বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় খাতে দুর্নীতি একটি বহুল আলোচিত বিষয়। যদিও আইন প্রয়োগের প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি দমন করার কথা কিন্তু দেখা যাচ্ছে দুর্নীতিকে উস্কে দিচ্ছে একটি আইন। সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি প্রতিরোধে বিভিন্ন দেশে কঠোর দণ্ডের বিধান সংবলিত চাকরিবিধি প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে এর উল্টো চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। অবশ্য ২০১৮ সালের আগে সরকারি কর্মচারীদের ঘুষ, দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনজনিত অন্যান্য অপরাধের জন্য চাকরি সংক্রান্ত বিধিবিধানে অপেক্ষাকৃত কঠোর বিধান বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে এসেই হঠাৎ করে তা যেন সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। কঠোর দণ্ডের পরিবর্তে এলো দুর্নীতিকে উৎসাহিত করার মতো নমনীয় দণ্ডের বিধান।
২০১৮ সালে ১৯৮৫ সালের বিধিমালাটি বাতিল করে জারি করা হয়েছে ‘সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা, ২০১৮’। এ বিধিমালায় দুর্নীতিকে উৎসাহিত করার মতো বিধান সংযোজন করা হয়েছে। বিধিমালাটিতে দুর্নীতির জন্য যে কোনো ধরনের দণ্ডের বিধান করে তিরস্কার দণ্ডের মতো হালকা দণ্ড আরোপেরও সুযোগ রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিধিমালাটিতে একাধিকবার দুর্নীতি করার কেবল সুযোগই রাখা হয়নি, বরং একাধিকবার দুর্নীতির ক্ষেত্রেও তিরস্কার দণ্ড আরোপের সুযোগ রাখা হয়েছে।
দুর্নীতির জন্য তিরস্কার দণ্ড বা অন্য কোনো লঘুদন্ড আরোপ করে চাকরিতে বহাল রাখার মতো এরূপ অনৈতিক সুবিধা বিশ্বের অন্য কোনো দেশের সরকারি কর্মচারীরা ভোগ করেন বলে জানা নেই। বিধিমালাটিতে আরও অবাক করার বিষয় হল কোনো কর্মচারী চাকরিতে ৬০ দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলে তার ওপর তিরস্কার দণ্ডের চেয়ে কঠোর দণ্ড আরোপ করার বিধান রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, বিধিমালাটিতে দুর্নীতির চেয়ে চাকরিতে ৬০ দিনের বেশি অনুপস্থিতিকে অধিক গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
২০১৮ সালের আগে সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য ছিল ১৯৮৫ সালের শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা। ওই বিধিমালায় দুর্নীতির জন্য সর্বনিম্ন দণ্ড ছিল চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দান। অর্থাৎ, ছোট হোক বা বড় হোক, যে কোনো দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পর কোনো সরকারি কর্মচারীকে চাকরিতে বহাল রাখার সুযোগ ছিল না। এ কারণে দুর্নীতি করার সময় চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে অনেকেই দুর্নীতি করা থেকে বিরত থাকত।
এ ছাড়া ২০১৮ সালের আগে কোনো সরকারি কর্মচারী ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি, ছিনতাই, নারীর শ্লীলতাহানি বা নৈতিক স্খলনজনিত যে কোনো অপরাধে আদালত কর্তৃক কারাদণ্ডে বা জরিমানা দণ্ডে দণ্ডিত হলে রায় ঘোষণার দিন থেকে গণকর্মচারী ডিসমিসাল অন কনভিকশন অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ অনুযায়ী তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত হতো। কিন্তু ২০১৮ সালে ওই অধ্যাদেশটি বাতিল করে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-তে এ সংক্রান্ত অত্যন্ত নমনীয় ও অনৈতিক বিধান সংযোজন করা হয়েছে।
২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনটি ১ অক্টোবর ২০১৯ থেকে কার্যকর করা হয়েছে। সরকারি চাকরি আইন অনুযায়ী ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি, ছিনতাই, নারীর শ্লীলতাহানি বা যে কোনো নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে কোনো সরকারি কর্মচারী এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে বা যে কোনো পরিমাণের অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হলে, তা কয়েক কোটি টাকা হলেও চাকরিতে বহাল থাকবেন। অর্থাৎ, কারাদণ্ড ভোগকালীনও তিনি তার সরকারি পদটি অলংকৃত করে রাখবেন এবং এক বছর কারাদণ্ড ভোগ শেষে নিজ চেয়ারে বসে দাপটের সঙ্গে জনসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবেন। বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এ ধরনের বিধান আছে বলে জানা নেই।
ঘুষ, দুর্নীতি বা নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে বা যে কোনো পরিমাণের অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হলেও চাকরিতে বহাল থাকার এ সুযোগ দুর্নীতি প্রতিরোধের সহায়ক বিধান বলে ভাবার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, ঘুষ ও দুর্নীতির জন্য দুদক যেসব মামলা করেছে বা করবে, সেসব মামলায় যেসব সরকারি কর্মচারীর এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হবে, তারা এক বছরের কারাদণ্ড ভোগ শেষে অথবা কয়েক কোটি টাকা অর্থদণ্ড হলে ওই অর্থদণ্ড পরিশোধ করে আবার চাকরিতে যোগদান করে বহাল তবিয়তে চাকরি করে অবসরে যাবেন এবং সরকারি কোষাগার থেকে পেনশন পাবেন। আইনের এরূপ বিধান অবশ্যই সুস্থ চিন্তার সহায়ক নয় এবং দুর্নীতি প্রতিরোধেও সহায়ক নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতের মধ্যে বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়টি এই মুহূর্তে দেশে ব্যাপক আলোচিত। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরাও এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন। সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন দাবি করেছেন যে, টাকা পাচারের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের সংখ্যাই বেশি, এমন তথ্য তার কাছে রয়েছে।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাগুলোর অভিমত হচ্ছে, সরকারি খাতে বড় অংকের বেতন বৃদ্ধির ফলে দুর্নীতি কমার যুক্তি দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তা তো কমেইনি বরং আরো বেড়ে গেছে। আলোচ্য আইনটি দুর্নীতি বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বহুল প্রচলিত সরকারি কর্মচারী আইন বইয়ের লেখক সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘সব সময় জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা সরকারি কর্মচারীর কর্তব্য। সরকারি কর্মচারীরা যাতে জনসেবায় নিজেদের সব সময় নিয়োজিত রাখেন সে উদ্দেশ্যেই সংবিধানে এ মূলমন্ত্র সংযোজন করা হয়েছে। সংবিধানের এ মূলমন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবেই সরকারি কর্মচারীদের চাকরি সংক্রান্ত বিধিবিধান প্রণীত হওয়ার কথা।’
তিনি আরো লেখেন, ‘সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। তবে এ জিরো টলারেন্স নীতি সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কারণ, সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য দুর্নীতি প্রতিরোধমূলক চাকরিবিধিরও প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু ‘সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা, ২০১৮’ আইনের এরূপ বিধান অবশ্যই সুষ্ঠু চিন্তার সহায়ক নয় এবং দুর্নীতি প্রতিরোধেও সহায়ক নয়।’
মিই/আরা/১১১০
আপনার মতামত জানানঃ