রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ পৌর এলাকায় পুলিশের অভিযানের পর তাজুল ইসলাম (৫৫) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় উত্তেজিত জনতা থানা ঘেরাও করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ, পলিশের সাথে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া,পুলিশ রাবার বুলেট টিআরসেল নিক্ষেপ করেছে। এ ঘটনায় কমপক্ষে ৫০ বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী আহত হয়েছে। পুলিশের দুটি গাড়ি সহ বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করেছে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। সোমবার (১ নভেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে হারাগাছ পৌর এলাকার নতুন বাজার বছিবানিয়ার তেপথি মোড়ে এ ঘটনা ঘটে।
পুলিশ জনতার পাল্টাপাল্টি হামলা
দ্রুত এই মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে হারাগাছ মেট্রোপলিটন থানার বিভিন্ন পাড়া মহল্লা থেকে উত্তেজিত লোকজন লাঠিসোঁটা ও ইট পাথর নিয়ে থানা ঘেরাও করে এবং হামলা চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ করলে উত্তেজিত জনতা পুলিশের ৪টি গাড়ি ভাংচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালায়।
এ সময় উত্তেজিত জনতা থানার প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করলে থানা পুলিশ টিয়ারশেল ও গুলি ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। এরই মধ্যে রংপুর থেকে অতিরিক্ত দাঙ্গা পুলিশ আসলে বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট পাটকেল ছোঁড়ে এবং পুলিশের ওপর হামলা চালায়। পুলিশও হামলাকারীদের ওপর পাল্টা গুলি ছোঁড়ে ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালায়। এতে ৪ সাংবাদিক, পুলিশসহ কমপক্ষে ৫০ জন আহত হয়।
আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে স্থানীয় ও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। এতে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যায়। সংঘর্ষ থানা এলাকা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থা চলতে থাকে রাত ১০টা পর্যন্ত। পরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগন ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে ঘটনাস্থল থেকে লাশ থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এ ঘটনায় পাঁচ পুলিশ সদস্যসহ প্রায় ২০ জন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ
পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, তাজুল ইসলাম নামের ওই ব্যক্তি মাদকসেবী ছিলেন। তিনি অসুস্থ ছিলেন। অভিযান চালানোর সময় তিনি অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন। এ ঘটনায় দুটি মামলা করা হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি দল পৌরসভার দরদী স্কুলের পাশে মাদকবিরোধী অভিযান চালায়। এ সময় সেখানে মারা যান পাশের পাইকারপাড়া এলাকার তাজুল ইসলাম।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশের আভিযানিক দল তাজুল ইসলামকে আটকের পর হাতকড়া পরায়। এরপর তার মাথায় কনুই দিয়ে আঘাত করলে তিনি পাশের দেয়ালে ছিটকে পড়েন এবং ঘটনাস্থলেই মারা যান। এ ঘটনার পরই উত্তেজিত হয়ে ওঠে জনতা। তারা মিছিল নিয়ে হারাগাছ থানা ঘেরাও করে। এ সময় থানায় ইট-পাটকেল ছোড়া হয়। ভাঙচুর করা হয় পৌরসভার সামনে রাখা পুলিশের পিকআপভ্যানসহ বেশ কয়েকটি গাড়ি।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ঘটনাস্থলে রংপুর থেকে বিপুল পুলিশ নিয়ে যাওয়া হয়। নিয়ে যাওয়া হয় সাঁজোয়া যান। ওই সময় লাঠিপেটা ছাড়াও রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। এরপর সংঘর্ষ ছড়িয়ে পরে পুরো পৌর এলাকাজুড়ে। উত্তেজিত জনতাকে থামাতে পৌর মেয়র এরশাদুল হকও রাস্তায় নামেন। পরে পাঁচ ঘণ্টা পর রাত ১২টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাজুলের লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।
পুলিশের বক্তব্য
সেখানে পৌর মেয়র, তাজুলের স্বজনসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে থানায় সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির পর ময়নাতদন্তের জন্য লাশটি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।
স্থানীয় জনতা ও স্বজনদের অভিযোগ অস্বীকার করে গতকাল দিবাগত রাত ১টার দিকে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি-অপরাধ) আবু মারুফ হোসেন বলেন, ‘ঘটনাস্থলে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান চালানোর সময় পুলিশের তালিকাভুক্ত ও একাধিক মাদক মামলার আসামি তাজুল ইসলামকে আটক করা হয়।’
তিনি বলেন ‘তিনি নিয়মিত হেরোইন সেবন করতেন। সে কারণে অসুস্থ ছিলেন। পুলিশ তাকে আটক করা মাত্রই তিনি মলত্যাগ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তখন পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যায়।’
এ ঘটনাকে পুঁজি করে একটি স্বার্থান্বেষী মহল লোকজনকে উসকানি দিয়ে থানায় ভাঙচুর চালায়, ইট-পাটেকল নিক্ষেপ করে বলেও অভিযোগ করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। তিনি আরও বলেন, ‘এতে থানা ও যানবাহনের অনেক ক্ষতি হয়েছে। রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।’
এ ছাড়া তাজুল নামের ওই ব্যক্তির নিহতের ঘটনায় একটি অপমৃত্যু এবং থানায় হামলা ভাঙচুর ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে বলেও জানান ডিসি আবু মারুফ হোসেন।
তবে, এ ঘটনায় কতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেননি পুলিশের এই কর্মকর্তা।
হাইকোর্টের প্রশ্ন
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছে তাজুল ইসলামকে আটকের পর পুলিশের বিরুদ্ধে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ, পুলিশের ওপর হামলা এবং এ বিষয়ে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে সে সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।
আজ মঙ্গলবার বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলিরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এ বিষয়ে খবর নিয়ে আগামীকাল আদালতকে জানাতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশ গুপ্তকে নির্দেশ দিয়েছেন।
এ ছাড়া, আগামীকাল এ বিষয়ের ওপর বিস্তারিত শুনানি ও আদেশের দিন ধার্য করেছেন আদালত।
এ ঘটনায় আজ দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি সংবাদ হাইকোর্ট বেঞ্চে উপস্থাপন করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চান ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশ গুপ্ত এ প্রসঙ্গে জানান, তিনি ঘটনার পুরো বিষয় নিয়ে রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলে আগামীকাল তা আদালতকে জানাবেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫৭
আপনার মতামত জানানঃ