হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করতে চলেছেন ইন্দোনেশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট সুকর্ণর তৃতীয় কন্যা সুকমাবতী সুকর্ণপুত্রি। সিএনএন ইন্দোনেশিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগামীকাল ২৬ অক্টোবর মঙ্গলবার বালিতে একটি ‘সুধি বদানি’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সনাতনী হবেন সুকমাবতী। হিন্দু ধর্মে তার আগ্রহের পিছনে রয়েছেন তার দাদি ইদা আয়ু নিয়োমন রাই শ্রিম্বেন।
সুকর্ণ ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং নেদারল্যান্ডের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য সংগঠিত সফল সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী। তিনি ইন্দোনেশিয়ার জাতির জনক হিসেবে স্বীকৃত। তিনি ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি ছিলেন। জাপানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করার পর সুকর্ণ ও মোহাম্মদ হাতা ১৭ আগস্ট ১৯৪৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা করেন, যেখানে সুকর্ণ প্রথম রাষ্ট্রপতি মনোনীত হন।
সুকমাবতী সুকর্ণপুত্রি তিন সন্তানের জননী। বর্তমান বয়স ৭০ বছর। তিনি বালিতে এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্বেচ্ছায় হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করার কথা জানিয়েছেন। গত ২২শে অক্টোবর তারিখে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। এই সিদ্ধান্তকে তার তিন সন্তানও সমর্থন জানিয়েছে। সুকমাবতীর আইনজীবী জানান, হিন্দুত্বের বিষয়ে বিশাল জ্ঞান রয়েছে সুকর্ণর মেয়ের। হিন্দু ধর্মের আচার-আচরণ সম্পর্কেও জানেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে সুকমাবতীর বিরুদ্ধে উঠেছিল ইসলাম অবমাননার অভিযোগ। ইন্দোনেশিয়ার ফ্যাশন উইকে একটি কবিতা পড়েছিলেন তিনি। সুকমাবতী বলেছিলেন, বোরখা পড়ার চেয়ে ইন্দোনেশিয়ার ঐতিহ্যবাহী খোঁপা অনেক ভালো। তার পরই সুকমাবতীর বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ করে উলেমাদের সংগঠন। তার গ্রেফতারির দাবি করেন। ওই ঘটনার পর সাংবাদিক বৈঠক করে ক্ষমা চান তিনি।
সুকর্ণপুত্রি ইতিপূর্বে বেশ কিছু হিন্দু অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে এবং হিন্দু ধর্মের প্রধানদের সাথে আলাপ আলোচনা করেন। সূত্র মতে, তার এই সিদ্ধান্তকে তার ভাই বোন এবং সন্তানেরা সমর্থন করেছে।
উল্লেখ্য, ইন্দোনেশিয়া মুসলিম প্রধান দেশ। বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যা সেখানে। একটা সময় হিন্দুদের আধিক্যও ছিল সেখানে। এখনও সরকারিভাবে দেশের ৬টি ধর্মের মধ্যে অন্যতম হিন্দু। বিশ্বে ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশের পর ইন্দোনেশিয়া চতুর্থ বৃহৎ হিন্দু জনসংখ্যার দেশ।
যীশুর জন্মের পূর্বে প্রথম শতকে জাভা ও সুমাত্রা দ্বীপে হিন্দু ধর্মের প্রসার ঘটে। পনেরো শতক অব্দি হিন্দু ধর্ম সেখানে প্রভূত উন্নতি লাভ করে। যাই হোক ইসলাম ধর্মের আগমনে হিন্দু ধর্মের প্রভাব কমে আসতে শুরু করে। ধীরে ধীরে দেশটিতে হিন্দুরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। যদিও ইন্দোনেশিয়ায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা আজও তাদের পূর্বপুরুষদের ভবিষ্যতবাণীতে বিশ্বাস করেন; বিশেষ করে রাজা জয়াবায়া এবং ধর্মযাজক শব্দপালনের ভবিষ্যতবাণী।
হিন্দু ধর্মযাজকের ভবিষ্যতবাণী
শাব্দাপালন ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্য মাজাপাহিতের রাজা ব্রইজায়া পঞ্চমের সভার একজন রহস্যময় ধর্মযাজক। যখন ওই সাম্রাজ্যে ইসলাম ধর্মের প্রভাব বাড়তে থাকে এবং ১৪৭৮ সালে রাজা ব্রইজায়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, শব্দপালন রাজাকে অভিশাপ দেন।
পাশাপাশি তিনি প্রতিজ্ঞা করেন ৫০০ বছর পর প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রাজনৈতিক দুর্নীতিতে সবকিছু যখন পর্যদুস্ত হবে, তখন তিনি ফিরে আসবেন। এই রহস্যময় ধর্মযাজক বলেছিলেন, তিনি ইসলামের গ্রাস থেকে ইন্দোনেশিয়ার এই দ্বীপগুলোকে রক্ষা করবেন এবং হিন্দু জাভানিজ ধর্মের গৌরব ফিরিয়ে আনবে।
হিন্দু পুরাণ কল্পবৃক্ষ অনুযায়ী শব্দপালন বলেছিলেন, জাভা দ্বীপে আমি রাণী, সমস্ত ডাং হায়াং এবং জাভানিজ প্রথম পূর্বপুরুষ থেকে শুরু করে সমস্ত রাজাদের দাস। ২ হাজার সাল থেকে আজ অব্দি, তাদের ধর্মে কোন পরিবর্তন হয়নি। আমি জাভানিজ রাজাদের উত্তরপুরুষদের সেবা করেছি। এটা হচ্ছে সেই সময় যখন আমরা বিভক্ত হয়ে গেছি। এখন আমি আমার উৎসে ফিরে যাচ্ছি। যাইহোক, যেন আমাদের রাজাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, ৫০০ বছর পর, আমি সমগ্র জাভায় হিন্দু ধর্ম ফিরিয়ে আনবো।
সূত্র মতে, তিনি জাভা থেকে ইসলামকে সরিয়ে হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করবেন বলে জানা যায়।
রাজা জয়াবায়ার ভবিষ্যতবাণী
জয়াবায়া একজন হিন্দু রাজা যিনি কেদিরির প্রাচীন রাজ্যের উপরে রাজত্ব করেছিলেন। পূর্ব জাভা রাজ্যকে অভূতপূর্ব সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার কৃতিত্ব রয়েছে এবং বেশিরভাগই তার বিখ্যাত ভবিষ্যদ্বাণীগুলির জন্য স্মরণ করা হয়।
জয়াবায়া ১১৩৫ সালের শুরুতে ২২ বছর ধরে কেদিরি রাজত্ব করেছিলেন। ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসে তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সুপরিচিত রাজাদের মধ্যে রয়েছেন। জয়াবায়া ছিলেন একজন প্রফেটিক হিন্দু রাজা; যাকে রতু আদিল বা ন্যায়বিচারী রাজা বলা হতো।
তার শাসনামলে, জাভার মানুষ বিশ্বাস করতো যে হিন্দু রাজারা ভগবান বিষ্ণুর অবতার। জয়াবায়াও এই দাবিকে বৈধ করার চেষ্টা করেছিলেন যে তিনিও কোনও এক হিন্দু দেবতার অবতার। ইতিহাসের মতে, হিন্দু রাজাদের ভগবান ব্রহ্মার বংশ বলে সম্মান করা হতো।
রাজা জয়াবায়া তার ভবিষ্যতবাণীর জন্য প্রসিদ্ধ। আজও তার ভবিষ্যতবাণী আধুনিক ইন্দোনেশিয়াতেও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বহন করে। জয়াবায়ার ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ, সেরাত জয়াবায়া নামে পরিচিত; যা কিনা রাজা নিজেই লিখেছেন এমন ইতিহাস ও স্তঞ্জের একটি সেট। মৌখিক ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে উত্তীর্ণ, প্রাচীনতম লিখিত অনুলিপিটি তার জীবদ্দশার প্রায় ৭০০ বছর পরে ১৮৩৫ সালে প্রতিলিপি করা হয়েছিল।
তার অন্যতম ভবিষ্যতবাণী ছিল, জাভার মানুষ সাদা চামড়াদের দ্বারা শাসিত হবে। মজার ব্যাপার ১৫৯৫ সালে জয়াবায়ার মৃত্যুর ৪০০ বছর পর জাভা দখল করে ওলন্দাজেরা। জয়াবায়া আরও ভবিষ্যতবাণী করেন, সাদা চামড়াদের থেকে দ্বীপের কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেবে হলুদ চামড়ার মানুষ। এটাও সত্য হয় যখন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে জাপানিরা ইন্দোনেশিয়া আক্রমণ করে এবং ওলন্দাজদের শাসনের পতন ঘটে।
ইন্দোনেশিয়ার এই পূর্বপুরুষদের ভবিষ্যতবাণী একের পর এক সত্যে রূপ নিচ্ছে। তাই দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতির মেয়ের এই ইসলাম ধর্ম ত্যাগকে অনেকেই ধর্মযাজক শব্দপালনের ভবিষ্যতবাণী সত্য হবার ইঙ্গিত হিসেবে নিচ্ছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ