ঠিক কিসের টানে আমাদের পূর্বপুরুষেরা বার বার ফিরে এসেছিল ডেনিসোভা গুহায়? সাইবেরিয়ার আল্টাই পর্বতের মাঝে সারা বছর স্যাঁতসেঁতে গুহা ডেনিসোভা। এখানে নিয়ান্ডারথাল, আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষ ও ডেনিসোভানরা বিভিন্ন সময়ে আশ্রয় নিয়েছিল। মানুষের বিবর্তন সরলরৈখিক নয়, বরং জালের মতো। বিবর্তনে অন্তত ১৫টি প্রজাতির আদিম মানুষের আগমন হয়েছিল, যারা বিভিন্ন সময়ে আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষের সঙ্গে সহাবস্থান করেছিল। আধুনিক মানুষের সঠিক পূর্বপুরুষের পরিচয় আজও ধূসর। মানব বিবর্তনের রাস্তা একটা চমকপ্রদ অধ্যায়, এখনও যার জট ছাড়ানো চলছে।
মানুষের পূর্বপুরুষের প্রজাতির তালিকায় যোগ হলো নতুন নাম। প্রায় পাঁচ লাখ বছর আগে মধ্য প্লাইস্টোসিন যুগে আফ্রিকায় যারা বসবাস করতো; তাদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘হোমো বোডোএনসিস’। তারা আধুনিক মানুষের সরাসরি পূর্বপুরুষ।
ইভোল্যুশনারি অ্যানথ্রোপলজি সাময়িকীতে এ প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
ইথিওপিয়ার আওয়াশ নদী উপত্যকার বোডো দা’র অঞ্চলে ওই প্রজাতির এক মানুষের খুলি পাওয়া যায়। সেখান থেকেই প্রজাতিটির নাম বোডোএনসিস রাখা হয়েছে। নতুন এই শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী, হোমো বোডোএনসিস বলতে মধ্য প্লাইস্টোসিন যুগের বেশিরভাগ মানুষকে বোঝাবে, যারা পুরো আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি এলাকায় বাস করতো।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এ যুগটি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ ওই একই সময়ে আফ্রিকায় আজকের আধুনিক মানুষ হোমো সাপিয়েন্স ও ইউরোপে হোমো নিয়ান্ডারথালদের উৎপত্তি হয়।
তবে কিছু প্যালেওঅ্যান্থ্রপলজিস্ট এ যুগকে গোলমেলে মধ্যযুগ হিসেবে অভিহিত করেছেন, কারণ সে সময়ের মানব বিবর্তন সম্পর্কে এখনো স্পষ্টভাবে জানা যায়নি।
কানাডার ইউনিভার্সিটি অব উইনিপেগের অধ্যাপক ও গবেষণাটির প্রধান গবেষক ড. মিরজানা রকসানডিক বলেন, “মানুষের ভৌগলিক বৈচিত্র্যকে সঠিকভাবে ব্যাখায় করার মতো পরিভাষার অভাবে মধ্য প্লাইস্টোসিন যুগে মানুষের বিবর্তন নিয়ে কথা বলা বেশ কঠিন,”
নতুন শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী, মধ্য প্লাইস্টোসিন যুগে আফ্রিকার বেশিরভাগ মানুষ ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের কিছু মানুষই হোমো বোডোএনসিস। সেইসঙ্গে ইউরোপের বেশিরভাগ মানুষকে পুনরায় নিয়ান্ডারথাল প্রজাতিতে শ্রেণিবদ্ধ করা হবে।
মানোয়ার ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ের নৃ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণাটির একজন সহ-লেখক ক্রিস্টোফার বে বলেন, “দুরূহ সমস্যা সমাধান করে মানব বিবর্তনের গুরূত্বপূর্ণ এ যুগ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে আলোচনা করতে পারার জন্যই এ নামকরণ।
ড. রকসানডিক বলেন, একটি নতুন প্রজাতির নামকরণ বিশাল ব্যাপার। বেশ কিছু কঠোর নীতি অনুসরণ করেই ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন জুলজিক্যাল নোমেনক্লেচার নাম পরিবর্তনের অনুমতি দেয়।
এর আগে, গত আগস্টে আজ থেকে ৭,২০০ বছর আগে মারা যাওয়া এক নারীর দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে ইন্দোনেশিয়ায়, ওই নারীর দেহাবশেষে প্রাচীন ডিএনএ পাওয়া যায়। এ আবিষ্কারের পর প্রাচীন মানুষের আভিবাসন নিয়ে যা জানা গেছিল তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
এখন পৃথিবীতে জীবিত প্রাণীদের মধ্যে প্রাচীন হোমো স্যাপিয়েন্সদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ স্বজন হচ্ছে শিম্পাঞ্জি ও বোনোবো। নৃতত্ত্ববিদদের মতে, ৬০ লাখ বছরের বেশি সময় আগে আধুনিক মানুষ ও এদের এক অভিন্ন পূর্বপুরুষ ছিল। ওই অভিন্ন পূর্বপুরুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষেরা বিভিন্ন প্রজাতিতে বিকশিত হন। তাদের বলা হতো হোমিনিন। লাখ লাখ বছর ধরে হোমিনিনরা অনেকটাই বানরের মতো থেকে যায়। তারা ছিল খাটো, মস্তিষ্কের আকার ছিল ছোট এবং সাধারণ পাথরের অস্ত্র-সরঞ্জামই কেবল তৈরি করতে পারত তারা।
আফ্রিকায় মানুষের হোমোগণের শুরুটা পঁচিশ লক্ষ বছর আগে, অস্ট্রালোপিথেকাস নামক দ্বিপদী থেকে। প্রায় কুড়ি লক্ষ বছর আগে প্রথম বার এক দল পূর্ব আফ্রিকা থেকে বাকি পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া শুরু করেছিল। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিপদসঙ্কুল অচেনা অরণ্যে লড়াইয়েই জন্ম নিয়েছিল আরও নতুন প্রজাতি। ইউরোপে নিয়ান্ডারথাল, পূর্ব এশিয়াতে হোমো ইরেক্টাস, জাভা দ্বীপপুঞ্জে হোমো সোলোয়নসিস (সোলো মানব), ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোর দ্বীপপুঞ্জে ফ্লোরেসিয়েনসিস (হবিট)। হঠাৎ করে সমুদ্রস্তর বেড়ে যাওয়াতে প্রত্যন্ত দ্বীপে আটকে পড়ে হবিট জনগোষ্ঠী। মনে করা হয় পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে এদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়েছিল। উচ্চতা ছিল মেরেকেটে এক মিটার। এরা পাথরের সামগ্রী তৈরিতে সক্ষম ছিল।
আট লক্ষ বছর আগে মানব ইতিহাসে হঠাৎ আগুন আবিষ্কার। আগুনের ব্যবহার খাদ্য পরিপাক পদ্ধতিকে আমূল বদলে আমাদের পূর্বপুরুষকে বেশ খানিকটা এগিয়ে দিয়েছিল। বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে বিজ্ঞানীরা আজও সর্বসম্মত নন।
মানব বিবর্তনের গোড়া থেকে এমনই বহু অজানা চরিত্রের আগমন ঘটেছে, যারা বদলে যাওয়া প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে। আধুনিক মানুষ বিবর্তনের পথে এমন বহু আত্মীয়দের হারিয়েছে, যাদের পরিচয় অনেকাংশে অজানা হলেও গুরুত্ব অপরিসীম।
বিবর্তনের কোন পরিকল্পনায় টিকে গিয়েছে মানুষের আধুনিক প্রজাতি? জার্মানির এক গুহাতে আবিষ্কার হয়েছিল ৩২ হাজার বছরের পুরনো প্রথম মানব শিল্প, ভাস্কর্য ‘লায়নম্যান’— মানুষের দেহ ও সিংহের মুখ। অর্থাৎ, তখনই মানুষ কল্পনা করতে শিখেছিল। মানুষের গল্প বলার শুরুটা সেই থেকেই। কল্পনাশক্তিই তো টিকিয়ে রাখে আধুনিক মানুষকে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১২৭
আপনার মতামত জানানঃ