তালিবান শাসিত আফগানিস্তানে অর্থনৈতিক সংকট চরম রূপ ধারণ করেছে৷ বাড়ছে বেকারত্ব, বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম, চাকরি হারাচ্ছে মানুষ, হচ্ছে গৃহহীন৷ দেশটিতে কাজ হারানো অনেকের পেশাই এখন ভিক্ষা৷ এমনকি সরকারি কর্মচারীরাও করছেন ভিক্ষা। এই দায় কি এড়াতে পারবে পশ্চিমারা? তালিবানের আফগান দখলের পর সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের ৯৫০ কোটি ডলার আটকে দিয়েছিল আমেরিকা।
তালিবান সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের মুক্তির জন্য চেষ্টা চালালেও লাভ হয়নি। এর মধ্যে ভেঙে পড়েছে দেশটির অর্থনীতি। ক্ষুধা আর অপুষ্টিতে মারা যাচ্ছে শিশুরা। ভিক্ষার থালা হাতে পথে নামছেন সম্ভ্রান্ত আফগানরা। অথচ পশ্চিমারা ত্রাণ দিয়েই সব দায়িত্ব ঝেরে ফেলছে। ৯৫০ কোটি ডলার পকেটে পুরে, ত্রাণের নামে একটি জাতিকে মৃত্যুর দিকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া পশ্চিমারা কি আদৌ দায় এড়াতে পারবে আফগানিস্তানে প্রতিটা মৃত্যুর, প্রতিটা হত্যার?
বিধ্বস্ত আফগানিস্তান
চলতি বছরের আগস্ট মাসে কাবুলের দখল নেয় তালিবান৷ তারপর মোটামুটি সারা দেশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তারা। তবে দেশটির অর্থনীতি দ্রুত চরম বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে; যা তালিবানের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়৷ এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো আফগানিস্তান থেকে বিদায় নিয়েছে৷ বিদেশি সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর থেকে মূলত বিদেশের কোনো প্রকার অর্থনৈতিক সহায়তাই পাচ্ছে না আফগানিস্তান৷ উল্লেখ্য, আফগানিস্তানের নাগরিক সেবা সংশ্লিষ্ট খরচের তিন চতুর্থাংশই বিদেশি সহায়তা থেকে আসতো।
তালিবানের উত্থানের আগে গনি সরকারের শাসনে অনেক সরকারি-বেসরকারি কর্মচারি তালিবান আমলে চাকরি হারিয়েছেন৷ এ কারণে আগে থেকেই বিধ্বস্ত আফগান অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে বেকারত্বের বোঝা। ঘরে খাবার নেই, ব্যাংকে টাকা নেই, আয়ের পথ নেই। এমন ঘনঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে দেশটির অধিকাংশ পরিবার। তাছাড়া তালিবান শাসনে কর্মরতদের অনেকেই বেতন নিয়মিত পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স৷
খাদ্যপণ্যের তীব্র সংকট চলছে দেশটিতে। দাম বাড়ছে, আয় কমছে। ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছে মানুষ। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, পরিবারের তিনবেলা খাবার কেনার টাকা জোগাড় করতে, তারা এখন ঘরের আসবাবপত্র বিক্রি করছেন৷
সাবেক এক সরকারি কর্মকর্তা জানান, তিনি এমন কয়েকজন সাবেক চাকুরিজীবীকে চেনেন, যারা এখন অন্য উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করছেন। সক্ষম কেউ কেউ দিনমজুরের কাজ করছেন৷
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডাব্লিউএফপি)-র আফগানিস্তান শাখার প্রধান মেরি-এলেন ম্যাকগ্রোয়ার্টি জানান, আফগানিস্তানের অন্তত ৮৭ লাখ মানুষ এ মুহূর্তে না খেতে পারার অবস্থায় আছে৷ তিনি বলেন, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আফগানিস্তানে অচিরেই ভয়াবহ মানবিক সংকট দেখা দেবে। তবে বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরতদের এই সংকটের মুখে বা সংকট দেখা দিতে পারে; এমন বক্তব্যের ফাঁকফোকর দিয়ে সংকটের মাঝে বাস করছেন আফগানরা। অনাহারে থাকতে পারে এটা ভুল, অনাহারে আছেন আফগানরা। মানবিক সংকট দেখা দিতে পারে এটা ভুল- মানবিক সংকটে মধ্যেই আছেন আফগানরা।
পশ্চিমাদের দায়
২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঐতিহাসিক হামলা চালায় আল-কায়েদা৷ এই হামলার এক মাস পরেই মার্কিন সৈন্যরা আফগানিস্তানে অভিযান চালায়। উদ্দেশ্য আল-কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে বের করা৷ এখানেই শুরু; দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির চেহারা বদলে গেছে এরপর। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে আফগানিস্তান। মার্কিন সেনারা তালিবানদের উচ্ছেদ করলেও, আজ আফগানিস্তানের গদিতে সেই তালিবানই চেপে বসে আছে। পরিস্থিতি শুধু আগের চেয়ে সংকটময়। অমানবিক জীবনযাপন করছে দেশটির মানুষ।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে বিধ্বস্ত আফগানিস্তান কিন্তু একা ভুগবে না, ভুগবে প্রতিবেশী দেশগুলোও। যার ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় দেখা দেবে অস্থিতিশীলতা। বাড়বে জঙ্গি সংগঠনগুলোর কার্যক্রম। বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিমারা এই সুযোগ নিতে দ্বিতীয়বার ভাববে না। এমনিতেই দক্ষিণ এশিয়ার ড্রাইভিং সিটে বসা নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বহুকাল থেকেই চলছে আধিপত্য বিস্তারের খেলা।
এর সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিয়ে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে শরণার্থী সংকট চরম রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)৷ স্বভাবতই এ পরিস্থিতিকে আফগানদের এবং আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্যও বিপদজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
সংস্থাটি বলেছে, আফগানিস্তানের অর্থনীতি চলতি বছর ৩০ শতাংশ অব্দি সঙ্কুচিত হতে পারে। যা হলে দেশটির লাখ লাখ মানুষ চরম দারিদ্রের মধ্যে পড়বে। এর প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলোর উপরও নানাভাবে পড়বে বলে মনে করছে আইএমএফ৷
মূলত যুদ্ধ, পশ্চিমাদের বিশ্বাসঘাতকতা; এরপর খরা এবং করোনা মহামারির মাঝে আফগানিস্তান এখন চরম মানবিক সংকটের মুখোমুখি৷ আর এই দায় পশ্চিমারা এড়াতে পারবে না। কারণ ধ্বসে পড়া অর্থনীতির দেশটির ৯৫ বিলিয়ন ডলারের সম পরিমান অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পড়ে আছে৷ তালিবান সরকার তা তুলতে পারছে না আমেরিকার বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে৷
আফগানিস্তানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র আহমদ ওয়ালী হকমাল সম্প্রতি রয়টার্সকে বলেন, ‘টাকা আমাদের। এগুলো আফগান জাতির টাকা। আমাদের নিজেদের টাকা আমাদের দিন। এই টাকা আটক করে রাখা নৈতিকতার পরিপন্থী এবং আন্তর্জাতিক আইন ও মূল্যবোধ বিরোধী।’
এদিকে দেশটির মধ্যে নির্দিষ্ট অঙ্কের বেশি টাকা তোলার কারণে, তালিবান নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় অনেকে নিজের জমানো টাকাও প্রয়োজনমতো তুলতে পারছেন না৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৪২০
আপনার মতামত জানানঃ