সীমান্ত হত্যার সংখ্যা শূন্যতে আনা এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধের বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারত— দুই দেশই সম্মত হয়েছে কয়েক বছর আগে। এরপরও সেটা বন্ধ হয়নি। বরং বেড়েছে। আজও লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার বুড়িরহাট সীমান্তের কাছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে দুজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। শুক্রবার ভোরে ওই সীমান্তের ৯১৭ নম্বর মেইন পিলারের ৫ নম্বর সাব পিলারের কাছে এ ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন— গোড়ল ইউনিয়নের মালগড়া এলাকার আলতাব হোসেনের ছেলে আসাদুজ্জামান ভাসানী ও ঈদ্রিস আলীর ছেলে মোসলেম উদ্দিন।
জানা গেছে, শুক্রবার গভীর রাতে ভারতীয় গরু ব্যবসায়ীদের সহায়তায় ইদ্রিস আলী ও আসাদুজ্জামান ভাসানী ভারতে প্রবেশ করে। ভোরে তারা গরু নিয়ে ফেরার পথে গুনজিরির চওড়া বিএসএফের ক্যাম্পের টহল দল তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এতে কাঁটাতার সংলগ্ন এলাকায় তাদের মৃত্যু হয়। তাদের লাশ ভারতীয় অংশে পড়ে আছে।
গোড়ল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাহমুদুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ইদ্রিস, আসাদুজ্জামানসহ বেশ কয়েকজন বৃহস্পতিবার(গতরাত) রাতে ভারত থেকে গরু নিয়ে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসছিলেন। লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের গোড়ল ইউনিয়নের সেবকদাস গ্রামের বুড়িরহাট সীমান্তের ৯১৭ মেইন পিলারের অধীন পাঁচ নম্বর সাব–পিলার এলাকায় পৌঁছলে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার সিতাই থানার গুনজরির চওড়া বিএসএফ ক্যাম্পের টহল দলের সদস্যরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালান। এ সময় ইদ্রিস ও আসাদুজ্জামান গলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। তাদের লাশ সীমান্তের ভারতীয় অংশে পড়ে আছে।
এ বিষয়ে কালীগঞ্জ থানার ওসি আরজু মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, স্থানীয়রা বিষয়টি জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
বন্ধু রাষ্ট্রের গালগল্পের ভীড়ে সীমান্ত হত্যা যেন স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে সীমান্তবর্তী মানুষদের জন্যে। বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকবার সীমান্ত হত্যা বন্ধ আলোচনা এবং চুক্তি হয়েছে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনাতেও কোনও সমাধান আসেনি, যার ফলে সীমান্ত হত্যা চলছেই।
এর আগে গত ৩ নভেম্বর সিলেটের কানাইঘাট সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে দুই বাংলাদেশি যুবক নিহত হয়েছেন।
নিহতদের স্বজনরা জানান, মঙ্গলবার (২ নভেম্বর) বিকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে স্থানীয় লালবাজারে যান তারা। এরপর আর বাড়িতে ফেরেননি।
তার দুইদিন আগে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী (বিএসএফ) ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার জগদল সীমান্তে বাংলাদেশের ভেতর থেকে এক কৃষককে ধরে নিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেছে। নির্যাতনের শিকার রুহুল আমিনকে (৩৭) ঠাকুরগাঁওয়ের একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়।
চিকিৎসারত রুহুল আমিন জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, ‘কুলিক নদীর পশ্চিম পাশে জগদল সীমান্তের ৩৭৪/১-এস পিলারের কাছে বাংলাদেশের প্রায় ২০০ গজ ভেতরে জহুরুল ইসলামের জমি চাষ করতে যাই। সাদা পোশাকধারী ২ বিএএফ সদস্য মাছ ধরতে ওই নদীতে আসেন। জমিতে কী আবাদ করা হবে এমন কথার এক পর্যায়ে তারা কাছে এসে গলায় চাকু ধরে ভারতের ভেতরে কাঁটাতারের বেড়ার কাছে নিয়ে যায়। সেখানে আরও ৩ বিএসএফ সদস্য তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটাতে শুরু করে। এভাবে প্রায় ১৫ মিনিট পেটানোর পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে জ্ঞান ফিরলে শুনি নদীর ওপারে ভারত সংলগ্ন এলাকায় চাষাবাদ করতে না যাওয়ার জন্য অন্যান্য বাংলাদেশিদের হুঁশিয়ার করে বিএসএফ সদস্যরা। অন্যথায় এর চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি হবে বলে হুমকি দেয়। পরে নদীর কাছে কোন রকমে এলে স্থানীয়রা আনুমানিক দুপুর দেড়টার দিকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে।’
বাংলাদেশ-ভারত যদিও বন্ধুরাষ্ট্র, তবুও এ দুই দেশের সীমান্তে রাষ্ট্রীয় হত্যা হয় গোটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তবে এই গুলির ঘটনা একতরফা। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পক্ষ থেকে ভারতীয় কোনো নাগরিক গুলিবিদ্ধ না হলেও ভারতের পক্ষ থেকে নিয়ম করেই গুলি চালিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ-ভারত যদিও বন্ধুরাষ্ট্র, তবুও এ দুই দেশের সীমান্তে রাষ্ট্রীয় হত্যা হয় গোটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তবে এই গুলির ঘটনা একতরফা। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পক্ষ থেকে ভারতীয় কোনো নাগরিক গুলিবিদ্ধ না হলেও ভারতের পক্ষ থেকে নিয়ম করেই গুলি চালিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছে।
মানবাধিকার সংস্থার মতে, ২০০০-২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কমপক্ষে ১,১৮৫ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে সীমান্তে মোট ৪৮ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করে বিএসএফ৷ এর মধ্যে ৪২ জনকে গুলি করে এবং ছয় জনকে হত্যা করা হয় নির্যাতন চালিয়ে৷ অপহরণ করা হয় ২২ বাংলাদেশিকে৷
ওই সময়ে ২৬ জন বিএসএফ-এর গুলি ও নির্যাতনে গুরুতর আহত হন৷ অপহৃতদের মধ্যে মাত্র পাঁচ জনকে ফেরত দেয়া হয়েছে৷ বাকিদের ভাগ্যে কী ঘটেছে জানা যায়নি৷
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে বিএসএফ আত্মরক্ষার জন্য হত্যা করে। কিন্তু, বাস্তবতা তা বলে না। বেশ কয়েক বছর আগে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) ‘ট্রিগার হ্যাপি’ নামে একটি প্রতিবেদনে এ ধরনের বেশ কয়েকটি মামলার উল্লেখ করেছে। যাতে বেঁচে যাওয়া এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন যে বিএসএফ তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা না করে বা সতর্ক না করেই নির্বিচারে গুলি চালায়। বিএসএফ আরও দাবি করেছে যে দুর্বৃত্তরা গ্রেপ্তার এড়ানোর চেষ্টা করলে তাদের সদস্যরা গুলি চালায়। তবে কোনও অপরাধের সন্দেহে প্রাণঘাতি অস্ত্রের ব্যবহার ন্যায়সঙ্গত হয় না।
এইচআরডাব্লিউ, অধিকার ও এএসকের প্রতিবেদন এবং সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার, অপরাধী হিসেবে সীমান্তে হত্যার শিকার ব্যক্তিরা হয় নিরস্ত্র থাকে অথবা তাদের কাছে বড়জোর কাস্তে, লাঠি বা ছুরি থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে পিঠে গুলি করা হয়েছিল।
এইচআরডাব্লিউ আরও উল্লেখ করেছে, তদন্ত করা মামলার কোনোটিতেই বিএসএফ প্রমাণ করতে পারেনি যে হত্যার শিকার ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রাণঘাতী অস্ত্র বা বিস্ফোরক পাওয়া গেছে; যার দ্বারা তাদের প্রাণ সংশয় বা গুরুতর আহত হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে।
সুতরাং, বিএসএফের মেরে ফেলার জন্য গুলি চালানোর দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে মানুষের জীবনের অধিকার লঙ্ঘন করে। যা ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিকদের বেআইনিভাবে হত্যায় বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি নয়াদিল্লিতে খুবই কম গুরুত্ব পেয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশিকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্যের বিবরণ বাংলাদেশকে দেয়নি ভারত। ভারত সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট অনুমোদন না থাকলে অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি বিএসএফকেও ফৌজদারি কার্যবিধির বাইরে রাখা হয়। বিএসএফ সদস্যদের এমন জবাবদিহিতার বাইরে থাকাই সীমান্ত হত্যার ঘটনাগুলোকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, ভালো প্রতিবেশী দেশ সীমান্তে চলাচলকারীদের সঙ্গে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আচরণ করে। ভারত সরকারের এটা নিশ্চিত করা উচিত যে তার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রতি সম্মান করছে এবং আইনের শাসন অনুসরণ করছে। বিএসএফ এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে জাতিসংঘের সাধারণ নীতিমালা মেনে চলার জন্য প্রকাশ্যে আদেশ দেওয়া উচিত। বিএসএফের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত তার সদস্যদের বিচার করতে পারেনি। ভারত সরকার বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে নির্যাতনের মামলাগুলো তদন্তের অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে।
সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারত সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল দফায় দফায় বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও সীমান্তে হত্যা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতে, ২০১৮ সালে যেখানে সীমান্তে হত্যার সংখ্যা ছিল ১১, সেখানে ২ বছরের ব্যবধানে তা চারগুণ ছাড়িয়ে গেছে। ভারত সরকারের সবুজ সংকেত ছাড়া এভাবে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার কথা নয় বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। ভারত সরকার যেহেতু বাংলাদেশকে কৌশলগত বন্ধু হিসেবে তুলে ধরে, সেক্ষেত্রে সীমান্তে হত্যার নির্দেশ কে দিচ্ছে, কিংবা সেই হত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কে ভারত সরকারকে বাধা দিচ্ছে বাংলাদেশকে এটা খুঁজে বের করতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তিই সীমান্তে হত্যার সংখ্যা হ্রাস করতে পারে। গোটা দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা এ প্রশ্নে একমত যে, কেবল ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বাংলাদেশের সরকার বাধ্য করতে পারলেই সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা সম্ভব হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সীমান্ত হত্যার পেছনেও ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সন্দেহ রয়েছে। ভারত ছোট দেশকে সব সময় ছোট করেই রাখতে চায়। তাই সীমান্ত হত্যাসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক শুধু কাগজে কলমে। তাই ভারতের ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৩
আপনার মতামত জানানঃ