১৮৯৮ সালে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ম্যারি কুরি রেডিয়াম আবিষ্কার করেন। রেডিয়ামের মায়ায় মুগ্ধ ছিলেন কুরি। বলতেন, “আমার সুন্দর রেডিয়াম”। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা সত্য একসময় মানুষ রেডিয়াম মিশ্রিত তেজস্ক্রিয় পানিকে সব ধরনের রোগের মহৌষধ মনে করেছিল।
এমনকি আরোগ্য লাভের আশায় বিত্তশালীদের অনেকে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে মারাত্মক প্রাণঘাতী এই পানীয় কিনতেন। মানুষের শরীরের টিস্যু ধ্বংস করার ক্ষমতা থাকায় একে ক্যান্সারের চিকিৎসায় কাজে লাগানো হয় অচিরেই।
রেডিয়াম আবিষ্কারের পরপরই এর উন্মাদনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সর্বক্ষেত্রে। নিত্যদিনের ব্যবহার্য বস্তু; যেমন: টুথপেস্ট, প্রসাধনী, এমনকি খাবার এবং পানীয়তেও ব্যবহার করা হয় রেডিয়াম। এমন একটি দ্রব্য ছিল রেডিথর, যা মূলত ডিস্টিলড ওয়াটার এবং রেডিয়ামের মিশ্রণ ছাড়া আর কিছুই না। অথচ বিজ্ঞাপনে একে ‘জীবন্মৃতের নিরাময়’ তথা ‘A Cure for the Living Dead’ বা ‘Perpetual Sunshine’ বলে প্রচার করা হতো। বাতের ব্যথা থেকে শুরু করে আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসায়ও এটি ব্যবহৃত হতো!
যদিও আজকের পৃথিবীতে রেডিওঅ্যাকটিভ পদার্থ সম্পর্র্কে আমরা যা জানি তাতে এমন জিনিস পান করা দূরে থাক, কেউ ছুঁয়েও দেখতে চাইবে না। কিন্তু ২১ শতকের শুরুতে সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণিতে রেডিথর নামের এই তেজস্ক্রিয় এক পানীয় অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ওই সময়ে রেডিথর ছাড়াও বাজারে আরও কিছু তেজস্ক্রিয় তরল ওষুধ হিসেবে বিক্রি করা হতো। এমনকি দাবি করা হয়েছিল যে, এই ওষুধের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। দুর্বলতা, শারীরিক অক্ষমতা এমনকি ক্যান্সারের চিকিৎসাতেও এই পানি কার্যকর করে দাবি করা হতো।
কিন্তু, বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। রেডিথর সেবনের পর সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে ধীরে ধীরে ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে মানুষ।
রেডিথর ছিল মূলত ডিস্টিলড ওয়াটার যেখানে রেডিয়াম এবং মেসোথরিয়াম, এই দুটো তেজস্ক্রিয় উপাদান মিশ্রিত ছিল। দুই আউন্সের ছোট শিশিতে এই তরল বিক্রি করা হতো। প্রতিটি শিশিতে অন্তত ১ মাইক্রোকুরি পরিমাণ রেডিয়াম-২২৬ এবং রেডিয়াম-২২৮ থাকার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল।
নিউ জার্সির ইস্ট অরেঞ্জের বেইলি রেডিয়াম ল্যাবরেটরিজ ছিল রেডিথর প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। তাদের দাবি অনুযায়ী, এই তরল এনার্জি ড্রিংকের মতোই শরীরকে চাঙা করে তুলবে।
তারা আরও দাবি করে বলে যে অ্যানোরিক্সিয়া, হিস্টিরিয়া, অনিদ্রাজনিত সমস্যাগুলোও দূর করবে এই পানীয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই রেডিথরের সবচেয়ে বড় ভক্তের ভয়ঙ্কর পরিণতি এই সমস্ত দাবিকে মিথ্যা প্রমাণিত করে।
আমেরিকান শিল্পপতি ইবেন বায়ারস তার চিকিৎসকের পরমর্শে রেডিথর সেবন শুরু করেন। সূত্র মতে, হার্ভার্ড-ইয়েলের এক ফুটবল ম্যাচ শেষে পার্টি করতে গিয়ে তিনি হাতে আঘাত পেয়েছিলেন। দ্রুত সেরে উঠতে চিকিৎসক তাকে রেডিথর সেবনের পরামর্শ দেন।
১৯২৭ সালের ডিসেম্বর থেকে বায়ারস এই পানীয় সেবন শুরু করেন। তিনি প্রতিদিন তিন বোতল রেডিথর পান করতেন। পরবর্তী বেশ কয়েক বছর রেডিথর সেবন অব্যাহত রাখেন বায়ারস।
বায়ারস মনে করেছিলেন তার সার্বিক সুস্থতা ও ভালো হয়ে ওঠার পেছনে রেডিথর কাজ করছে। আর তাই তিনি বন্ধুবান্ধব ও সহযোগী ব্যবসায়ীদেরও উপহার হিসেবে রেডিথর পাঠাতে শুরু করেন। নিজের প্রেমিকাকেও সবসময় রেডিথরের শিশি সঙ্গে রাখতে উদ্ধুদ্ধ করেন তিনি।
এমনকি রেসের ঘোড়াগুলোকেও তিনি এই তেজস্ক্রিয় তরল সেবন করাতেন। ১৯৩০ সাল পর্যন্ত তিন বছরে তিনি প্রায় ১৪০০ বোতল রেডিথর গ্রহণ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
১৯৩০ সালের দিকে ৫০ বছর বয়সী ইবেন বায়ারসের শরীরে রেডিয়ামের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেতে শুরু করে। প্রথমেই তার দাঁত পড়তে শুরু করে। ১৯৩১ সালে রেডিথর প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের উদ্দেশ্যে বায়ারসের সঙ্গে দেখা করতে যান ফেডারেল ট্রেড কমিশনের অ্যাটর্নি রবার্ট হাইনার উইন। বায়ারসের শারীরিক অবস্থা দেখে তিনি স্তম্ভিত হয়ে পড়েন।
উইনের প্রতিবেদন অনুসারে, ইবেন বায়ারস যখন তাকে স্বাগত জানান, তখন তার নিচের চোয়াল ও চিবুক আর অবশিষ্ট ছিল না। ৫১ বছর বয়সী বায়ারসের নাকের নিচে এক টুকরো হাড়ে কোনোমতে কেবল দুটো দাঁত আটকে ছিল।
১৯৩২ সালের টাইম ম্যাগাজিনে উইন ঘটনার বিবরণ দিয়ে লিখেন, এত জাঁকজমকপূর্ণ এক বাড়িতে এমন ভয়াবহ দৃশ্য অকল্পনীয়। বয়সে তরুণ এবং চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণ সক্রিয় থাকা সত্ত্বেও তিনি সেভাবে কথা বলতে পারতেন না। তার মাথা ছিল ব্যান্ডেজে মোড়ানো।
পরপর দুটি অপারেশন করেছিলেন বায়ারস। অপারেশনে ওপরের চোয়াল, সামনের দুটি দাঁত বাদে তার নিচের চোয়ালের বেশিরভাগ অংশ অপসারণ করা হয়েছিল। শরীরের অবশিষ্ট হাড়ে থেকে টিস্যু ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল এবং মাথার খুলিতে সত্যিকার অর্থেই গর্ত তৈরি হচ্ছিল।”
১৯৩২ সালে মারা যান ইবেন বায়ারস। বায়ারসের মৃত্যুর পরই রেডিথর বন্ধ হয়। বেইলি রেডিয়াম ল্যাবরেটরিজের বিরুদ্ধে বায়রসের সাক্ষ্যপ্রমাণ ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী। পরবর্তীতে ফেডারেল ট্রেড কমিশনের মামলার সামনে প্রতিষ্ঠানটি আর টিকতে পারেনি।
তবে, বন্ধ হলেও রেডিথরের সমর্থক কিন্তু কম ছিল না। এমনকি চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের অনেকেই এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। ১৯১৮ সাল থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত রেডিথর উৎপাদিত হয়।
তবে, ইবেন বায়ারস ছাড়া অন্যান্য সেবনকারীদের কী অবস্থা দাঁড়িয়েছিল, সে সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য জানা যায় না। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, রেডিথর বেশ দামি ছিল বলেই তা খুব বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেনি।
এমনকি ইবেন বায়ারসের মৃত্যুর পর তাকে সীসার আবরণ বিশিষ্ট কফিনে দাফন করা হয়, যাতে তার হাড় থেকে রেডিয়েশন ছড়াতে না পারে।
১৯৬৫ সালে এমআইটির একজন গবেষক বায়ারসের দেহাবশেষ থেকে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ বের করতে গিয়ে চমকে যান। রবলি ইভানস নামের ওই গবেষকের হিসাব অনুযায়ী, বায়ারসলে দাফনের সময় তার দেহে রেডিওঅ্যাক্টিভিটির পরিমাণ ছিল প্রায় এক লাখ বেকেরেল।
রেডিয়ামের অর্ধজীবন ১৬০০ বছর হওয়ায় উত্তোলিত দেহাবশেষে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ একই রকম বলেও জানান তিনি। তবে, কেবলমাত্র তার হাড়েই তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ ছিল প্রায় দুই লাখ ২৫ হাজার বেকেরেল।
বায়ারস খুব সম্ভবত হাড়ে তেজস্ক্রিয়তার প্রতিক্রিয়া বুঝতে দেরি করে ফেলেছিলেন। তিনি যে পরিমাণ রেডিথর সেবন করেছিলেন, তা আগে কেউ করেনি বলেই হয়তো এর ভয়াবহতাও সেভাবে সামনে আসেনি।
ইবেন বায়ারসের দেহাবশেষ পুনরায় সেই সীসার আবরণযুক্ত কফিনেই দাফন করা হয়। আজও তিনি সেখানেই রয়েছেন, আগের মতোই তেজস্ক্রিয়।
মূলত সেবনের পর রেডিয়াম হয়ে ওঠে অত্যন্ত বিপদজনক। কারণ, এটি অনেকটা ক্যালসিয়ামের মতো আচরণ করে। এর ফলে মানবদেহ একে ক্যালসিয়াম হিসেবে হাড়ের গঠনের কাজে ব্যবহার করে। এর ফলস্বরূপ পরবর্তীতে তেজষ্ক্রিয়তায় হাড়ের ক্ষয়, অস্থি ক্যান্সারের আক্রান্ত হয়। কবে আক্রান্ত হবে তা নির্ভর করতো ব্যক্তির রেডিয়াম গ্রহণের মাত্রার ওপর।
এসডব্লিউ/এসএস/১০৩৩
আপনার মতামত জানানঃ