত ও বাগদিস প্রদেশে ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালে ইউনিসেফের অংশীদারেরা ১৮৩টি বাল্যবিবাহের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। একই প্রদেশে একই সময় ১০টি শিশু বিক্রির ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে। এ শিশুদের বয়স ৬ মাস থেকে ১৭ বছর।
হেনরিয়েটা ফোর বলেন, ‘আফগানিস্তানে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে, এমন খবরে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন পেয়েছি যে পরিবারগুলো যৌতুকের বিনিময়ে ভবিষ্যতে বিয়ের জন্য ২০ দিন বয়সী মেয়েদের প্রস্তাব দিচ্ছে।’
করোনা মহামারি, চলমান খাদ্যসংকট ও শীতের সূচনা— পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে। ২০২০ সালে আফগানিস্তানের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা এতটাই দরিদ্র ছিল যে তাদের মৌলিক পুষ্টি বা বিশুদ্ধ পানির মতো প্রয়োজনীয় বিষয়ের অভাব ছিল।
হেনরিয়েটা ফোর জানান, আফগানিস্তানের অত্যন্ত ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও বিপুলসংখ্যক পরিবারকে দারিদ্র্যের গভীরে ঠেলে দিচ্ছে। এ পরিস্থিতি তাদের শিশুদের দিয়ে কাজ করানো, অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া মতো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে।
হেনরিয়েটা ফোর জানান, যেহেতু বেশির ভাগ আফগান কিশোরীদের এখনো স্কুলে যেতে দেওয়া হয়নি, তাই তাদের বাল্যবিবাহের ঝুঁকি এখন আরও বেশি। বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমের মতো নেতিবাচক বিষয়গুলো মোকাবিলায় শিক্ষা প্রায়ই সর্বোত্তম সুরক্ষা হিসেবে কাজ করে।
তিনি জানান, মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে হলে তাদের যেসব ঝুঁকি সৃষ্টি হয়, সেগুলো সম্পর্কে লোকজনকে সচেতন করতে ইউনিসেফ তার অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছে।
তিনি আরও জানান, যে মেয়েরা তাড়াতাড়ি বিয়ে করে, তাদের স্কুলজীবন শেষ করার সম্ভাবনা কম। তাদের পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এ ধরনের মেয়েরা বড় হয়ে মানসিক ও স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগে।
আফগানিস্তানের ছোট্ট শিশু পারওয়ানা মালিক। বয়স মাত্র ৯ বছর। ধূসর চোখ আর উজ্জ্বল চেহারার এই মেয়েটির দিন কেটে যায় বন্ধুদের সঙ্গে হেসে খেলেই। সে হয়তো বুঝতেই পারেনি কি ঘটতে চলেছে তার ভাগ্যে। খেলা ছেড়ে ঘরে ফিরতেই ঘোর অন্ধকার তার চোখেমুখে। নিমিষেই চাপা পড়ে যায় ছোট্ট মুখের হাসি। সে জানতে পারে এক বৃদ্ধের কাছে টাকার বিনিময়ে তার বাবা-মা বিয়ে ঠিক করেছে।
৯ বছরের এই শিশুটির বিয়ে হবে ৫৫ বছর বয়সী এক লোকের সঙ্গে। এমনটা ভাবাই যায় না। কিন্তু এমন ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ আফগানিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বাদগিস প্রদেশের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। এই কেন্দ্রে চার বছর ধরে বসবাস করছে পারওয়ানার পরিবার।
তালিবান আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নেওয়ার পর আন্তর্জাতিক সহায়তা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, ধসে পড়েছে দেশটির অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এতে খাবারের মতো দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে পারছে না অনেকে। পারওয়ানা তার পরিবারে প্রথম নয়, কয়েক মাস আগে তার তিন বছরের বড় বোনকে বিক্রি করা হয়।
২৪ অক্টোবর পারওয়ানার ঘরে আসে কোরবান নামের ওই ‘বুড়ো’ লোক। ভেড়া, জমি ও অর্থ মিলিয়ে পারওয়ানার বাবাকে দুই লাখ আফগানি মুদ্রা দেন। এ অর্থ মাত্র ২ হাজার ২০০ মার্কিন ডলারের সমান। পারওয়ানার হাত ধরে দরজা পেরিয়ে চলে যায় কোরবান। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় পারওয়ানা।
পারওয়ানার বাবা আবদুল মালিক সিএনএকে জানান, তিনি রাতে ঘুমাতে পারেন না। লজ্জা, অপরাধবোধ আর দুশ্চিন্তায় মন ভেঙে যাচ্ছে তার। মেয়েকে বিক্রি না করার সব চেষ্টা তিনি করেছেন। অনেক জায়গায় কাজ খুঁজেও পাননি। আত্মীয়স্বজনের কাছে ধার করেছেন। তার স্ত্রী অন্যদের কাছে খাবার ভিক্ষা করেছেন।
এত কিছু করেও পরিবারের জন্য দুমুঠো খাবার জোগাতে পারছিলেন না আবদুল মালিক। পরিবারের জন্য খাবার জোগাতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবারের সদস্য আটজন। পরিবারের অন্যদের বাঁচাতে হলে (মেয়েকে) বিক্রি করতেই হতো।’
গত ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ তালিবানের হাতে যায়। তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর দেশটির নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা ও শিক্ষা নিয়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়।
প্রসঙ্গত, তালিবান নিয়ে বিশ্ব মোড়লদের সিদ্ধান্তহীনতা এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে। তালিবানের নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তহীনতার ফল ভুগতে হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটির লাখ লাখ মানুষকে।
সোমবার জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সতর্ক করে জানায়, আসছে শীতে অর্ধেকের বেশি আফগান চরম খাদ্যসংকটে ভুগবে। খাদ্যের অভাবে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হবে, যদি না দ্রুতই আফগানিস্তানে ত্রাণ পাঠানো হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ