যে হারে নারীর অগ্রগতি হয়েছে সে হারে কমেনি নারীর প্রতি সহিংসতা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটলেও নারীর প্রতি সহিংসতা কমেনি আশানুরূপ। বরং ক্রমান্বয়ে এ সহিংসতা বেড়েই চলেছে। এমনকি করোনাকালে সহিংসতা আরো বেড়েছে। করোনা সংকটের কারণে চলমান অবরুদ্ধ ও আতঙ্কগ্রস্ত পরিস্থিতিতে যেখানে নারীরা অধিক সহানুভূতি পাওয়ার কথা, সেখানে তাদের প্রতি সহিংসতার হার বেড়ে যাওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
সম্প্রতি জর্জটাউন ইনস্টিটিউট ফর উইমেন, পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি (জিআইডব্লিউপিএস) নারীদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রকাশিত প্রতিবেদন জানায়, ‘নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা সূচক-২০২১’-এ বিশ্বের ১৭০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫২তম। সূচকে নারী নিরাপত্তায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভুটান বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে এবং পাকিস্তান ও আফগানিস্তান পিছিয়ে রয়েছে।
‘উইম্যান পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি ইনডেক্স ২০২১-২২’ শীর্ষক এই সূচকের শীর্ষে রয়েছে নরওয়ে। এরপর রয়েছে যথাক্রমে ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক ও লুক্সেমবার্গ। শীর্ষ দশে থাকা বাকি দেশগুলো হচ্ছে সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, অস্ট্রিয়া, যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডস।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে আফগানিস্তানের নারীরা। দেশটির অবস্থান তালিকার ১৭০ নম্বরে। তার ওপরে আছে যথাক্রমে সিরিয়া, ইয়েমেন, পাকিস্তান, ইরাক, সাউথ সুদান, শাদ, ডিআর কঙ্গো সুদান ও সিয়েরা লিওন।
সূচকে তিনটি মৌলিক বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে অন্তর্ভুক্তি, ন্যায্যতা ও নিরাপত্তা। এক্ষেত্রে মোট ১১টি সূচক ব্যবহার করা হয়েছে। অন্তর্ভুক্তির সূচকগুলো হচ্ছে শিক্ষা, অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি, কর্মসংস্থান, মোবাইল ব্যবহার ও সংসদে প্রতিনিধিত্ব। ন্যায্যতার সূচকগুলো হচ্ছে আইনগত বৈষম্য না থাকা, পুত্র সন্তানের প্রতি পক্ষপাত এবং বৈষম্যমূলক রীতিনীতিকে। নিরাপত্তার সূচকগুলো হচ্ছে স্বামী বা সঙ্গীর নির্যাতন, সামাজিক নিরাপত্তা ও কাঠামোগত সহিংসতা।
সূচক অনুযায়ী, নারীর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ১০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ৩৫ দশমিক ২; স্কুলে পড়ার ক্ষেত্রে স্কোর ১৫-এর মধ্যে ৬ এবং আর্থিক ক্ষেত্রে নারীর অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ১০০-এর মধ্যে ৩৫ দশমিক ৮ স্কোর করেছে বাংলাদেশ।
এ ছাড়া, সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভুটান বাংলাদেশের উপরে অবস্থান করছে। তাদের অবস্থান যথাক্রমে ভারত ১৪৮তম, নেপাল ৯৫তম, শ্রীলঙ্কা ১০৫তম ও ভুটান ১২৯তম।
তবে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান এই অঞ্চলের সূচকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে। দেশ দুটির অবস্থান যথাক্রমে ১৬৭তম ও ১৭০তম। এ ছাড়া, সূচকের সবচেয়ে নিচে আছে আফগানিস্তান।
আফগানিস্তান ২০১৭ সালে থেকে বিশ্বব্যাপী এই সূচকে সবচেয়ে খারাপ স্কোর করছে। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে আফগান সরকারের পতন এবং তালিবানের উত্থানে দেশটির নারীদের অধিকার ও ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্র আরও কমে গেছে।
সূচকের নিচে থাকা ৫টি দেশ হলো, আফগানিস্তান ১৭০তম, সিরিয়া ১৬৯তম, ইয়েমেন ১৬৮তম, পাকিস্তান ১৬৭তম ও ইরাক ১৬৬তম।
সূচক অনুযায়ী, নারীর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ১০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ৩৫ দশমিক ২; স্কুলে পড়ার ক্ষেত্রে স্কোর ১৫-এর মধ্যে ৬ এবং আর্থিক ক্ষেত্রে নারীর অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ১০০-এর মধ্যে ৩৫ দশমিক ৮ স্কোর করেছে বাংলাদেশ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। অগ্রগতি হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকেও। এ সময়ে পরিবর্তন এসেছে নারীর অবস্থা ও অবস্থানেও। বর্তমানে সমাজের প্রায় সব খাতেই নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হচ্ছে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে মেয়েদের উপস্থিতি এখন শতভাগ। পোশাক শিল্পের কৃতিত্বের সিংহভাগই নারীর। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে— বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই যেখানে নারী, সেখানে অগ্রগতি দৃশ্যমান হচ্ছে খুব অল্পসংখ্যক নারীর মধ্যেই।
নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন ছাড়া দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। সরকার দেশের নারী সমাজের সার্বিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। সরকার নারী শিক্ষার বিস্তার ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, কর্মক্ষেত্রে অবাধ প্রবেশ ও নীতি নির্ধারণে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। এরপরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ঘরে-বাইরে নারীর নিরাপত্তা।
সম্প্রতি অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ এবং ব্র্যাকের দুটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ জন নারী রাস্তায় চলার পথে যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্যের শিকার হন, যেখানে সিংহভাগ পারপেট্রেটরই গণপরিবহনের চালক ও হেলপাররা। দেশব্যাপী যে হারে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতেও উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, এ কোন বর্বরতার মধ্যে আমরা বসবাস করছি? ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের খবর যত বেশি পাওয়া যায়, এসব অপরাধের দায়ে অপরাধীদের শাস্তির দৃষ্টান্ত তার চেয়ে অনেক কম। ধর্ষককামীরা এত দিনে জেনে গেছেন, ধর্ষণ করলে তাদের খুব একটা সমস্যা হয় না। এর প্রতিকার নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ। বাংলাদেশের সংবিধানেও এর প্রতিফলন আছে। কিন্তু ৫০ বছরে কি আমরা বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ করতে পেরেছি? সিডও সনদের শর্ত বাস্তবায়ন করতে হলেও নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করার কোনো বিকল্প নেই। সর্বোপরি আমরা বলতে পারি যে, নারীর নিরাপত্তা-মর্যাদা ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি আধুনিক কল্যাণমুখী ও কার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১৮
আপনার মতামত জানানঃ