প্রতি দুই দশকে মাত্র একবার চীনে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে গৃহীত হয় দেশটির ভাগ্য ও নীতিনির্ধারণী সব সিদ্ধান্ত। আগামী ২০২২ সালে চীনা কম্যুনিস্ট পার্টি কংগ্রেসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে এ অধিবেশনে গত ৪০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তৃতীয়বার ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেন শি জিনপিং, যা তার আজীবন শাসনের পথ নিশ্চিত করবে।
এর আগেও চীনের সমাজতন্ত্রী দলের দু’জন নেতা বদলে দিয়েছে চীনের ইতিহাস। তারা হলেন মাও সেতুং ও ডেং জিয়াওপিং। এই দুই বিখ্যাত নেতা চীনের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁক পরিবর্তনের মুহূর্তে দেশটির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তারাও ক্ষমতায় ছিলেন আজীবন। শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগপর্যন্ত তারা নিজ দল ও দেশের ভবিষ্যৎ রচনায় প্রধান ভূমিকা রেখেছেন। এবার চীনের ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তৃতীয় ব্যক্তিটি হবেন কিনা এখন সেটাই দেখার অপেক্ষায় গোটা বিশ্ব।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সর্বময় ক্ষমতা চিরকাল ধরে রাখলে, শি জিনপিং দলের মহান এ দুই নেতার কাতারে যেমন উঠে আসবেন। যা মূলত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতিতে আসন্ন বড় পরিবর্তনেরও সংকেত দিচ্ছে। বিশ্ব রাজনীতির কক্ষপথকেও যে ঘটনা বড়সড় পরিবর্তনের মুখে নিয়ে যাবে।
সিক্সথ প্লেনাম কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
তবে এর আগে গতকাল ৮ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া ‘সিক্সথ প্লেনাম’ শীর্ষক সম্মেলন চলবে আগামী ১২ তারিখ পর্যন্ত। এই সম্মেলন চীনের জন্য গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনী প্রচারণার মতোই টানটান উত্তেজনাকর। তাই এই বৈঠকে নিজ ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ধারণের চেষ্টায় দলীয় সমর্থন চান শি জিনপিং।
গত এক দশক ধরে দলের ভেতরে প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন ও জাতীয় মর্যাদা বৃদ্ধিতে তৎপর ছিলেন শি জিনপিং। তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আজীবন ক্ষমতা পেলে এই প্রবণতা বেড়ে যাবে এবং সত্যিকার অর্থেই চীনের ইতিহাসে সর্বোচ্চ নেতাদের সারিতে নাম লেখাবেন শি।
মূলত দুটি দলীয় কংগ্রেসের মাঝের সময়টাতে সমাজতন্ত্রী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান নেতারা ৭ বার ‘প্লেনাম’ বৈঠকে যোগ দেন। ৪ দিনের এই শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে রাজ্য পর্যায়ের নেতৃত্ব, সামরিক বাহিনীগুলোর প্রধান ও আঞ্চলিক শাসকসহ প্রায় ৪০০ জনের বেশি নেতা দেশটির নানা প্রান্ত থেকে রাজধানী এসেছেন। যদিও গত কিছুদিন বেজিংয়ে কোভিড সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই অতিরিক্ত মাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। বৈঠকে প্রবেশ ও বেরোনোর ক্ষেত্রেও রয়েছে অনেক কড়াকড়ি।
এই বৈঠকে মূলত গুরুত্ব পায় জাতীয় অর্জন, দলের নীতিনির্ধারণ এবং অর্থনীতিসহ নানা বিষয়। যদিও এই বৈঠকের প্রধান এজেন্ডাও থাকে অতি গোপনীয়। মূলত চীনের শীর্ষ পর্যায়ের রাজনীতি সব সময়েই রহস্যের চাদরে মোড়া। বৈঠকের পর সমাজতন্ত্রী দলের বিবৃতিতে যা জানানো হয়, তার বাইরে জনসাধারণের জানার সুযোগ একেবারে নেই বললেই চলে।
‘সিক্সথ প্লেনাম’ অন্য সম্মেলনগুলোর থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ এটি চীনের পাঁচ বছর মেয়াদি রাজনৈতিক চক্রের সর্বশেষ বৃহৎ বৈঠক। আগামী বছরের পার্টি কংগ্রেসের আগে এটিই শীর্ষ আইনপ্রণেতাদের গোপনীয় আলোচনার শেষ সুযোগ। যার প্রস্তুতি হিসেবে চলতি বছর পলিটব্যুরো কমিটি প্রস্তুত করেছে ‘শত বছরে সমাজতন্ত্রী দলের শীর্ষ অর্জন ও ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক একটি খসরা প্রস্তাবনা।
চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জানেন, ১৯৮১ সালে ডেং জিয়াওপিং তার ঐতিহাসিক প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছিলেন পূর্বসূরী মাও সেতুং এর অনেক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে। ওই প্রস্তাবনায় মাওকে দায়ী করা হয় সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কারণে দুর্ভিক্ষ ও অজস্র মানুষের মৃত্যুর জন্য। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত একই পর্যায়ের এক সম্মেলনে সমাজতন্ত্রী দল শি জিনপিংকে ‘প্রধান’ নেতা হিসেবে উল্লেখ করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এর আগে ডেং, মাও ও জিয়াং জেমিনকে এমন বিশেষণ দেওয়া হয়েছিল, যারা প্রত্যেকেই দলের প্রতিটি সিদ্ধান্তে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
চীনে ইতিহাসে এই প্রস্তাবনার গুরুত্ব
১৯৪৫ সালে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি দেশটির ক্ষমতায় আসার চার বছর আগে নিজের ঐতিহাসিক প্রস্তাবনা পেশ করেছিলেন মাও সেতুং। ‘কিছু প্রশ্নের উত্তর ও আমাদের দলের ইতিহাস’ শীর্ষক ওই নথিতে পরিষ্কার লক্ষ্যের কথা জানান তিনি। মাও সেখানে দলকে নেতৃত্বদানে তার অবস্থানকেই ‘সঠিক রাজনৈতিক পথ’ বলে উল্লেখ করেন। এর মধ্য দিয়ে চীনে কয়েক দশক ধরে ব্যক্তি-নির্ভর রাজনীতির পথ সুগম হয়।
১৯৮১ সালে মাওয়ের মৃত্যুর পর দলের ভেতরে নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। তখন ডেং তার প্রস্তাবনার ভাষণ দেন। তখন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বিশাল ক্ষতির কথা উল্লেখ করে মাওয়ের দূরদর্শীতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ডেং। এভাবে চীনকে নেতৃত্বদানে তিনিও নিজের লক্ষ্যকেই সঠিক পথ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ডেং চীনের প্রেসিডেন্ট না হয়েও দেশটির অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করার পাশাপাশি ব্যক্তি-পূজারী মতাদর্শে বিশ্বাসী নেতাদের কোণঠাসা করেছিলেন
কানাডার ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উ গুগুয়াং এজন্যই এসব প্রস্তাবনাকে অসীম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। তিনি একে ‘নথির রাজনীতি’ বলে উল্লেখ করে থাকেন। মূলত এই নথিতে ক্ষমতাসীন অভিজাতদের সিদ্ধান্তই লেখা থাকে।
সূত্র মতে, প্রস্তাবনা নথি তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে সমর্থন ও বিরোধিতার গোপন রাজনীতি চলে দলটির অভিজাতবর্গের মধ্যে। যেহেতু প্রস্তাবনার পেছনে প্রয়োজন সিংহভাগ নেতাদের সমর্থন, তাই এ ধরনের প্রস্তাবনা প্রকাশিত হওয়ার ঘটনা শি জিংপিংয়ের পেছনে ঐক্যমত্যের সমর্থনই তুলে ধরেছে বলে মনে করেন উ গুগুয়াং।
দুর্নীতিবিরোধী গভর্নর থেকে আমৃত্যু ক্ষমতায়
শি জিনপিং চীনের প্রবীণ বিপ্লবী শি জংঝুনের সন্তান। জংঝুন দেশটির সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। একটি অভিজাত ও প্রথিতযশা পরিবার থেকে উঠে এসেছেন শি। এমনকি এজন্য তাকে রাজপুত্র হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। তবে ১৯৬২ সালে তার বয়স যখন ১৩, তখন দেশটির সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আগে শুদ্ধি অভিযানে তার বাবাকে গ্রেফতার করা হয়।
এরপর ১৯৬৪ সালে চেয়ারম্যান মাও দেশের কয়েক লাখ তরুণকে শহর থেকে গ্রামে পাঠানোর ঘোষণা দেন। তরুণরা যাতে গ্রামের কৃষক-প্রজাদের কঠিন জীবনযাপন বুঝতে পারেন, সেজন্য এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৫ বছরের তরুণ শিকেও সাংস্কৃতিকভাবে পুনর্বাসনের জন্য প্রত্যন্ত ও দরিদ্র গ্রাম লিয়াংজিয়াহে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি ৭ বছর কঠোর পরিশ্রম করেন। গ্রামটিতে অবস্থানকালে কিশোর শি জমিতে সার দেয়া, বাঁধ তৈরি ও সড়ক মেরামত করা শেখেন।
এরপর ২২ বছর বয়সে শি সেই গ্রাম ছেড়ে চলে আসেন। ১৯৬৯ সালে দলের সেক্রেটারি হন এবং ১৯৯৯ সালে ফুজিয়ান প্রদেশের গভর্নরও নির্বাচিত হন শি। পাশাপাশি ওই বছর তিনি দলীয় শীর্ষ নীতিনির্ধারণী ফোরাম পলিট ব্যুরোর স্থায়ী কমিটির সদস্য হন। ২০০০ সাল থেকে শি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ২০১২ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন পেয়ে ক্ষমতার সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহন করেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী বছর টানা দু’বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শি জিনপিংয়ের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। যদিও তার দল তৃতীয় বারের জন্যও তাকেই ফের দেশের প্রেসিডেন্ট করবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর আগে চিনের কোনও নেতাই পরপর দু’বারের বেশি দেশের প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে পারতেন না। ২০১৮ সালে সংবিধান বদলে এই নিয়মে পরিবর্তন আনেন শি। তার পূর্বসূরি হু জিনতাও দু’বারের মেয়াদ পূর্ণের পরে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে যান। তবে শি-র ক্ষেত্রে তা হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। মাওয়ের পরে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আর কোনও নেতা শিয়ের মতো ক্ষমতা ভোগ করেননি বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪০০
আপনার মতামত জানানঃ