দীপাবলির রাতে আলোক ঝলকানো উৎসব শেষে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে গিয়েছিলেন ভারতের রাজধানী শহর দিল্লির বাসিন্দারা। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে আর সূর্যের মুখ দেখতে পাননি তারা। কারণ, গোটা শহর ঢাকা পড়েছে দূষিত বায়ুর গাঢ় কুয়াশায়।
দিল্লিতে সবরকম বাজি ফাটানোই নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু দীপাবলির রাতে এমন দৃশ্য দেখা গেছে দিল্লির বহু এলাকায়। সন্ধে ৭টা থেকে লাজপতনগর, পশ্চিম দিল্লি, বুরারি, পশ্চিম বিহারে বিপুল বাজি ফেটেছে। পুলিশের চোখের সামনেই রাস্তায় নেমে মানুষ বাজি ফাটিয়েছেন।
দূষণ নিয়ন্ত্রণে ভারত সরকার আতশবাজি পোড়ানোয় যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, তা কোনো কাজেই আসেনি। বরং শুক্রবার (৫ নভেম্বর) সকাল থেকেই চলতি বছরে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে হচ্ছে দিল্লিবাসীকে।
বৃহস্পতিবার রাত থেকেই দূষণের মাত্রা বাড়তে থাকে দিল্লিতে। শুক্রবার সকালে ধোঁয়াশার হালকা চাদরে ঢেকে গেছে দিল্লি। চোখ জ্বালা করছে। বৃহস্পতিবার রাতে দিল্লির দূষণ অতি ভয়ংকর বা সিভিয়ারে পৌঁছে গিয়েছিল। শুক্রবার সকালে তা হ্যাজারডাস সূচকে আছে। দিল্লির আশপাশের শহরগুলির পরিস্থিতিও ভয়াবহ। নয়ডা, ফরিদাবাদ, গাজিয়াবাদে বিপুল বাজি ফেটেছে।
পরিবেশবিদদের একাংশের বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়ের পরেই এত বাজি ফাটানোর সুযোগ পেলেন নাগরিকরা। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, গ্রিন ক্র্যাকার ফাটানো যাবে। তারপরেই সাধারণ মানুষ বাজি কিনতে শুরু করেন। যার মধ্যে বহু নিষিদ্ধ বাজিও ছিল। গ্রিন ক্র্যাকারের লেবেল লাগিয়ে নিষিদ্ধ বাজি বিক্রি করেছেন বিক্রেতারা।
বিশ্বজুড়ে রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে নয়া দিল্লির বায়ুদূষণ বরাবরই ভয়াবহ। কিন্তু শুক্রবার তা যেন আগের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এনডিটিভির খবর অনুসারে, বৃহস্পতিবার (৪ নভেম্বর) দীপাবলি উৎসবের আগেও এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিআই) দিল্লিতে বায়ুদূষণের সীমা ছিল ৩৮২। রাত ৮টা নাগাদ তা আরও ভয়াবহ হতে শুরু করে।
শুক্রবার সকালে দিল্লির জওহরলাল নেহেরু স্টেডিয়াম এলাকায় বাতাসে বিষাক্ত কণার উপস্থিতি দাঁড়ায় প্রতি ঘনমিটারে ৯৯৯ পিএম২.৫। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে মানবদেহের জন্য এর নিরাপদ সীমা মাত্র ২৫ পিএম২.৫।
দিল্লিতে সবরকম বাজি ফাটানোই নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু দীপাবলির রাতে এমন দৃশ্য দেখা গেছে দিল্লির বহু এলাকায়। সন্ধে ৭টা থেকে লাজপতনগর, পশ্চিম দিল্লি, বুরারি, পশ্চিম বিহারে বিপুল বাজি ফেটেছে। পুলিশের চোখের সামনেই রাস্তায় নেমে মানুষ বাজি ফাটিয়েছেন।
এ ধরনের দূষিত বায়ু ফুসফুসের ক্যন্সারসহ নানা ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধি সৃষ্টি করতে পারে। ভারতে প্রতি বছরই বায়ুদূষণজনিত রোগে ১০ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়।
ভারতের সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরইএ) বিশ্লেষক সুনীল দাহিয়া বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, আতশবাজি পোড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা দিল্লিতে সফল হয়েছে বলে মনে হয় না। এর ফলে বিপজ্জনক দূষণের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
এবার ভারতের রাজধানী দিল্লি ও আশেপাশের এলাকায় বায়ু দূষণ কার্যত স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থার সৃষ্টি করেছে৷ প্রতি বছর পরিস্থিতি উনিশ-বিশ হলেও দূষণ হয় মাত্রাতিরিক্ত৷ দূষণের কালো মেঘে ঢাকা পড়ে গোটা শহর৷
প্রায় প্রতি বছরই ভারত সরকার অথবা দেশটির সুপ্রিম কোর্ট আতশবাজি পোড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি করে থাকে। তবে মাঠপর্যায়ে তা খুব কমই কার্যকর হতে দেখা যায়। এর সঙ্গে যোগ হয় দিল্লির প্রতিবেশী পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় কৃষকদের খড় পোড়ানোর মৌসুম। পরবর্তী বছরে চাষের জন্য মাঠ প্রস্তুত করতে পুরোনো খড়কুটোয় আগুন ধরিয়ে দেন কৃষকরা। দিল্লির বায়ুদূষণের জন্য অন্তত ৩৫ শতাংশ দায়ী এ থেকে তৈরি ধোঁয়া।
ভারত সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নজর দিতে গিয়ে তারা বায়ুদূষণ রোধে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। গত সোমবার (১ নভেম্বর) স্কটল্যান্ডে কপ২৬ সম্মেলনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা দিয়েছেন, ভারত ২০৭০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনবে। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবিলার এই লক্ষ্যমাত্রায় ভারত অন্তত দুই দশক বেশি সময় নিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা জানান, অবস্থানগত কারণে দিল্লির এই সমস্যা গুরুতর হচ্ছে৷ আশেপাশে কোনো জলাধার না থাকায় ও আবহাওয়ার ধাঁচ শীতপ্রধান ও শুষ্ক হওয়ায় দূষিত বাতাস পালাবার জায়গা পায় না৷ এছাড়া, তীব্র বেগে চলা বাতাস প্রায়ই সাথে করে আরো বাড়তি ধোঁয়া নিয়ে আসে, যা আরো খারাপ করে পরিস্থিতি৷
তারা বলেন, প্রতি শীতেই আমরা বিভিন্ন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিশ্বাসজনিত ও হৃদরোগ-সম্পর্কিত রোগীদের বাড়ন্ত দেখতে পাই৷ দীর্ঘদিন ধরে দূষিত বাতাসে শ্বাস নেওয়া স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের বিকাশ রোধ করে৷ দিল্লিতে বর্তমানে প্রতি তিনজনে একজন শিশুর ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ বহু শিশুর ফুসফুস সম্পূর্ণ বেড়ে ওঠে না ও সেখানে রক্তক্ষরণও হয়ে থাকে৷
নিকৃষ্ট বাতাসের মান দিল্লির বাসিন্দাদের সবল ফুসফুসকে বিকল করছে৷ এরসাথে উৎসবের মরসুমে আতশবাজির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার প্রতি বছর নভেম্বর মাস থেকে এই মান আরো নিচে নামাতে থাকে৷ অসমর্থ্য ফুসফুস কোভিড সংক্রমণ টেকাতে পারছে না, ফলে হু হু করে বাড়ছে দিল্লিতে দৈনিক সংক্রমণ, মনে করছেন অনেকে৷
২০১৯ সালে কৃষিবর্জ্য পোড়ানো থামাতে আইনী নির্দেশ এলেও, তার বাস্তবায়ন এখনও হয়নি৷ জাতীয় সবুজ ট্রাইবুনাল নভেম্বর মাসে আতশবাজি পোড়ানো বন্ধ করা নিয়ে আলোচনা করছে বলে জানাচ্ছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম৷ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ‘গ্রিন অ্যাপ’ চালু করেছেন, যাতে করে দূষণবিষয়ক নাগরিক নালিশ নথিভুক্ত করা যায়৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, অবিলম্বে শহরে বিকল্প গণপরিবহণের কথা ভাবতে হবে, বাড়াতে হবে সাইকেলের মতো পরিবেশবান্ধব যানচলাচল৷ পুনর্ব্যবহারের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন ও শিল্পক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার চালু করতে হবে বলে পরামর্শ দেন তারা। তবে এসবের কিছুই সরকারী তৎপরতা ছাড়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন তারা৷
তারা জানিয়েছেন, আসলে সরকার ভোট ব্যাংক অটুট রাখতে চায়। হিন্দুদের চটালে তো তারা ভোট পাবে না। পৃথিবীজুড়েই রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পরিবেশ সম্পর্কে অসচেতন। না হলে, সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে, প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে, কিন্তু কেউ জরুরি ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫৬
আপনার মতামত জানানঃ