বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি কতটা গণতান্ত্রিক তা নিয়ে প্রশ্ন এখন বিশ্ব জুড়েই। এর মধ্যে আগামী ডিসেম্বরে এক গণতন্ত্র সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উদ্যোগে। আমন্ত্রিত শতাধিক দেশের একটি তালিকাও সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে। তবে আমন্ত্রিতদের ওই তালিকায় অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল ও পাকিস্তানের নাম থাকলেও, নাম নেই বাংলাদেশের।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পলিটিক্যাল জার্নাল পলিটিকো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমন্ত্রণের জন্য বিবেচিত শতাধিক দেশে নামের এই তালিকাটি প্রকাশ করেছে।
ঢাকা ও ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সম্মেলন প্রস্তুতি নিয়ে বিভিন্ন খবরের দিকে তাকিয়ে আছেন তারাও। তবে এখনি এ বিষয়ে তারা কিছু বলতে চান না।
কেন গুরুত্বপূর্ণ এই আমন্ত্রণ?
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউসের নীতি ও প্রচারণা বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যানি বোয়াজিন বাইডেনের এই সম্মেলন প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘অন্য যে কোনো সম্মেলনের চেয়ে এই সম্মেলনকে আলাদা হতে হলে যুক্তরাষ্ট্রসহ অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকটি দেশকে সামনের দিনগুলোর জন্য গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পথ অনুসরণের দৃঢ় অঙ্গীকার করতে হবে।’
যদিও ইতিমধ্যেই আমন্ত্রিত নেতাদের অনেককে নিয়েই প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। কারণ আমন্ত্রিত নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধেই একনায়কতন্ত্র চর্চার অভিযোগ রয়েছে, এমনকি কিছু ক্ষেত্রেই এইসব অভিযোগ প্রমাণিতও।
প্রসঙ্গত, গত বছর নির্বাচনী প্রচারণার সময়ই বাইডেন অঙ্গীকার দিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি প্রথম বছরেই বিশ্বে গণতন্ত্রকে উৎসাহিত করতে গণতন্ত্রমনা দেশগুলোকে নিয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করবেন। গণতন্ত্রের এই সংকটকালে এই সম্মেলন আলাদা তাৎপর্য পাচ্ছে।
এরপর চলতি বছরের গত ২১ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রথম বক্তব্যেও বাইডেন গণতন্ত্র সম্মেলন আয়োজনের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন। সে অনুযায়ী আগামী ৯ ও ১০ ডিসেম্বর বাইডেনের উদ্যোগে গণতন্ত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
ইতিমধ্যে সম্মেলনটি ভার্চুয়াল হবে বলেও জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, গোটা বিশ্বে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা থেকে দেশগুলোর বিচ্যুতি ঠেকাতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার জন্য প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছেন।
বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, এই সম্মেলন গণতন্ত্র নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি আলোচনার প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। আগামী বছর পরবর্তী সম্মেলন আয়োজনের পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এমনকি সেই সম্মেলনে অংশ নিতে দেশগুলোকে সংস্কারের জন্য শুধু অঙ্গীকার করলেই হবে না, সেই অঙ্গিকার পূরণও করতে হবে।
একই সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানাচ্ছেন; কোনো শর্ত দিচ্ছেন না। যুক্তরাষ্ট্র নিজেও তার গণতন্ত্র নিয়ে অঙ্গীকার করবে বলে জানা যায়।
বাংলাদেশ বাদ যাওয়ার কারণ
বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কয়েক বছর ধরে সমালোচকের ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে এ সমালোচনা নতুন মাত্রা পেয়েছিল; যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গত ৩০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর প্রকাশিত ‘মানবাধিকার চর্চার ওপর দেশভিত্তিক প্রতিবেদন ২০২০’-এ বাংলাদেশে নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক কারচুপি, অনিয়ম, গু.ম, নির্যাতন-নিপীড়ন , বিচারবহির্ভূত হ.ত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করা হয়।
এ বছর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশে রাজনৈতিক অধিকার চর্চার সুযোগ ও নাগরিক স্বাধীনতা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বলে উল্লেখ করা হয়। বিশ্বের ২১০টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে পুরোপুরি স্বাধীন নয় বরং ‘আংশিক স্বাধীন’ দেশগুলোর তালিকায় আছে। যা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য লজ্জার।
তবে আমন্ত্রিতদের তালিকা নিয়ে বিতর্কও আছে। পলিটিকোর ফাঁস করা তালিকা এবং দেশ বা সরকারগুলোকে আমন্ত্রণ জানানোর প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, ওই তালিকায় ফ্রান্স, সুইডেনের মতো পরিপূর্ণ গণতন্ত্রের দেশ যেমন আছে, তেমন গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির কারণে সমালোচিত ফিলিপাইন ও পোল্যান্ডের মতো দেশগুলোও আছে।
এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু রাষ্ট্র জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তবে বাদ পড়েছে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমন্ত্রিতদের মধ্যে আছে ইসরায়েল ও ইরাক; তবে মিসর ও তুরস্ককেও গণতন্ত্র সম্মেলনে ডাকছে না যুক্তরাষ্ট্র। এই ভেবে কিছুটা স্বস্তি চাইলে পেতেই পারে গণতন্ত্রের কবরের উপর ক্ষমতার গদি স্থাপন করা আওয়ামী লীগ।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
সব মিলিয়ে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো গণতন্ত্র প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছে। একই সাথে তারা চীনের কৌশলগত প্রভাব মোকাবেলায় বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে বাইডেন প্রশাসনের ছাড় দেওয়ারও সমালোচনা করেছে। বিশেষত তারা মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রশ্নে ভারতের মতো সমালোচিত দেশকে গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানোয় প্রশ্ন তুলেছে এই সম্মেলনের স্বচ্ছতা নিয়ে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বাইডেনের সম্মেলনে এমন অনেক দেশের আমন্ত্রণ পাওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে, যাদের গণতন্ত্রের অবস্থা বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে মোকাবেলার বিষয়টি মাথায় রেখেছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। যদি সম্মেলন সেভাবে আয়োজন করা হয়, তাহলে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্কের সুযোগ থাকবে।
এটি প্রমাণিত হলে, এমন হতে পারে যে অনেক দেশ শীর্ষ পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব না করে মন্ত্রী বা কর্মকর্তা পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করাচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত যদি গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো না হয়, তাহলে তা এ দেশের জন্য হয়তো কোনও সতর্ক বার্তা বলেই মনে করেন ইমতিয়াজ আহমেদ। তবে সেটা নিয়ে বিস্তারিত এখনই আগাম কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে এই আমন্ত্রণ না পাওয়া যে দেশের গণতান্ত্রিক সংবিধানের জন্য খুব একটা ভালো বিষয় নয়, সেটা নিয়ে দ্বিমত নেই অধিকাংশেরই।
তবে অনেকটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো ক’রে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘সম্মেলনে আওয়ামী লীগকে ডাকা হবে না, এমন তথ্য এখনো আমরা পাইনি। আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। আসলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অনেক অপপ্রচার চালানো হয় পৃথিবী জুড়েই। অনেকেই দেশের ভিতর ও বাইরে থেকে দেশের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকেন।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৩৩
আপনার মতামত জানানঃ