পিপলস রিপাবলিক অব চায়না। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র। ইরান, ভারত, ইনকা, মায়ার মতো প্রাচীন চীনের সভ্যতা। ১৯৪৯ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লবের পর এক নতুন চীনের যাত্রা হয়। নানা রকম সংস্কার ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান বিশ্বে চীন অন্যতম এক পরাশক্তি। জিডিপির হিসাবে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফসল নয়া চীন এখন পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্র।
চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর প্রথম দিকে অর্থনৈতিক ব্যর্থতার ওপরেই মাও সে তুংয়ের উত্তরসূরি আশির দশকের চীনা নেতাদের বাস্তবভিত্তিক কিছু উপলব্ধির ওপর গড়ে উঠেছিল চীনের এক নয়া অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন ব্যবস্থা, যাকে চীনের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন অভিহিত করেছিলেন সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি হিসেবে। এই ব্যবস্থার ভিত্তি হলো, বাজার অর্থনীতির মধ্যে থেকে সম্পত্তিতে ও ব্যবসায় রাষ্ট্রের প্রধান নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকা পালন।
কয়েক দশক ধরে চীন সস্তা শ্রম এবং সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ঋণের উপর নির্ভরশীল। ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে কোম্পানিগুলো তা ব্যয় করেছে বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট, কারখানা, সেতু ও অন্যান্য বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞে। আর এখন সময় এসেছে এইসব ঋণ পরিশোধের। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের পরিবর্তে ভোক্তা ব্যয়ের মাধ্যমে অর্থনীতি পরিচালনার সক্ষমতা এখনও তৈরি হয়নি দেশটির। জনগণের আয় এবং সামগ্রিক ঋণের পরিমাণে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। ফলস্বরূপ, চীন নিজের ঋণের ফাঁদে নিজেই আটকা পড়েছে।
গতি হারাচ্ছে চীনের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার
চীনের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার গতি হারাচ্ছে। চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৪ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। প্রবৃদ্ধির এই হার এক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং বিশ্লেষকদের পূর্বাভাস ও এর আগের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকের চেয়ে অনেক কম।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের জিডিপিতে এর আগের প্রান্তিক এপ্রিল-জুনে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ শতাংশ। অর্থাৎ, দেশটিতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তা দুর্বল হয়ে পড়েছে।
বিদ্যুৎ-ঘাটতি, কোভিড, তথা করোনাভাইরাস মহামারির সংক্রমণের কারণে চীনের উৎপাদন কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে বছরের বাকি সময়েও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে মন্তব্য করেছেন একজন বিশেষজ্ঞ।
চীনের অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়। বিশেষ করে বিদ্যুৎ সরবরাহে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দেওয়ার কারণে উৎপাদন কর্মকাণ্ডে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। অনেক রাজ্যে বিদ্যুৎ ব্যবহারে রীতিমতো রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা হয়। অর্থাৎ, দিনে একেকবার একেক আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় বিদ্যুৎ না দিয়ে অন্য আবাসিক এলাকা বা শিল্পাঞ্চলে সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে শিল্পকারখানাগুলো দিনের উল্লেখযোগ্য সময় বন্ধ রাখতে হয়েছে। এতে সিমেন্ট, ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়ামসহ বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন কমে যায়।
ক্যাপিটাল ইকোনমিকস নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ জুলিয়ান ইভানস-প্রিৎচার্ড বলেন, শিল্পখাতে উৎপাদন আরও কমার লক্ষণ রয়েছে। এর ওপর বৈশ্বিক পণ্যবাজারে বিভিন্ন কাঁচামালের ঘাটতি ও মূল্যবৃদ্ধির ঘটনাও চীনা অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে।
একই সময়ে চীনা সরকার কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর চাপ তৈরি করে। চীনের নিজেরও ২০৬০ সাল নাগাদ কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে।
এ ছাড়া কয়লা উত্তোলন অঞ্চল শ্যানক্সিতে প্রবল বৃষ্টি ও ভয়াবহ বন্যা দেখা দেওয়ায় তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় কয়লার মূল্য বৃদ্ধি পায়, যার প্রভাব পড়ে বিদ্যুৎ এবং প্রকারান্তরে উৎপাদন খাতের ওপর। চীনের মোট কয়লা উৎপাদনের ৩০ শতাংশই হয় শ্যানক্সি অঞ্চলে।
বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে চীনের অর্থনীতি
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন এখন অনেকটা বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে। চলতি বছরের শুরু থেকেই বেইজিং ‘ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং’ বাতিল করছে, আস্থা লঙ্ঘনের দায়ে টেক কোম্পানিগুলোকে করেছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার জরিমানা। যেসব কোম্পানি চীনের কারিগরি শিক্ষাখাতে এতদিন বিনিয়োগ করে বড় অঙ্কের মুনাফা তৈরি করছিল, সেসব কোম্পানিগুলোকেও জোরপূর্বক বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।
আরও ভয়ানক কথা হলো, চীনের দ্বিতীয় বৃহতম রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার গ্রুপ ‘এভারগ্রান্ড’ সম্প্রতি তার ৩০০ বিলিয়ন ডলারের ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। চীনের এই ঘটনা শঙ্কিত করে তুলেছে পুরো বিশ্ব অর্থনীতির বাজারকে। অনেকেই চীনের অর্থনৈতিক মডেলে আবারও নতুন ধরনের পরিবর্তন আসার সম্ভবনা খুঁজে পেয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, অর্থনীতিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে চীন হয়তো এখন তার অনেক প্রাইভেট কোম্পানিকেই অর্থনৈতিক সমর্থন দেবে না।
চীন সরকার এখন দেশের রিয়েল-এস্টেট ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করেই এই সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, সরকারের এই চেষ্টায় দেশের প্রবৃদ্ধি নেমে আসবে কিছুটা ধীর গতিতে।
এছাড়া আরেকটি শঙ্কার বিষয় হলো, বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটে চীনে কয়লার দাম হয়েছে আকাশচুম্বী। সেইসঙ্গে কর্মক্ষম জনসংখ্যার যে অংশ কয়েক বছরের মধ্যে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর অংশে পরিণত হতে চলেছে, তাদের পরবর্তী জীবনযাত্রার জন্য নেই পর্যাপ্ত সঞ্চয়।
এই সমস্ত বাধার মুখে, বেইজিং নতুন এক বিকল্প পথে হাঁটতে শুরু করেছে। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে অর্থনীতি মুক্ত করার পরিবর্তে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তা বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে। রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে চীনা সমাজতন্ত্র এমন একটি মডেলে ফিরে যেতে শুরু করেছে, যা বিগত কয়েক দশকে দেখা যায়নি চীনে। নতুন এই মডেলে অর্থনীতির বেশিরভাগ অংশ থাকবে কঠোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে। এই কারণেই দেশটি আইপিও বাতিল করেছে এবং নতুন নিয়ম নীতিতে পুরো শিল্পখাতকে ঢেলে সাজাচ্ছে।
কয়েক দশক ধরে চীন সস্তা শ্রম এবং সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ঋণের উপর নির্ভরশীল। ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে কোম্পানিগুলো তা ব্যয় করেছে বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট, কারখানা, সেতু ও অন্যান্য বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞে। আর এখন সময় এসেছে এইসব ঋণ পরিশোধের। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের পরিবর্তে ভোক্তা ব্যয়ের মাধ্যমে অর্থনীতি পরিচালনার সক্ষমতা এখনও তৈরি হয়নি দেশটির। জনগণের আয় এবং সামগ্রিক ঋণের পরিমাণে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। ফলস্বরূপ, চীন নিজের ঋণের ফাঁদে নিজেই আটকা পড়েছে।
অর্থনীতিবিদরা এখন শঙ্কা প্রকাশ করছেন, যেকোনো সময় চীন নিজের ঋণ কৌশল ফাঁদে নিজেই জড়িয়ে পড়তে পারে। সর্বপ্রথম ২০১১ সালে দেশটির অর্থনৈতির এই সংকট পুরো বিশ্বের সামনে উঠে আসে। ২০১৫ সালে চীনের সম্পদ বাজারে আরেকটি ধসের সম্ভবনা দেখা দেয়। তবে সে সময় কর্মকর্তারা বস্তি ভেঙে নতুন ভবনে বাসিন্দাদের স্থানান্তর করে সেই ধাক্কা সামলেছিল।
সে বছর থেকেই চীন সরকার ঋণ ব্যবপস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছুটা নড়েচড়ে বসতে শুরু করে। সংকট সামলে উঠতে কিছু কোম্পানিকে চীন ঋণ খেলাপি হওয়ার সুযোগ দেয়, স্থানীয় সরকারদের অপ্রয়োজনীয় কারখানা বন্ধ করার নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি জ্বালানির প্রয়োজন নেই এমন স্থানের কয়লা খনিগুলোও বন্ধের নির্দেশ দেয় সরকার।
ফলে উন্নত জীবনযাপনের আশায় যারা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে ঋণের উপর ব্যবসা পেতে বসেছিলেন, তারা এখন পড়েছেন সবচেয়ে বড় বিপদে।
ধস নামতে পারে বিশ্ব অর্থনীতিতেও
চীনের এই ক্রমবর্ধমান দুর্দশা কাটিয়ে ওঠা অনেকটাই সহজ হয়ে দাঁড়াবে যদি বিশ্বের অন্যান্য দেশ চীনের প্রতি সহযোগিতা দেখায়। কিন্তু তা সম্ভব হবে কিনা সেটিই সংশয়ের বিষয়।
প্রেসিডেন্ট শির নেতৃত্বে চীন বিশ্ব মঞ্চে আরও শক্তিশালী ও কঠোর হয়ে উঠেছে। হংকংয়ে গণতন্ত্রে বাধা, জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলমানদের উপর অত্যাচার, দক্ষিণ চীন সাগরে প্রতিবেশীদের দাবিয়ে রাখার মানসিকতা এবং তাইওয়ানকে আগের মতোই হুমকির উপরে রাখার ফলে বহির্বিশ্ব এখন চীনের প্রতি খুব বেশি ইতিবাচক নয়। আর এই সুযোগ পশ্চিমা বিশ্ব ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছে।
এই মাসের শুরুতে সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের এক বক্তব্যে মার্কিন ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ ক্যাথরিন তাই স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, ওয়াশিংটন চায় বেইজিং বাজার উন্মুক্ত করুক ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলুক।
তবে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে এটুকু বোঝা যায় চীনের অর্থনৈতিক বাস্তবতা খুব শীঘ্রই পরিবর্তিত হবে না। প্রবৃদ্ধি ধীর গতিতে নামিয়ে আনা ছাড়া চীনের কাছে এই মুহূর্তে আর কোনো বিকল্প নেই। আর চীনের প্রবৃদ্ধি কমে গেলে তা অনিবার্যভাবে পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। কারণ বিশ্বের অনেক দেশের উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে।
শুরু থেকেই আধুনিক চীন পরস্পর বিরোধী এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর গড়ে উঠেছে। দেশটি গতিশীল বেসরকারি খাতের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে একযোগে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে, যা চীনকে ফেলেছে এক বিশাল ঋণ সংকট।
তবে অর্থনৈতিক আধুনিকায়ন এবং সামাজিক পরিবর্তনের মাঝে চীন সমাজকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করেছে দেশটির দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। কিন্তু চীনের বর্তমান অর্থনৈতিক বৈষম্য সমাধানের জন্য প্রেসিডেন্ট শির প্রচেষ্টা যদি সেই প্রবৃদ্ধিকে থামিয়ে দেয়, তাহলে সামাজিক স্থিতিশীলতা আরও বাড়বে। যদি সত্যিই এমনটি ঘটে, তাহলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে বিশ্বশান্তিও বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪৩
আপনার মতামত জানানঃ