ভোর চারটে বাজার কিছুক্ষণ আগে ফোনকল এলো। বাদশাহ সালমান জরুরি ভিত্তিতে তাঁর ভাতিজা যুবরাজ আলওয়ালিদ বিন তালাল আল সৌদকে দেখতে চেয়েছেন। “এক্ষুনি চলে আসুন,” তাগাদা দিলেন ফোন করার দায়িত্ব থাকা রয়্যাল কোর্টের কর্মকর্তা।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলওয়ালিদ বিন তালাল নিজেকে একজন সৌদি ব্যবসায়ী হিসেবে বিগত কয়েক দশক ধরে সুপরিচিত এবং প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার মতো ব্যক্তির আশেপাশে মানুষ থাকতে আগ্রহবোধ করে। তার জীবনের একটি ক্ষুদ্র মুহূর্তকে দেখলেও বোঝা যায় তিনি অঢেল অর্থ-বিত্তের অধিকারী।
তার ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। অনেক আমেরিকান এবং ইউরোপিয়ান ব্যক্তির নজর ছিল তার ওপর। তিনি ছিলেন তাদের চোখে আদর্শ সৌদি ব্যক্তিত্ব; বিপুল বিত্তের অধিকারী, সুদর্শন এবং সবকিছুতেই তার একধরনের বাড়াবাড়ি ছিল। রীতিমতো উড়োজাহাজের বহর ছিল তার! একটি ৭৪৭ জেট প্লেন ছিল সেই বহরে, যার মাঝখানে রাজ সিংহাসনের মতো একটি চেয়ার বসানো ছিল। তার সংগ্রহে একটি ইয়ট ছিল, যার মূল্য ৯০ মিলিয়ন ডলার! সেই ইয়টে ২২ জন অতিথি থাকার ব্যবস্থা ছিল এবং তাদেরকে সেবা দেওয়ার জন্য ছিল ৩২ জন ক্রু মেম্বার।
কোনো কিছু পছন্দ হয়ে গেলে তিনি সেই জিনিসটির দশ কপি কিংবা বিশ কপি করে কিনে নিতেন। তা যতই দামী হোক না কেন তিনি পরোয়া করতেন না। এমনকি ব্যায়াম করার ভারী মেশিন কেনার ক্ষেত্রেও তিনি কোনো ব্যতিক্রম ঘটাতেন না। আমেরিকান ব্যবসায়িক জগতে সরব ছিলেন তিনি। সিটিব্যাংক, অ্যাপল এবং টুইটারে অংশীদারিত্ব কিনেছিলেন। বিল গেটসের সাথে যুক্ত হয়ে তিনি নিজের প্রতিষ্ঠান আলওয়ালিদ’স কিংডম হোল্ডিং কোম্পানির নামে ফোর সিজনস হোটেল চেইনের একটি অংশের মালিকানা কিনে নিয়েছিলেন। আলওয়ালিদ যখন ভ্রমণ করতেন, তার সাথে দুই ডজন মানুষের একটি দলও ভ্রমণ করতো। রাঁধুনী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, খানসামা এবং ব্যবসায়িক উপদেষ্টারা থাকতো সেই দলে।
এত বিলাসী জীবনের মালিক আলওয়ালিদ অনুভব করলেন তার মেরুদন্ড দিয়ে যেন একধরনের হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল! তিনি মরুভূমিতে নিজের আস্তানায় অবস্থান করছিলেন। বাদশাহর সাথে দেখা করার জন্য আলওয়ালিদ তৈরি হতে শুরু করলেন। সময়টা ২০১৭ সাল, নভেম্বরের এক শীতল রাত। ইদানীং সৌদি আরবে ব্যাপক পরিবর্তন দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। রাস্তাঘাট থেকে ধর্মীয় পুলিশদেরকে সরানো, ক্যাফেতে গান বাজানোর অনুমতি দেওয়া ইত্যাদি। ইন্দ্রিয়কে উত্তেজিত করতে পারে এমন সবকিছু বিগত কয়েক দশক ধরে নিষিদ্ধ ছিল। সৌদি আরব দীর্ঘ সময় ধরে ইসলামের সবচেয়ে রক্ষণশীল সংস্করণ অনুসরণ করে আসছিল। সমালোচকদের মতে, সেই রক্ষণশীল সংস্করণ বা মতাদর্শের নাম ওয়াহাবিজম। চরম রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় অভ্যস্ত সৌদি নাগরিকগণ হঠাৎ করে এত দ্রুত পরিবর্তনের সামনে পড়ে রীতিমতো হতবুদ্ধি হয়ে যাচ্ছেন। সৌদি আরবে একের পর এক সিনেমা হল খোলা হচ্ছে, নারীরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করছেন, স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছেন এবং শোনা যাচ্ছে সৌদি অর্থনীতি আর তেলের ওপর নির্ভরশীল থাকবে না, বিকল্প দেখা হচ্ছে।
সৌদি আরবের সবচেয়ে ধনী এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তি অবশ্য ভিন্ন একটি বিষয় অনুভব করছেন- একটা ফাটল ধরার শব্দ। মনে হচ্ছে তাদের অলংকৃত প্রাসাদগুলোর ভিত্তি দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধান এবং বিত্তশালী ব্যক্তিদেরকে আলওয়ালিদ নিজের বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিলেও সেসব কোনো অর্থ বহন করে না। একজন বিলিয়নিয়ার যুবরাজ হিসেবে তিনি এতদিন যে সুরক্ষা বলয় উপভোগ করতেন তা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে।
বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের শাসনকাল ২ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর আলওয়ালিদের কানে কিছু গল্প এসেছিল। যেমন : রাজ পরিবারের সদস্যদেরকে রাতে ডেকে নেওয়া হতো কিংবা তাদেরকে কৌশলে তুলে নেওয়া হতো কোনো উড়োজাহাজে, তারপর সৌদে আরবে নিয়ে এসে কারাবন্দী করা হতো ইত্যাদি। এসব কর্মকান্ডের পেছনে কলকাঠি নাড়তেন বাদশাহ সালমানের পুত্র এবং আলওয়ালিদের ছোট চাচাতো ভাই মোহাম্মদ বিন সালমান আল সৌদ। তার বয়স মাত্র ৩২ বছর কিন্তু ইতোমধ্যে নিজের মেজাজ এবং আগ্রাসী সব পরিবর্তন সাধন করে বেশ পরিচিতি লাভ করেছেন।
আলওয়ালিদ নিজেকে আশ্বস্ত করলেন। কারণ যেসব যুবরাজকে আটক করা হয়েছিল তারা পরিবারের জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তাদের অনেকেই ছিল রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন মতাবলম্বী। ফ্রান্স কিংবা যুক্তরাজ্যে নিজেদের ঘরে বসে তারা আল সৌদ পরিবারের জন্য ঝামেলা সৃষ্টি করতো। অথচ কয়েক মাস আগেও আলওয়ালিদ একজন অতিথির কাছে মোহাম্মদ বিন সালমানের সুনাম করেছেন, তার এজেন্ডা, কর্মকান্ডের ব্যাপারে ইতিবাচক কথা বলেছেন। মোহাম্মদের নেতৃত্বে সৌদি আরব অবশেষে ইসলামের সবচেয়ে রক্ষণশীল সংস্করণের সংকীর্ণ বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে আসছে। বৈচিত্রময় অর্থনীতি এবং নারী-পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করে সৌদি আরব যেভাবে আধুনিক আরব শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে- এটা দেখার জন্য তিনি অনেক উৎসাহিত ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, অর্থনৈতিক সংস্কারের ব্যাপারে আলওয়ালিদ প্রদত্ত সবচেয়ে আগ্রাসী পরামর্শও মোহাম্মদ গ্রহণ করেছেন। “এই পরিবর্তনের জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষা করছিলাম,” ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে, সৌদি আরবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাবেক আমেরিকান রাষ্ট্রদূত রবার্ট জর্ডানকে কথাটা বলেছিলেন আলওয়ালিদ।
ফোন পাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই আলওয়ালিদ তার মরুভূমির ক্যাম্প থেকে নিজের গাড়িতে চড়ে রিয়াদের উদ্দেশে রওনা হোন। রয়্যাল কোর্টে পৌঁছুতে তার এক ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। বাদশাহর একজন সহকারী বাইরে এসে জানালেন রয়্যাল কোর্টের পরিবর্তে নিকটস্থ রিজ-কার্লটন হোটেলে মিটিঙের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আলওয়ালিদকে নতুন একটি গাড়ির দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। নতুন গাড়িটি এক বিশাল গাড়ি বহরের অংশ। “ওই গাড়িতে আমার ফোন আর ব্যাগ রয়ে গেছে,” উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন আলওয়ালিদ।
“জি, আমরা সেগুলো নিয়ে আসব।” একজন জবাব দিলো। তার মানে আলওয়ালিদ এখন বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন, তার উদ্বিগ্নতা বেড়ে গেল। তার গার্ড, সহকারী এবং ড্রাইভারকে ভিন্ন ভিন্ন গাড়িতে বসানো হলো। কয়েক মিনিটের মাঝে তাদের গাড়ি হোটেলে পৌঁছে গেল। হোটেলের সিকিউরিটি গেট থেকে মূল হোটেলের দূরত্ব প্রায় সিকি মাইল। এই দূরত্বটুকু গাড়িগুলো খুব ধীরে ধীরে এগোলো।
রয়্যাল কোর্টের নিরাপত্তা কর্মীরা হোটেলের লবি ঘিরে রেখেছে। আলওয়ালিদ পরবর্তীতে তার বন্ধুদেরকে জানিয়েছিলেন হোটেলে ঢোকার সময় তার বেশ ভয় লেগেছিল, মনে হয়েছিল হোটেলটা ফাঁকা। রয়্যাল কোর্টের কর্মীরা আলওয়ালিদকে নিয়ে লিফটে উঠলো, তারপর তাকে একটি হোটেল সুইটে ঢুকিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে বলল। আলওয়ালিদের দুশ্চিন্তা হচ্ছে, সেই সাথে একটু বিরক্তিও লাগছে। সময় কাটাতে তিনি টেলিভিশন চালু করলেন। খবরে বলছে- কয়েক ডজন ব্যবসায়ী, রাজ পরিবারের সদস্য এবং কর্মকর্তাদেরকে দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়েছে। আলওয়ালিদ সবার আগে হোটেলে এসে পৌঁছেছেন। রিজ হোটেল এখন আর কোনো হোটেল নয়, এটাকে অস্থায়ী জেলখানায় রূপান্তর করা হয়েছে।
মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে আসা নির্দেশে হোটেলে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে। ২০১৭ সাল, নভেম্বরের ৩ তারিখ, শুক্রবারের শেষ বেলায় ইঞ্জিনিয়ারদের একটি টিম এসে রিজ-কার্লটন হোটেলে ৯টি তলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। হোটেলের ২০০টি রুমের দরজা থেকে তালা খুলে নিয়েছে তারা। পর্দা এবং বাথরুমের দরজাও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সিইও কিংবা জেট প্লেনে চড়ে আগত প্রিন্সদের জন্য হোটেলের কয়েকটি বড় সুইট সংরক্ষিত ছিল, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সেগুলোকে ইন্টারোগেশান রুমে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
রিজ-কার্লটনকে প্রথমে মূলত সফরে আসা বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের জন্য রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন হিসেবে ডিজাইন করা হয়েছিল।
মোটরগাড়ি শোভাযাত্রা নিয়ে হোটেলের বিশালাকার প্রধান ফটকে পৌঁছানোর জন্য চমৎকার একটি রাস্তা তৈরি করা আছে। সেই রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন পাম গাছ। যে জমির ওপর হোটেলটি নির্মাণ করা হয়েছে তা পুরোটাই নিকটবর্তী রয়্যাল কোর্টের মালিকানাধীন। ৫২ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে হোটেলটি। হোটেলের লনগুলো নিয়মিত পরিচর্যা করা হয়, চমৎকার করে সাজানো। লেবানন থেকে ৬০০টি জলপাই গাছ আমদানি করে লাগানো হয়েছে, সেগুলো হোটেল প্রাঙ্গনে ছায়ার জোগান দিয়ে থাকে। হোটেলের লবিটিও বেশ সুসজ্জিত, মেঝে ও দেয়াল জুড়ে মারবেল টাইলসের সমাহার।
একটি বিশালাকার ফুলের তোড়া দিয়ে হোটেলে আগত অতিথিদেরকে স্বাগত জানানো হয়। তারপর অতিথিদের সামনে দৃশ্যমান হয় ঘোড়ার নাটকীয় ভাস্কর্য আর কিছু টেবিল থেকে ভেসে আসে একধরনের হালকা সুবাস। ওই টেবিলগুলোতে কয়েকজন সৌদি নাগরিক তাদের মাথায় পরার রুমালে সুগন্ধী মাখায়; সেই বিশেষ রুমালের নাম- শেমাঘ।
২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এই হোটেলে অবস্থান করেছিলেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিনের মাঝে, সৌদি আরবে এক আড়ম্বর সফরে এসে, ডোনাল্ড ট্রাম্পও এখানে দুই দিন অবস্থান করে গিয়েছেন।
সেই রাতে হোটেলে গোয়েন্দা অফিসারদের একটি টিম এবং রয়্যাল কোর্টের কর্তারা এসে দ্রুততার সাথে পুরো হোটেলের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। হোটেলের প্রতিটি তলায় গার্ডদের ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং হোটেল থেকে বের হওয়ার পথগুলোতে গার্ড বসানো হয়েছিল। হোটেলের স্টাফদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল- যেসব সাধারণ অতিথিরা এই মুহূর্তে হোটেলে অবস্থান করছে, তাদেরকে বের করে দিতে হবে এবং যাবতীয় বুকিং বাতিল করে দিতে হবে।
“অপ্রত্যাশিতভাবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক হোটেল বুকিং হওয়ায় এখানকার নিরাপত্তা আরো জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, তাই স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনরায় চালু না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোনো অতিথিকে সেবা প্রদান করতে পারছি না,” এভাবে হোটেলের একজন স্টাফ মাত্র একদিন বাকি থাকতে এক ব্যবসায়ীর বুকিং বাতিল করে দিল। স্ক্রিপ্ট দেখে দেখে কথাগুলো বলল সে।
ভোর নাগাদ বিশেষ অতিথিগণ হোটেলে পৌঁছাতে শুরু করলেন। প্রথম কয়েক রাত, অনেক বন্দীকে স্রেফ একটি ফাংশন রুমে রাখা হয়েছিল। নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর তাদেরকে বাথরুম ব্যবহার করতে দেওয়া হতো। বাথরুমে যাওয়ার সময় একজন অস্ত্রধারী গার্ড যেত তাদের সাথে। তবে কয়েকজন বন্দীর জুব্বার ভাঁজের ভেতরে লুকোনো অবস্থায় ব্যাকআপ মোবাইল ছিল। কারণ- গার্ডরা তাদের প্রত্যেককে তল্লাশি করে একটা করে মোবাইল পেয়েই সন্তুষ্ট হয়েছিল, আর তল্লাশি করেনি।
সেই রাতে তোলা গোপন ছবিতে দেখা যায়, নিরুপায় অবস্থায় বন্দী ব্যক্তিরা পাতলা তোষকের ওপর শুয়ে আছেন, সস্তা রংচঙে কম্বল রয়েছে তাদের গায়ের ওপর। আরব বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিদের কয়েকজন সেই ছবিতে দেখা গিয়েছিল। তাদের কেউ কেউ সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী, বিলিয়নিয়ার টাইকুন, পুঁজিপতি এবং মন্ত্রী। সেই সাথে এক ডজন যুবরাজকেও সেখানে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। অবশ্য গোপনে তোলা ছবিগুলোতে এসবের কিছুই স্পষ্ট করে দেখানো হয়নি।
বন্দীদের মাঝে কারো কারো কাছে খুবই গোপন তথ্য রয়েছে, সেগুলো জানা দরকার। এখানে বন্দী হওয়া প্রায় সবাই অকল্পনীয় পর্যায়ের বিত্তশালী। তবে সৌদি আরবের নতুন ক্ষমতাসীন প্রশাসনের মতে, ওই বিত্ত-বৈভবের সবই হলো কয়েক দশক ব্যাপী চলমান দুর্নীতির ফসল।
বন্দীদের তালিকা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। সাবেক বাদশাহর পুত্র মিতেব বিন আবদুল্লাহ আল সৌদ রয়েছেন সেই তালিকায়! তিনি একজন ক্ষমতাশালী ব্যক্তি এবং সৌদি আরবের জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান। এটা মূলত সশস্ত্র বাহিনীদের নিয়ে গঠিত একটি বিশেষ শাখা। সৌদি রাজপরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এই বাহিনী গঠন করা হয়েছে।। সারা দেশ জুড়ে এই বাহিনীর ১,২৫,০০০ জন সদস্য নিয়োজিত রয়েছে। সামরিক ক্যু বা অভ্যুত্থান প্রতিহত করাও এই বাহিনীর দায়িত্ব, অথচ বাহিনীর প্রধানকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বন্দী করে রাখা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে মিতেব বিন আবদুল্লাহ আল সৌদকে একটা সময় সিংহাসনের সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। পরবর্তী কয়েক দিনের মাঝে আরো ৫০ জনের বেশি ব্যক্তিকে বন্দী করা হলো। আগামী কয়েক সপ্তাহ নাগাদ হোটেল রিজ এবং রিয়াদের বিভিন্ন নিরাপদ স্থানে ৩০০ জনেরও বেশি ব্যক্তি এভাবে “চেক-ইন” করবেন।
একটি গোপন দুর্নীতি দমন কমিটি এই গ্রেফতার কর্মকান্ড পরিচালনা করেছিল, সেই কমিটির পরিচয় এখনো অজানা রয়ে গেছে। সৌদি আরবের অ্যাটর্নি জেনারেল ঘোষণা করেছিলেন, বিগত কয়েক দশক ধরে চলে আসা দুর্নীতি এবং চুরি থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার ফেরত নিয়ে সরকারি কোষাগারে জমা করতে চান।
যদিও যাবতীয় গ্রেফতার কর্মসূচী বাদশাহ সালমানের নামে পরিচালনা করা হয়েছিল, কিন্তু সৌদি আরবে সবচেয়ে ধনী এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের গ্রেফতার করার পেছনে মূল কলকাঠি নেড়েছিলেন বাদশাহ ৬ষ্ঠ পুত্র- মোহাম্মদ। সৌদিকে যারা কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন তিন বছর আগে তারাও মোহাম্মদকে সেভাবে চিনতেন না। কিন্তু এখন সেই যুবরাজ সৌদি আরব এবং পুরো দুনিয়ায় রীতিমতো ঝড় তুলে দিয়েছেন।
নিজস্ব দর্জিকে দিয়ে বন্দীদের জন্য একই রকম দেখতে সাদা গাউন তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। গার্ডদের তত্ত্বাবধানে থাকাবস্থায় বন্দীরা টেলিভিশন দেখার এবং সপ্তাহে কয়েকবার ফোনকল করার সুযোগ পেতেন। বড় টাইলস দেওয়া সুইমিং পুল ছিল হোটেলে, সেই পুলের ওপরে ছিল একটি সুসজ্জিত গম্বুজ। গম্বুজের গায়ে নীল আকাশ আর মেঘ আঁকা। বন্দীরা সেই পুলে নামার সুযোগ পেতেন। পুলে একই সাথে মাত্র দুজন ব্যক্তি যাওয়ার অনুমতি ছিল। তবে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা একে অপরের সাথে কোনো কথা বলতে পারতেন না।
বন্দীদেরকে যেকোনো সময় জিজ্ঞাসবাদ করা হতো। রাত দুটোর দিকে ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো তাদেরকে। এভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখা এবং রয়্যাল কোর্ট অফিসার্স কর্তৃক কয়েক ঘণ্টা ব্যাপী জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়ে অপমানিত হওয়াটা অনেক বন্দীর কাছে রীতিমতো বিভীষিকার মতো ছিল।
বন্দীদের কারো কারো মনে হচ্ছিল, সৌদি আরব বিনির্মাণে তাদের ভূমিকা আছে। প্রভাবশালী নির্মাণ ঠিকাদারদের পাশাপাশি বন্দীদের মাঝে একজন ট্র্যাভেল কোম্পানির মালিকও রয়েছেন। তিনি হাজার হাজার সৌদি ছাত্রকে আমেরিকা এবং ইউরোপে পড়তে যাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করেছেন। বন্দীদের সাথে একজন সরকারি মন্ত্রীও আছেন, দেশের স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনৈতিক কাঠামো আধুনিকায়নের কাজ করেছেন তিনি। তবে এটা সত্য, কাজগুলো করতে গিয়ে তারা নিজেরা অনেক ধনী হয়েছেন। হয়তো সৌদি আরবের বিভিন্ন আইনও ভঙ্গ করেছেন। কিন্তু এরআগে কেউ তাদেরকে ক্রিমিনাল বলেনি। অবশ্য মোহাম্মদ বিন সালমান এখন যে চুক্তিগুলোতে দুর্নীতি খুঁজে পাচ্ছেন সেগুলোর সবকটাই সাবেক বাদশাহর ঘনিষ্ঠ ডেপুটিগণ কর্তৃক কিংবা স্বয়ং বাদশাহ কর্তৃক অনুমোদিত ছিল। তাদের কর্মকান্ডগুলো তখন গ্রহণযোগ্য ছিল, কিন্তু এখন নিয়ম বদলে গেছে।
বন্দীদের ওপর শারীরিক নির্যাতন এবং নিপীড়ন চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। মেজর জেনারেল আলী আল-কাতানি ছিলেন তুর্কি বিন আবদুল্লাহ আর সৌদের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান। তুর্কি বিন আবদুল্লাহ রিয়াদের সাবেক গভর্নর হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং তিনি সাবেক বাদশাহর পুত্র। জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালে মেজর আলী আল-কাতানি থুতু ফেলে জিজ্ঞাসাবাদকারীদের কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এরপর তার সাথে কী ঘটেছিল তা খুব বেশি মানুষ জানে না। তবে সবাই এটা জানে, সেই হোটেলে বন্দী থাকাবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছিল। তবে সৌদি আরব সবসময় নির্যাতনের অভিযোগগুলোকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
যা হোক, অনিচ্ছা সত্ত্বেও বন্দীরা সব মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তখন তাদের অর্থ এবং ক্ষমতার কোনো মূল্য ছিল না, কখনো কল্পনাও করেননি তাদেরকে এধরনের শারীরিক নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হবে। আলওয়ালিদ বিন তালালের ওপর চাপ বাড়ানোর জন্য মোহাম্মদ বিন সালমান তার ছোট ভাই খালিদ বিন তালালকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন। তবে দুর্নীতির অভিযোগগুলো জনসম্মুখে আনা হয়নি বা কোনো বন্দী তা স্বীকার করেনি; গোপনীয়তার সাথে পর্দার আড়ালে সব নিষ্পত্তি করা হয়েছিল।
তখনকার ঘটনাগুলোকে ২০২০ সালে বসে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, মোহাম্মদ বিন সালমানের সরকার দশ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি নগদ অর্থ এবং সম্পদ আদায়ের বিনিময়ে প্রায় সকল বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। বলা যায়, এই ঘটনার মধ্য দিয়েই মোহাম্মদ বিন সালমানের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল।
এজেন্ডা সংস্কার এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পরিকল্পনা ছাড়াও রিজ হোটেলে গ্রেফতারের ঘটনার মাধ্যমে এমন কিছু উন্মোচিত হয়েছিল যার ব্যাপারে পর্যবেক্ষক, কূটনীতিক এবং মোহাম্মদের নিজের পরিবারেরও ধারণা ছিল না, তা হলো : মোহাম্মদের ধূর্ত স্বভাব, কোনো কিছু বড় করে আয়োজন করার প্রতি ভালবাসা, ঝুঁকি নেওয়ার রুচি এবং নির্মম কর্মপন্থা।
এই ঘটনার আগপর্যন্ত মোহাম্মদ ছিলেন তার বাবার আগে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া পাঁচজন বাদশাহর মতো, যারা ধাপে ধাপে সংস্কার সম্পন্ন করে গিয়েছেন। নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ধরণ ছিল বটে, কিন্তু তাদের কেউ এভাবে ভিত্তিমূলে আঘাত করে দেশের ভবিষ্যৎ রূপরেখা বদলানোর কথা বিবেচনা করতেন না। রিজ হোটেলে নেওয়া আগ্রাসী সিদ্ধান্তটিকে পরবর্তীতে পশ্চিমাঞ্চলের অনেকেই “শেখডাউন” নামে ডাকতেন। মূলত এই শেখডাউন অপারেশনের মাধ্যমে মোহাম্মদ বিন সালমান দেশের স্থিতাবস্থার গোড়ায় ডিনামাইট স্থাপন করে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সব টুকরো টুকরো করে দিয়েছিলেন।
জঞ্জাল পরিষ্কার হতে হতে মিলিটারি, পুলিশ, গোয়েন্দা এজেন্সির সকল শাখা এবং সরকারি মন্ত্রণালয় সমূহের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে ফেলেছিলেন মোহাম্মদ বিন সালমান। শুধু তা-ই নয়, তিনি সরকারের অধীনে থাকা কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়গুলো নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। মোহাম্মদ বিন সালমান কোনো রাজা বা বাদশাহ নন, কিন্তু তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের একজন হয়ে উঠেছিলেন।
অনুবাদ এবং সম্পাদনা : সাঈম শামস্
তথ্যসূত্র : NBC News, The Book: Blood and Oil by Bradley Hope and Justin Scheck
আপনার মতামত জানানঃ