রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর ছিল বিশ্বের বেশ কিছু দেশে। তবে এই শতাব্দীতে এসে সে চিত্র বদলে গেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীর অনেকে দেশে গণতন্ত্র আছে কেবল নামে মাত্র। বিংশ শতাব্দীর মতো সরাসরি সামরিক শাসন না থাকলেও, অনেক দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো আবির্ভূত হয়েছে সামরিক একনায়ক হিসেবে। আর টক অব দ্য টেবিলে বাংলাদেশে উঠে আসছে বেশ প্রাসঙ্গিকভাবেই। গণতান্ত্রিকভাবে স্বৈরতন্ত্রকে ভরণপোষণের রোল মডেল হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি। আর স্টিয়ারিং হাতে আওয়ামী লীগ যেন তার অভিজ্ঞ ড্রাইভার।
ভোটের ফাঁকা মাঠেও আ’লীগের সহিংসতা
দেশে কয়েক ধাপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন। তবে গুরুত্ব ভেসে গেছে সহিংসতার বানে। প্রতিযোগিতার নাম-গন্ধ নেই। আছে সন্ত্রাস। আছে লাশের গন্ধ। আহতের চিৎকার। ভোটারদের নিরাপত্তাহীনতা। মানুষের অসহায়ত্ব আর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার অপচেষ্টা।
গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী, চলতি বছরে প্রথম ও দ্বিতীয় দফার ইউপি নির্বাচনে সংঘর্ষে এখন অব্দি নিহত হয়েছেন প্রায় ৪৬ জন। তৃতীয় দফা ইউপি নির্বাচনে, বছর শেষে এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এমনকি গতকাল মঙ্গলবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন মানুষ। মাছের মায়ের কান্না শোকের মতো ইউপি নির্বাচনে প্রাণহানি ও সহিসংতায় উদ্বেগ জানিয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও জোটের মুখপাত্র আমির হোসেন আমু সহিসংতা বন্ধে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সহিংসতার কারণে মানুষ ভোট দিতে ভয় পাচ্ছে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন, মানুষ কাকে ভয় পাচ্ছে। কেন এই সহিংসতা। রাজনীতিতে বিএনপি বা অন্য যে কোন বিরোধী দলের অবস্থা নখদন্তহীন বাঘের মতো। তারা সহিংসতায় জড়িত নয়। জড়িত আওয়ামী লীগ এবং প্রকাশ্যেই। দলটির তৃণমূলে বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে কোন্দল। এই ইউপি নির্বাচনে দলটির মনোনীতদের থেকে বিদ্রোহীতে সংখ্যা ছিল বেশি।
সূত্র মতে, তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে এক হাজার তিনটি চেয়ারম্যান পদের ৯৮১টিতে আওয়ামী লীগ মনোনীতরা মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও দলটির ‘বিদ্রোহী’ হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন ৯৯৯ জন। অর্থাৎ মনোনীতদের থেকে বিদ্রোহীদের সংখ্যা ছিল বেশি; যা মূলত দলটির মধ্যকার অস্থিতিশীলতাকে সামনে নিয়ে এসেছে।
দেশের রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাবে চলতি ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৪০ জন। সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ২১০ টি। সংঘর্ষে আহত হয়েছেন আরও দুই হাজার ৫৪৩ জন।
এছাড়া এই সময়ে পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মারা গেছেন একজন। পাশাপাশি শুধু গণমাধ্যমের হিসাবে, নভেম্বর মাসেই সহিংসতায় মারা গেছেন ৬ জন।
নির্বাচনী সহিংসতা নিয়ে বিব্রত ও চিন্তিত খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা। তিনি সম্প্রতি বলেছিলেন, সহিংসতা বন্ধে নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে আলোচনা করে মাঠপর্যায়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছে ইসি। এরপরও বন্ধ করা যাচ্ছে না সহিংসতা।
উল্লেখ্য, দ্বিতীয় ধাপের ৮৪৬টি ইউনিয়নে আগামীকাল বৃহস্পতিবার এবং তৃতীয় ধাপের ১ হাজার ১টি ইউনিয়নে ২৮ নভেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই বাড়ছে সহিংসতা, মৃত্যু আর ভয়ের রাজনীতি।
নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। ভোটের ফাঁকা মাঠেও আওয়ামী লীগ ও এর বিদ্রোহী প্রার্থীরা ঝরাচ্ছে রক্ত। সংশ্লিষ্টদের মতে, ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকেরা নিজেদের মধ্যে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ায় তা নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই বেকায়দায় রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও।
আ’লীগের নির্বাচনী ইতিহাস
২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বরের নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার আমূল পরিবর্তন আসে। পর্যবেক্ষকদের মতে, বাংলাদেশের সাধারন নির্বাচনের ইতিহাসে ২০০৮ সালের নির্বাচনটি ছিল সর্বশেষ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। একই সাথে দেশে একনায়কতন্ত্রের শুরু ওখানেই। আজকের বাংলাদেশের বীজ বোনা ছিল সে দিনের নির্বাচনে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ একটানা ১৩ বছর ক্ষমতায় রয়েছে।
এরপর ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে আরো দুটি সাধারন নির্বাচন হলেও সে সব নির্বাচনের স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। নাগরিকদের ভোটাধিকার খর্ব হয়েছে। গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। স্বৈরশাসনের পথে হেঁটেছে বাংলাদেশ। হাঁটছে এখনও।
২০১৮ সালে বিবিসির ক্যামেরায় সরাসরি ধরা পড়ে আওয়ামী লীগের ভোটচুরির ঘটনা। বিশ্বের সামনে ঘটে যায় এক লজ্জাজনক ইতিহাস। প্রকাশ্যেই কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। যা কিনা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে পুরোপুরি পরিপন্থি। সূত্র মতে, ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৮ ভোরবেলা চট্টগ্রামের এক কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরুর আগে আগে ব্যালটবক্সগুলো বিভিন্ন বুথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। কিন্তু অবাক করা করা বিষয়, বিবিসির এক সাংবাদিক দেখতে পান ব্যালটবক্স সবগুলোই ভর্তি! তখনও ভোট শুরু হয়নি।
প্রিজাইডিং অফিসারের কক্ষে গেলে, সেখানেও ব্যালটবক্স ভর্তি দেখতে পান ওই সাংবাদিক। ওই সাংবাদিক তার হাতে থাকা মোবাইল ফোনেই ছবি ও ভিডিও ধারণ করেন। পরে এ ব্যাপারে ওই ভোটকেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ ব্যাপারে কোন কথা বলতে পারবেন না বলে জানান। এমনকি কীভাবে এসব ব্যালট বক্স ভর্তি হলো, তাও তিনি জানেন না বলে জানান।
অনেকটা যেন গণতন্ত্র দেশটিতে আর জীবিতি নেই। নির্বাচনগুলো কীভাবে হচ্ছে, তাতে জনগণ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ কেমন, যারা নির্বাচন আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত, তারা কী ভূমিকা পালন করছে, জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারছে কি না, সেগুলো যেন আর বিবেচনারই বিষয় নয়। বিষয় একটিই- আওয়ামী লীগ। দল একটিই- আওয়ামী লীগ। আদর্শ একটিই- আওয়ামী লীগ।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০৮
আপনার মতামত জানানঃ