বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক সম্প্রতি সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হচ্ছে বারবার। অভিযোগ রয়েছে, বর্ণবাদী বিদ্বেষ থেকে শুরু করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় উস্কানিদাতাদের নিজস্ব মতাদর্শ প্রচারের সুযোগ করে দিচ্ছে ফেসবুক। এমনকি অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী মিয়ানমারের উগ্রবাদীদের রোহিঙ্গা গণহত্যার প্রেক্ষাপট তৈরিতেও ভূমিকা রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানিটি।
এতোসব অভিযোগের মধ্যে মার্ক জাকারবার্গের পদত্যাগ নিয়ে কথা বলে আবারও আলোচনায় আসলেন হাউগেন। সূত্র মতে, ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছেন হুইসেলব্লোয়ার ফ্রান্সিস হাউগেন। ফেসবুকের গোপন নথি ফাঁসের পর প্রথমবারের মতো দেওয়া বক্তব্যে তিনি এই আহ্বান জানান।
হাউগেনের মতে, রিব্র্যান্ডে সম্পদের বিনিয়োগ না করে ফেসবুক কোম্পানিতে পরিবর্তন আনার অনুমতি দিতে হবে। গতকাল সোমবার পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে ওয়েব সামিটের উদ্বোধনী বক্তব্যে হাউগেন বলেন, ‘আমি মনে করি জাকারবার্গ প্রধান নির্বাহী থাকলে এই কোম্পানির পরিবর্তন অসম্ভব।’
মার্ক জাকারবার্গের পদত্যাগ করা উচিত কি না, এমন প্রশ্নে হাউগেন বলেন, হয়তো এটি অন্য কারো জন্য লাগাম নেওয়ার সুযোগ। ফেসবুককে এমন একজনের সঙ্গে শক্তিশালী হতে যে নিরাপত্তার দিকে মনোনিবেশ করতে ইচ্ছুক।
গত সপ্তাহে ফেসবুকের করপোরেট নাম রাখা হয় মেটা। প্রতিষ্ঠানটির মনোযোগ যে এখন মেটাভার্সের দিকে, সেটিই ফুঁটে উঠেছে এর মধ্য দিয়ে। মেটাভার্সের ধারণাটিই হলো এমন, একটি অনলাইন দুনিয়ার যেখানে মানুষের যোগাযোগ হবে বহুমাত্রিক।
বিভিন্ন ডিভাইস ব্যবহার করে ব্যবহারকারীরা এ ধরনের স্থানে কন্টেন্ট শুধু দেখা নয়, তাতে পুরোপুরি নিজেকে নিমজ্জিত করে ফেলতে পারবেন, ঘুরে বেড়াতে পারবেন ওই ডিজিটাল দুনিয়ার মধ্য দিয়ে। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির প্রায় ৩০০ কোটি ব্যবহারকারী রয়েছে।
ফেসবুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ
ফেসবুক এ নিয়ে শুধু গণমাধ্যমের সমালোচনা, জনরোষের মুখোমুখিই হয়নি। বরং মার্কিন কংগ্রেসের নিজস্ব তদন্তের মুখেও পড়েছে। অতীতেও এসব সংকট একের পর এক মোকাবিলা করেছে ফেসবুক। তবে এবার একসঙ্গে তিনটি সমস্যার মুখোমুখি হতে চলেছে এই জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি। ফলে দীর্ঘ ১৭ বছরের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে তীব্র সংকটে পড়তে যাচ্ছে ফেসবুক।
গত শুক্রবার সিএনএনসহ যুক্তরাষ্ট্রের ১৭টি গণমাধ্যমের একটি জোট সিলিকন ভ্যালির এই টেক-জায়ান্টটি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করে; যাকে বলা হচ্ছে ‘দ্য ফেসবুক পেপার্স’। এতে কোম্পানির একান্ত অভ্যন্তরীণ পরিচালনার বিবরণসহ মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ (কংগ্রেস) ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে উন্মুক্ত করা তথ্যাবলি রয়েছে। রয়েছে মার্কিন কংগ্রেসকে দেওয়া ফেসবুক হুইসেলব্লোয়ার ফ্রান্সেস হাউগেনের সাক্ষ্যের বিবরণ; যেখানে কোম্পানিটির নীতি কীভাবে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতায় মদদদাতাদের সংগঠিত করে, তা তুলে ধরেন হাউগেন।
পাশাপাশি মার্ক জাকারবার্গের বিরুদ্ধে অভিযোগ, নিরাপত্তা বা সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের চেয়ে নাকি ব্যবসাটাই তার কাছে বড়। এজন্যই বাকস্বাধীনতার পক্ষের লোক হয়েও তিনি যোগসাজশ করেছেন ভিয়েতনাম সরকারের সাথে। সমাজতান্ত্রিক সরকার-শাসিত সেই দেশটির চাওয়া ছিল, সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড যেন ‘সেন্সর’ করে ফেসবুক। বার্ষিক এক বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আসে ভিয়েতনাম থেকে। তাই সেই বাজারটি খোয়াতে চাননি তিনি।
সূত্র মতে, গত ৬ জানুয়ারি মার্কিন পার্লামেন্ট ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার নেপথ্যে ফেসবুকে প্রচারণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একইসাথে, ভারতের সহ বিভিন্ন দেশে ফেসবুকের কন্টেট মডারেশনে ব্যর্থতা এবং কীভাবে মানব পাচারকারী চক্রগুলো এই সাইট ব্যবহার করে মানুষকে শোষণ করছে, সেটিও উঠে এসেছে হাউগেনের সাক্ষ্যে। উল্লেখ্য, ভারতে ফেসবুকের একটি পরীক্ষামূলক ‘ডামি’ অ্যাকাউন্ট থেকে মুসলিম-বিরোধী অসংখ্য গুজব ছড়ানো হয়, যা কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত দৃশ্যমান ছিল।
এদিকে, কিছুদিন আগে হাউগেন ফেসবুকের হাজার হাজার গোপন নথি ফাঁস করে দিলে, সেগুলোর উপর ভিত্তি করে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল আরেক প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যম- দ্য ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল। ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের হাতে আসা নথিকে বলা হয়েছিল ‘ফেসবুক ফাইলস’। এর ভিত্তিতে কিশোরীদের ওপর ইনস্টাগ্রামের মন্দ প্রভাব তুলে ধরা হয় একটি প্রতিবেদন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭০৩
আপনার মতামত জানানঃ