এদেশে হিন্দু মরলে, ওদেশে মুসলিম মরে। ধর্মীয় ভেদনীতির এই খেলায় দুই দেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি আজ কাঠগড়ায়। দুই দেশেই রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ধর্ম। গোদি জেঁকে বসার ছকে ধর্ম আজ ভাড়াটে খুনি। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনার জের ধরে সীমান্তবর্তী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে গত কয়েকদিন ধরে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে।
প্রসঙ্গত, ত্রিপুরার তিন দিকে রয়েছে বাংলাদেশ। আর একদিকে ছোট্ট একটি অংশ যুক্ত আসামের সঙ্গে। রাজ্যের মোট ৪২ লাখ জনসংখ্যার ৯ শতাংশ সংখ্যালঘু মুসলিম। বাকি জনসংখ্যার অধিকাংশই বাংলাদেশ থেকে আগত উদ্বাস্তু।
সূত্র মতে, গত বুধবার সীমান্তবর্তী পানিসাগর এলাকায় সহিংস ঘটনার পর রাজ্যের ১৫০টি মসজিদে নিরাপত্তা জোরদার করেছে পুলিশ। গতকাল শুক্রবার স্থানীয়রা জানান, “মুসলিমরা আতঙ্কে রয়েছেন। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন”।
পুলিশ ও সংখ্যালঘু নেতাদের তথ্য অনুযায়ী, গত দশ দিনে ত্রিপুরার বিভিন্ন অংশে কমপক্ষে ১০টি হিংসাত্মক ঘটনা ঘটছে। যদিও এই তথ্য নিয়ে দ্বিমত আছে। তবে সব ক্ষেত্রেই মসজিদ এবং মুসলিমদের ঘরবাড়ি ও দোকানে আগুন লাগানো হয়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর একাধিক আক্রমণের ঘটনাও ঘটেছে। বুধবারের সহিংস ঘটনার পর উপদ্রুত এলাকায় জমায়েতের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মঙ্গলবার ভিইএইচপির তাণ্ডবের দিনেই মুসলিম নারীর শ্লীলতাহানি করা হয়েছে। থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া পানিসাগরের রাওবাজার এলাকার মুসলিমদের বাড়ি ও দোকানে ভাঙচুর চালানো হয়েছিল। থানায় যে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল তাতে অবশ্য নারীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ থাকলেও, তা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়নি।
নিষ্ক্রিয় পুলিশ ও মিডিয়া
অথচ স্থানীয় পুলিশ বলছে কিছু হয়নি। আর সেখানকার মিডিয়া নীরব ভূমিকা পালন করছে। এই সুযোগে উগ্রবাদী হিন্দুরা একের পর এক মসজিদে হামলা ও আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। উচ্ছেদ করা হচ্ছে মুসলিমদের। তাদের বাড়ী-ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। শত শত মুসলিম ঘরবাড়ী ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।
এত সবের পরেও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে নাকি ‘অল ইজ ওয়েল’। পুলিশ তেমনটাই বলছে। তাদের দাবি, তেমন কিছুই হয়নি। আইন-শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। অথচ মানবাধিকার সংগঠন এপিসিআর সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখে বলেছে, হিন্দুত্ববাদীরা কমপক্ষে ২৭টি হামলা চালিয়েছিল। ভিএইচপির লোকেরা ১৬টি মসজিদে হামলা চালিয়েছিল। কয়েকটি মসজিদে জোর করে ভিএইচপির পতাকা পুঁতে দেয়া হয়েছিল। কমপক্ষে তিনটি মসজিদে আগুন ধরানো হয়েছিল। উনাকটি জেলার পালবাজার মসজিদ, গোমতী জেলার ডোগরা মসজিদ এবং বিশালগড় জেলার নারোলা টিলা মসজিদে আগুন লাগানো হয়।
এমনকি বিশ্বহিন্দুপরিষদের দুষ্কৃতিকারীরা স্থানীয় রোয়া জামে মসজিদে হামলার ছক কষেছিল। পুলিশ বলছে কিছু হয়নি, তবে উত্তর ত্রিপুরার পানিসাগর থানায় জমা পড়েছে অভিযোগ। সাতজন পুরুষ ও তিন নারী অভিযোগ দায়ের করেন।
সমাজকর্মী নূর উল ইসলাম বলেন, পুলিশ কেন হিন্দুত্ববাদী দুষ্কৃতিকারীদের এমন মিছিলের অনুমতি দিয়েছিল? তার অভিযোগ গোটা ব্যাপারটা হয়েছে বিপ্লব দেব সরকারের যোগসাজসে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে করতে পারেনি। মুসলিমদের নিরাপত্তা দিতে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
স্থানীয় মুসলিমদের অনেকের অভিযোগ, মুসলিমদের ওপর হামলার অভিযোগ দেখেও চুপ করে রয়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা দেখেও একইভাবে চুপ করে রয়েছে মূলধারার মিডিয়া। এটা আসেল দ্বিচারিতা।
টুইটারে কেউ কেউ অবশ্য অগ্নিদগ্ধ মসজিদের ছবি ও মুসলিমদের বাড়ি ভাঙচুরের ছবি পোস্ট করেছে। হ্যাশট্যাগ সেভ ত্রিপুরা মুসলিম নামে চালানো হয়েছে ক্যাম্পেইনও। অথচ সামনে ভোট, সে কারণেই এমন সহিংতা দেখেও চুপ করে রয়েছে সিপিএমের মতো তথাকথিত দলগুলোও। কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপিকে নিশানা করে বলেছে ত্রিপুরার আইন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে।
চোখ কান বন্ধ মোদি সরকারের
এসব ঘটনা ঠেকাতে না পারায় কেন্দ্র ও রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি সরকারের কঠোর সমালোচনা করছে বিরোধীরা। যদিও রাজ্য সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে। উত্তর ও পশ্চিম ত্রিপুরা এবং গোমতী, শিপাহিজলা ও উনকোটিতে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ ও মসজিদে আগুন দেবার ঘটনা প্রসঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি সুস্মিতা দেব শুক্রবার বলেন, “সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য নিয়েই সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ ও তাদের ধর্মীয় স্থানে আগুন লাগানো হচ্ছে।”
এদিকে দায়সারাভাবে ত্রিপুরা পুলিশের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সকলকে সতর্ক করে বলা হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে একদল মানুষ গুজব ছড়াচ্ছে এবং উত্তেজনাকর বার্তা প্রচার করছে।
বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনও এমন বিবৃতি দিয়ে গত বৃহস্পতিবার জানায়, কতিপয় ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া আইডি ব্যবহার করে ত্রিপুরা পরিস্থিতি নিয়ে মিথ্যা খবর ছড়াচ্ছে।
তবে মুসলিমদের সংগঠন জমিয়ত উলেমার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গত ১৯ অক্টোবর থেকেই একদল মানুষ রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ধারাবাহিকভাবে মুসলিমদের ধর্মীয় স্থান এবং দোকান, বাড়িঘরে আক্রমণ করছে।
গত ২২ অক্টোবরই জমিয়তের প্রেসিডেন্ট মুফতি তায়েবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর ও পুলিশ সুপারকে মুসলিমদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে স্মারকলিপি দেন। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব ও ত্রিপুরা পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল ভি এস যাদবের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। তিনি দাবি করেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার উদ্দেশ্য নিয়ে দুষ্কৃতকারীরা সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করছে।
পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল ভি এস যাদব সাংবাদিকদের জানান, রাজ্যের ১৫০টি মসজিদে প্রহরা দেওয়া হচ্ছে। সব ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আসামিদের চিহ্নিত করা হবে।
দোষারোপের রাজনীতি
মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির ত্রিপুরা রাজ্য কমিটির সদস্য পবিত্র কর বলেন, এদিকে “বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরঙ দলের মাধ্যমে ভারতীয় জনতা পার্টি এসব হিংসাত্মক ঘটনা পরিচালনা করছে।”
তিনি বলেন, “ত্রিপুরার ইতিপূর্বে সাম্প্রদায়িক হানাহানির কোনো ঘটনা ঘটেনি। বরং শান্তিপূর্ণ রাজ্য হিসেবেই থেকেছে সব সময়। তাই এবারের হামলার ঘটনার আমরা তীব্র প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব এখন পর্যন্ত মুসলিমদের উপর হামলা নিয়ে শক্ত অবস্থান নেননি।”
ত্রিপুরা বিজেপির নেতা ও এমপি বিনোদ সোনকার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান, “ত্রিপুরার সাম্প্রতিক হিংসার ঘটনা নিয়ে দলের সংখ্যালঘু সেলের ৫ সদস্যকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে কেন হিংসাত্মক ঘটনা ঘটল, সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়ে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।”
ত্রিপুরার সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা নিয়ে পারস্পরিক দোষারোপের রাজনীতিও শুরু হয়েছে। বিজেপি নেতা সোনকার বলেন, “এই সব ঘটনার সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস জড়িত। তারাই ত্রিপুরায় জায়গা পেতে এসব করছে।”
তবে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সুস্মিতা দেব বলেন, “আগামী নভেম্বরে ত্রিপুরায় পুরসভা নির্বাচন রয়েছে। সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটারদের মেরুকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক হিংসাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে।”
একই অভিযোগ করে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে পবিত্র কর বলেন, “নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে তাদের ব্যর্থতা ঢাকতে ভারতীয় জনতা পার্টি হিন্দু সংগঠনগুলির মাধ্যমে হিন্দু ভোট সংহত করতে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে।”
ত্রিপুরা ইস্যুতে বিজেপি সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন রাহুল গান্ধী। বৃহস্পতিবার তিনি অভিযোগ করেন, ত্রিপুরায় মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে। রাহুলের প্রশ্ন-সরকার কতদিন অন্ধ ও বধির হওয়ার ভান করে থাকবে। এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, হিন্দু ধর্মের নামে যারা সহিংসতা করে তারা হিন্দু নয়, ভণ্ড।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৪০
আপনার মতামত জানানঃ