মামুন আবদুল্লাহ : দ্য প্রিন্টে শেখর গুপ্তা নামের একজন পলিটিক্যাল বিশ্লেষক একটি আর্টিকেল লিখেছেন ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ইম্যানুয়েল ম্যাক্রোর সেই বিখ্যাত উক্তিটি কোট করে। আর্টিকেলের নাম ‘5 reasons for the crisis in global Islam‘; তিনি খুবই লজিক্যাল আইডিয়া ব্যক্ত করেছেন এ ব্যাপারে যে ইসলাম আদৌ সঙ্কটে কিনা, সঙ্কটে হলে এর কারণগুলো ঠিক কী কী। এটি ভীষণ সেন্সিটিভ একটি টপিক, সেকারণে অবজেক্টিভ মাইন্ড সেট না করে তা পড়াও উচিৎ হবে না। এরপর পাঠকই নির্ধারণ করবেন আদৌ ইসলাম সঙ্কটে কিনা।
ঘটনার প্রেক্ষাপট শুরু হয় গত মাসে অক্টোবরে ফরাসি প্রেসিডেন্টের কিছু স্টেটমেন্টকে কেন্দ্র করে। তিনি বলেন, “বিশ্বজুড়ে ইসলাম একটি সঙ্কটে পড়েছে, এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও এই ধর্মটি সঙ্কটে।” তার এই বক্তব্যের পরপরই মুসলিম বিশ্বে নিন্দার ঝড় ওঠে। তার নিজ দেশেও আলোচনা ও সমালোচনা হয়। মুসলিম দেশসমূহ থেকে প্রচুর চাপও প্রয়োগ করা হয়। তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধান রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান বলেন, “ম্যাক্রো যেন তার মানসিক পরীক্ষা করান।” পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দুই পৃষ্ঠার একটি চিঠি লেখেন ফ্রান্সকে উদ্দেশ্য করে। মুসলিম উম্মাহ অর্থাৎ মুসলিম দেশসমূহকে উনি বলেন, ‘পশ্চিমা বিশ্বকে ইসলাম বিষয়ে রিএডুকেট করতে হবে।’ মালেশিয়ার মাহাথির মুহাম্মদ সবকিছুকে ছাপিয়ে দিয়েছে। তিনি ফ্রান্সের শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটি হত্যাকে জাস্টিফায়েড করেন। এরপর তিনি এটাও বলেন ফরাসি জনগণকে হত্যা করা মুসলমানদের দায়িত্ব। অর্থাৎ তিনি একটি গণহত্যার একটি হলোকাস্টের আহ্বান জানান। বাংলাদেশও এই প্রতিযোগীতায় পিছিয়ে পড়েনি। ইসলামী দলগুলোর উপর্যুপরি চাপে বাংলাদেশ সরকার বাধ্য হয় এ ব্যাপারে নিন্দা জ্ঞাপন করতে। সাম্প্রতিক সংসদে নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হতে পারে এমনও শোনা যাচ্ছে।
শেখর গুপ্তার প্রথম টপিক ছিল ‘Religions were, are & will be political‘, ধর্ম বরাবরই একটি পলিটিক্যাল কনসেপ্ট ছিল পূর্বে। এখন তো আছেই এবং ভবিষ্যতেও থাকবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। রাজনীতির কথা আসলে বলা হয়ে থাকে, ইসলাম অন্যান্য ধর্মের তুলনায় সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক। ইসলামের পরতে পরতে রাজনীতি খেলা করে। সাম্রাজ্যবাদী সময় থেকে ইসলাম রাজনৈতিক ভাবে সফল ও পুরোপুরি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের একটি ধর্ম। পৃথিবীর ইতিহাসে খ্রিষ্ট ধর্ম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম রাজনীতিকে এতটা প্রভাবিত করতে পারেনি। একবিংশ শতাব্দীতে এসে ইসলামের রাজনৈতিক আবেদন এতটুকুও কমেনি। ইসলাম দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। প্রথমটা জানেনই, খ্রিষ্ট ধর্ম।এর জনসংখ্যাও প্রায় ২০০ কোটির কাছাকাছি। আমরা যদি ইসলাম ও মুসলমানদের বিষয়টি দেখি তারা ভিন্ন সরকার পদ্ধতিতে বাস করছে এখনও। একারণেই বহু বিশেষজ্ঞ বলেন, বহু ইসলামী রাষ্ট্র এখনও মধ্যযুগেই বাস করছে। কেন? সরকার ব্যবস্থার ভিন্নতার কারণে। উদাহরণ স্বরূপ, কিছু মুসলিম রাষ্ট্র রাজতন্ত্র অনুসরণ করে, কিছু মুসলিম রাষ্ট্র স্বৈরতন্ত্র অনুসরণ করে, কিছু মুসলিম রাষ্ট্র আবার সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র অনুসরণ করে, কিছু দেশে গণতন্ত্র রয়েছে যেখানে এখনও বহু এনার্কি চলে, ষড়যন্ত্র চলে, কোথাও কোথাও শরীয়া শাসনও চলে, ইত্যাদি। আমরা যদি মুসলিম জনসংখ্যার দিকে তাকাই তবে দেখতে পাব ৬০ শতাংশ মুসলমান শুধু এশিয়াতেই বাস করে। শুধু এশিয়ার দিকে তাকালে এমন চারটি বৃহৎ রাষ্ট্র দেখা যাবে যেখানে মুসলিমদের সংখ্যা প্রচুর। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া। এর মাঝে শুধু ভারতই মুসলিম রাষ্ট্র না, ভারত এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে কারণ এটি মুসলিম দেশের তালিকা না, বৃহৎ আকারে মুসলিম জনগণ যে গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে বাস করছে তার তালিকা। যদিও বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র না বলে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্র বলাটাই ঠিক হবে। এর বাইরে এশিয়ার বেশিরভাগ দেশেই গণতন্ত্রের কোন বালাই নেই। বা গণতন্ত্র থাকলেও ভিন্ন ধরণের গণতন্ত্র আমরা দেখতে পাই। যখনই আমরা গণতন্ত্রের কথা বলব, দয়া করে মনে রাখবেন গণতন্ত্র কোন নিখুঁত সরকার ব্যবস্থা না। কিন্তু আপাতত এর চাইতে ভালো কোন অপশনও নেই। এর থেকে ভালো অপশন চলে আসলে আজ যারা গণতন্ত্র, গণতন্ত্র করে চিৎকার চেচামেচি করছে তারা এর বিলুপ্তি চেয়ে মিছিল সমাবেশ করবে। যেহেতু মুসলিম জনগণ বিভিন্ন ধরণের গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় থাকে, ভিন্ন গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় বাস করে, এবং বিভিন্ন সরকার ব্যবস্থায় বাস করে সেহেতু ইসলাম আরও বেশি পলিটিক্যাল আকার ধারণ করেছে। আমরা যদি মর্ডান পলিটিক্যাল আইডিয়ার আলোচনা করি তবে সেক্যুলারিজম টার্ম আপনা আপনি চলেই আসে। দক্ষিণ এশিয়ায় বহুবার বিবাদ হয়েছে সেক্যুলারিজমের উপরে, ইউনিফর্মড সিভিল ওয়রের উপরে। তাই সেক্যুলিরজম একটি বিশাল বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে সকলের সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, মুসলিম দেশসমূহের মাঝে একটি দেশও সেক্যুলারিজমকে সহ্যই করতে পারে না, অথবা স্বীকারই করে না। তাদের দাবী, সেক্যুলারিজম একটি পশ্চিমা ধারণা। এটি মুসলিম ভাতৃত্ব ধংস করবে, ইসলামিক নীতিমালার বিরোধী, এমনকি সেক্যুলারিজম একটি খুবই বাজে শব্দ। আবার যে মুসলিম জনগণ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাস করে, অথবা কোন নির্দিষ্ট গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাস করে সেখানে তাদের অতি প্রিয় একটি শব্দ হ’ল ‘সেক্যুলারিজম’। এমনকি তারা সেই দেশ সমূহে সেক্যুলারিজমকে ইচ্ছামতো টেম্পারিং করে, টেস্টও করে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের মুসলমানদের কথাই ধরা যাক, এদের নিজেদের দেশে সেক্যুলারিজমের কথা শুনলে গায়ে ফোস্কা পড়ে কিন্তু ভারতে সেক্যুলারিজমের গায়ে আঁচড় লাগলে এই দুই দেশের মুসলমানদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। ইউরোপ আমেরিকা সর্বত্র মুসলিমরা সহীহ সেক্যুলারিজম কায়েমে ব্যস্ত যদিও সেই দেশগুলোতে আগে থেকেই সেক্যুলারিজম বিদ্যমান। ভারতের সেক্যুলারিজমের গঠন কেমন হওয়া উচিৎ এটা যেমন বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের মুসলমানরা ঠিক করতে চায় তেমন সাম্প্রতিক ফরাসি সেক্যুলারিজম কেমন হবে সেটাও নির্ধারণ করে দেওয়ার জন্য মুসলমানরা উঠে পড়ে লেগেছে। তাহলে প্রথম প্রশ্ন, এটা কি ক্রাইসিস না? যদি ইসলাম সেক্যুলারিজমকে না মেনে থাকে তাহলে সেই দেশগুলোতে তারা সেক্যুলারিজমের গঠন পরিবর্তনের জন্য বা পুনর্গঠনের জন্য, টেস্ট করার জন্য কেন উঠে পড়ে লেগেছে?
দ্বিতীয় টপিক ‘Is there a Muslim Ummah?‘ মুসলিম উম্মাহ কি আসলেই আছে? মুসলিম উম্মাহ অর্থ মুসলানদের ঐক্য। মুসলিমরা ইসলামকে এভাবে দেখে, সমস্ত ইসলামী রাষ্ট্রগুলো একে অপরের সাথে মুসলিম উম্মাহর দোহাই দিয়ে সংযুক্ত। সমগ্র মুসলিম উম্মাহ একটিই শরীর। শরীরের একটি অংশ যদি ব্যথায় তাড়িত হয় তবে পুরো শরীর সেই ব্যথা ভোগ করে। আমরা যদি মুসলিম উম্মাহর কথা বলি তবে দেখব ইসলামে এটির গুরুত্ব অসীম। মুসলিমদের মাঝে প্যান ইসলামিজম অনুসরণের একটা চাপ সব সময়ই থাকে। গত পাঁচ থেকে ছয় দশকের যুদ্ধের দিকে তাকাই দেখতে পাব, ঠিক কোন কোন দেশসসমূহ যুদ্ধে আক্রান্ত তার মাঝে কতগুলো মুসলিম রাষ্ট্র রয়েছে, আর কতগুলো অন্যান্য রাষ্ট্র। ইরান-ইরাক যুদ্ধ, কুয়েত যুদ্ধ, ইয়েমেন-সৌদি আরব যুদ্ধ, তুরস্ক সিরিয়া যুদ্ধ এমন বহু উদাহরণ দেখা যাবে আমেরিকার যুদ্ধাংদেহী মনোভাবকে ছাপিয়ে। এমনটা কখন হয়েছে যখন মুসলিম উম্মাহ বা মুসলিম এলায়েন্সরা মিলেমিশে তৃতীয় অন্য আরেকটা দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে? ১৯৬৭ এর যুদ্ধ ছাড়া কেউ কোন সাম্প্রতিক উদাহরণ দিতে পারবে না। সেসময় আরব রাষ্ট্রগুলো মিলে বেশ বড়সড় একটি এলায়েন্স বানিয়েছিল যারা একসঙ্গে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এরপর সেই তথাকথিত মুসলিম উম্মাহ বলে কিছুই আর দেখা যায়নি। ফলে মুসলিম উম্মাহর উপরে একটি প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যায়। এটা কি ক্রাইসিস না? মুসলিম ঐক্য আছে কি নাই, যদি থাকে তাহলে মুসলিম উম্মাহর ভেতরে এত ডাবল স্ট্যান্ডার্ড কেন? চীন উইঘুর মুসলিমদের উপরে এত অত্যাচার করছে সেক্ষেত্রে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে না কেন? এই একটি প্রশ্ন নিজে আরেকটি সঙ্কট সৃষ্টি করছে মুসলমানদের মাঝে।
তৃতীয়ত, ‘Pan Islamism & Terrorism link’; যদি মুসলিম উম্মাহর ব্যাপারেই আলোকপাত করি, শেখর গুপ্তা বলেন, ‘প্যান ইসলামিজম রাষ্ট্রে খুব বেশি দেখা যায় না কারণ সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ হয় পশ্চিম এশিয়ায়, যেখানে শিয়া সুন্নি ক্রাইসিস চলছে ইসলামের শুরু থেকেই। আর প্যান ইসলামিজম প্রকাশ্যে দেখা যায় সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ভেতরে।’ কারণ তারা দাবী করে একটি খিলাফতের। যেমন আলকায়দা, আইসিস খুব উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এখন তারা কি প্যান ইসলামিক অর্গানাইজেশন? প্যান ইসলামিক অর্গানাইজেশন হয়ে থাকলে তারা কেন ইসলামিক রাষ্ট্রসমূহের বিরুদ্ধে লড়াই করছে? অথবা কেন ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোতে বেশিরভাগ যুদ্ধ করছে। আইসিস দাবী করে তাদের একটি প্যান ওয়ার্ল্ড খিলাফত কায়েম করতে চায়, এবং শরীয়া শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এটা যদি আইসিসের মূল উদ্দেশ্য হয়, এটা যদি প্যান ইসলামিজম হয়ে থাকে, তাহলে অন্যান্য মুসলমানরা এটিকে প্যান ইসলামিজম বলে স্বীকার করবে? যে মুসলমানেরা বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তান ইন্দোনেশিয়ায় বাস করে যেখানে প্যান ইসলামিজমের থেকে ন্যাশনালিজম বেশি শক্তিশালী। যেমন, যদি ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ হয় তখন এই দেশ সমূহের জনগণের উপরে কি আছড় পড়ে? তখন কি প্যান ইসলামিক বেশি প্রভাব বিস্তার করে নাকি প্যান ন্যাশনালিজম বেশি প্রভাব বিস্তার করে? যদি কোনভাবে প্যান ইসলামিক হয়েও যায় তবে তারা একক খিলাফত স্বীকার করবে, সমর্থন করবে নাকি নিজেদের গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে সমর্থন দেবে? গুপ্তা বলেন, ‘এই দেশ সমূহে একটি গণতান্ত্রিক সরকার রয়েছে, একজন লিডার আছেন, আবার সেই লিডারের বিরুদ্ধে বিরোধীদলও রয়েছে, তবে তারা মুসলমানদের মাঝে গণতন্ত্র নিয়ে একটি ঐক্য গঠন করতে পারবেন।’ তবে কি এটা ক্রাইসিস নয়?
চতুর্থত, ‘Pan Islamism & Islamic Inequality‘; মুসলিম উম্মাহর দাবী যেখানে আসে, প্যান ইসলামিজমের দাবী যেখানে আসে, একক শরীরের দাবী যেখানে করা হয়, একটি অঙ্গে ব্যথা হলে যেখানে পুরো শরীর সেটি ভোগ করার কথা সেখানে মুসলিম বিশ্বে এত বৈষম্য কেন? প্যান ইসলামিজম একটি জাতিতাত্ত্বিক কনসেপ্ট হলেও এটি কিন্তু কিছুতেই অর্থনৈতিক কনসেপ্ট না। ইসলামিক রাষ্ট্রসমূহে এত বেশি বৈষম্য রয়েছে যে শুধু সেটার দ্বারাই মুসলিম রাষ্ট্রসমুহ কখনো ঐক্যে পৌঁছাতে পারবে না। অর্থনৈতিক ইস্যুতে গিয়ে মুসলিম রাষ্ট্রসমুহ পুরোপুরি ডিভাইডেড। বেশির ভাগ মুসলিম জনগণ বাস করে আফ্রিকা ও এশিয়ায়। এবং ধনী মুসলমানেরা বাস করে উপসাগরীয় অঞ্চলে। এই অঞ্চলে খুব কম মুসলমান বাস করে। ধনী ও গরীব ইসলামের এই যে ডিভাইডেশন সেটিকে উদ্দেশ্য করে কি আশা করা যাবে, প্যান ইসলামিজমের খাতিরে ও মুসলিম উম্মাহর খাতিরে ধনী মুসলিমরা কি নিজেদের সম্পদ বণ্টন করবে তাদের গরীব মুসলিম ভাইদের মাঝে? এই হাস্যকর প্রশ্নের উত্তর ‘না’ হবে। উত্তর ‘না’ হলে সকলেই মানবেন কি, এই বিকট অর্থনৈতিক বৈষম্য নিজেই একটি জলজ্যান্ত ক্রাইসিস নয় কি? উপসাগরীয় অঞ্চলের ধনী মুসলমানরা ইতোমধ্যে পশ্চিমা ধনকুবের ও পশ্চিমের বিখ্যাত গ্রুপ অব কোম্পানিগুলোর সাথে পার্টনারশিপে রয়েছে। আমেরিকার সাথে, যুক্তরাজ্যের সাথে, ফ্রান্স, ইউক্রেন, জার্মানি, স্পেন সকলের সাথে। এবং তাদের পার্টনারশিপ ব্যবসা খুব ভালোভাবেই চলছে। জিডিপি ও অর্থের ক্ষেত্রে বিপুল বৈষম্য ইতোমধ্যে আছেই, কিন্তু যখনই রাজনৈতিক সমস্যা, ধর্মীয় সমস্যা সামনে আসে তখন ঢাল হয়ে ওঠে মুসলিম উম্মাহ ও প্যান ইসলামিজম। এটি কি ক্রাইসিস না?
উপরের পাইগ্রাফে দেখা যাচ্ছে মুসলিম বিশ্বে কী পরিমাণ অর্থনৈতিক বৈষম্য রয়েছে। সৌদি আরব, ইউএই, মিশর, ইরাক, আলজেরিয়ার যে তেল নির্ভর অর্থনীতি রয়েছে তাদের জিডিপি অনেক বেশি শক্তিশালী বাকী সব মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর তুলনায়। এখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে ইসলামিক বৈষম্য রয়েছে তা সহজে মিটবার নয়।
পঞ্চমত, ‘Is there right to protest in Islamic countries’; ইসলামিক রাষ্ট্রসমূহে কি প্রতিবাদের অধিকার রয়েছে? প্রশ্ন ওঠে যে, ইসলামিক রাষ্ট্রসমূহে গণতন্ত্র অথবা জনগণের যা পছন্দ না সেটির বিরুদ্ধে তারা কি প্রতিবাদ করতে পারে? ইসলামিক সংখ্যাগুরু রাষ্ট্রে অলিখিত বা লিখিত ইসলামী শরীয়া চলে। সেখানকার জনগণ বেশিরভাগই নাখোশ। সেখানে যে মোনার্কি চলে, যে শেখতন্ত্র চলে, যে নেতারা আছেন, রাজতন্ত্রের লোকজন আছে তাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জনগণের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয় যা তাদের পছন্দ না। অপছন্দনীয় বিষয় নিয়ে তারা সমালোচনা পর্যন্ত করতে পারে না। আইন পছন্দ না হলে সেই আইনের বিরুদ্ধে রেসেনমেন্ট বা অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারে না। এমনকি, বহু সংখ্যক মানুষ এটাও ভাবে যে শেখ ও আমিররা আমেরিকার কাছে, সাটানিজমের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। এসব জানার পরও, আমরা বহুবার দেখেছি সৌদি নারীদের ছোটখাটো প্রতিবাদ নিয়মিত চলেই। নারী ড্রাইভিং এর অধিকার আদায়ের জন্য রীতিমতো লড়াই চলেছে, আরব বসন্ত কিন্তু আরব জনগণের অসন্তোষেরই ফসল, ইরাক ইরানে নারীদের মাঠে বসে খেলা দেখার দাবী ওঠে, হিজাব ছাড়া খেলার দাবী একবার ওঠে তো পরের বার আইন করে হিজাব পরে খেলানোর বন্দোবস্ত হয়। ইসলামিক রাষ্ট্রে যে প্রতিবাদের অধিকারই নেই এটা কি কোন ক্রাইসিস না? অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে আমরা দেখতে পাই ফ্রান্সে নবী মুহাম্মদের কার্টুন আঁকা নিয়ে এর পক্ষে বিপক্ষে অনেক মতামত দাঁড়িয়ে গেছে। মুক্ত গণতন্ত্রের এটাই সৌন্দর্য, এখানে সকলের জন্য প্রতিবাদের সুযোগ থাকে। মুসলিম বিশ্বে যেখানে প্রতিবাদের অধিকার নেই, সেখানে ইউরোপে তারা প্রতিবাদ করে কোন অধিকারে? এটাও আরেকটা সঙ্কট যা সম্পাদক উত্থাপন করেছেন।
উপরের প্রশ্নগুলোই বলে দেয় ইসলাম সঙ্কটে আছে কি না। এসবের সারাংশ তবে কী? অবজেক্টিভ দৃষ্টিকোণে ভাবলে, হোক সে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান নাস্তিক আমরা সকলে মিলে এতটুকু পোস্ট ট্রুথ বা পোস্ট মর্ডান ওয়ার্ল্ডে বাস করছি যেখানে কোন নির্দিষ্ট ধর্ম, কোন নির্দিষ্ট আইডিয়াকে ইউনিভার্সাল দাবীই করতে পারি না। সত্য সর্বত্র বিদ্যমান। সব ধর্মেই একটা সত্য আছে, যেখানে ভালো জিনিসগুলোকে অনুসরণের অনুরোধ থাকে। ধর্মের র্যাডিক্যালিজম বিষয়টি অবশ্যই বাদ দিয়ে। সেটাও ধর্মের একটি অংশ। সেটিকে বাদ দিয়ে প্রেম ও শান্তির বাণী আওড়ানোই হল ধর্মীয় সংস্কার। প্রতিটি ধর্ম এই সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেছে, ইসলাম বাদে। এবং এর পরিবর্তন সবার আগে নিয়ে আসতে হবে মুসলিমদেরই।
তথ্যসূত্র:
https://theprint.in/national-interest/5-reasons-for-the-crisis-in-global-islam/534270/
https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_Arab_League_countries_by_GDP_%28nominal%29
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত সকল মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ