চীনের সঙ্গে চলমান অস্ত্র প্রতিযোগিতার নতুন ‘স্নায়ু যুদ্ধে’ এক দশকের মধ্যেই হেরে যাবে আমেরিকা, এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান মাইক গালাঘার। সম্প্রতি পরমাণু ওয়ারহেড বহনে সক্ষম একটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের খবর প্রকাশিত হলে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, গত আগস্টে উৎক্ষেপণ করা ওই নতুন পারমাণবিক সক্ষমতা সম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্রের গতি ঘন্টায় ২১ হাজার মাইল। মহাশূন্য থেকে কয়েক মিনিটের মধ্যে কোনো লক্ষ্যে আঘাত করার আগে পৃথিবীকে নিচু দিয়ে কক্ষপথে অতিক্রম করতে পারে ক্ষেপণাস্ত্রটি।
আর্মড সার্ভিসেস কমিটির সদস্য মাইক গালাঘার বাইডেন প্রশাসনকে তাদের ‘অক্ষমতার’ জন্য সমালোচনা করে বলেন, আমেরিকার উচিত বেইজিংয়ের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা।
যদিও চীন এই নতুন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে বলে অনেক আগে থেকেই খবর ছিল, তারপরও ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের সংবাদটি বিশ্লেষকদের কাছে বড় ধরনের বিস্ময় হয়ে এসেছে। এর মাধ্যমে আরও প্রমাণিত হয়েছে যে চীনকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে যতটা উন্নত মনে হয়েছিল, তারা আদতে তারচেয়েও অনেক বেশি এগিয়ে।
গালাঘার বলেন, “আমরা যদি আমাদের বর্তমান কার্যক্রম নিয়েই সন্তুষ্ট থাকি, তাহলে এক দশকের মধ্যেই আমরা কমিউনিস্ট চীনের বিপক্ষে নতুন স্নায়ু যুদ্ধে হেরে যাব।”
তিনি আরও বলেন, “পিপল’স লিবারেশন আর্মির (চীনের সামরিক বাহিনী) সক্ষমতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে, যার মাধ্যমে তারা আমাদের মিসাইল প্রতিরক্ষাকে ঘায়েল করতে এবং প্রথাগত ও পারমাণবিক হামলা, দুভাবেই আমেরিকার জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে।”
গালাঘার যোগ করেন, বাণিজ্য চুক্তির কল্যাণে বেইজিং আমেরিকান প্রযুক্তি হাতে পেয়েছে, যেটিকে কাজে লাগিয়ে তারা নতুন ক্ষেপণাস্ত্র পরিচালনার সুপারকম্পিউটারকে শক্তি জোগাতে পারে।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান চীনা কোম্পানিদের সঙ্গে এমন কোনো প্রকল্প, বিনিয়োগ বা গবেষণার যৌথ উদ্যোগে না যেতে, যেগুলোর সঙ্গে প্রতিরক্ষার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। কেননা এভাবে চীনা সামরিক বাহিনীর কাছে আমেরিকান প্রযুক্তি পৌঁছে যেতে পারে।
উল্লেখ্য, গত আগস্ট মাসে চালানো ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার কথা মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সম্প্রতি জানতে পেরেছে। পাঁচটি অজ্ঞাত সূত্রের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ দৈনিক ফিনান্সিয়াল টাইমস এ খবর প্রকাশ করে।
তবে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের কাছে সংবাদ সংস্থা এএফপি প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেও তাদের এই অনুরোধে তাত্ক্ষণিকভাবে সাড়া দেয়নি পেন্টাগন।
এখন পর্যন্ত আমেরিকা এবং রাশিয়াও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে এবং গত মাসে উত্তর কোরিয়া জানিয়েছে যে তারা নতুন তৈরি একটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে।
তবে চীন-আমেরিকার মধ্যকার নতুন এই স্নায়ুযুদ্ধও আসলে নতুন নয়, বেশ পুরনো। আমেরিকা এবং চীনের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না বহু বছর ধরে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই সম্পর্ক আরও বাজে দিকে মোড় নিচ্ছে। চলতি বছরের মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আমলে আমেরিকা এবং চীনের মধ্যকার প্রথম যে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা শুরু হয় সেখানেও দু’পক্ষই পরস্পরকে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করে।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভান তার বর্তমান দায়িত্ব পাওয়ার আগে ফরেন এফেয়ার্স ম্যাগাজিনে কুর্ট ক্যাম্পবেলের সঙ্গে মিলে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। মিস্টার ক্যাম্পবেল এখন জো বাইডেনের এশিয়া বিষয়ক শীর্ষ উপদেষ্টা। এই নিবন্ধে তারা বলেছিলেন, “চীনের সঙ্গে মিলে-মিশে কাজ করার যে নীতি আমেরিকা এতদিন অনুসরণ করেছে, তার অনানুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘনিয়ে এসেছে।”
চীন এবং আমেরিকার সম্পর্ককে এখন এক নতুন “স্নায়ু যুদ্ধ” বলে বর্ণনা করা হচ্ছে প্রায়শই। কিন্তু আসলেই কি তাই? বিবিসির কূটনৈতিক বিশ্লেষক জনাথান মার্কাস এই সম্পর্কের নানা দিক বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করেছেন, বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্কে যেভাবে গোটা বিশ্বে ছায়া ফেলেছিল, এখানেও তাই ঘটতে যাচ্ছে কিনা।
তিনি বলছেন, ওয়াশিংটন এবং বেইজিং এর সম্পর্ককে কীভাবে চিত্রিত করা হবে, সেটার অনেক গুরুত্ব আছে। তিনি বলেন, “ঐতিহাসিক তুলনা অনেক সময় বিকল্প পথ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করে, পটভূমি এবং দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বুঝতে সাহায্য করে। তবে অনেকে মনে করেন, এ থেকে উল্টো ফলও হতে পারে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঠিক একইভাবে ঘটে না। সেখানে আসলে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি দেখা যেতে পারে।”
জনাথান মার্কাস লিখেছেন, “স্নায়ু যুদ্ধের” মানে যদি হয় এমন এক আসুরিক লড়াই যেখানে দুটি বৈরি রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরস্পরের বিরুদ্ধে পুরো জাতীয় শক্তি দিয়ে লড়ছে, তাহলে বলতে হয় চীন-মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে মার্কিন-সোভিয়েত সংঘাতের প্রতিধ্বনি আছে।
বাইডেন প্রশাসনের অন্তর্বর্তীকালীন পররাষ্ট্র নীতিতে বলা হয়েছে, আরও দৃঢ়প্রত্যয়ী চীনই হচ্ছে আমেরিকার একমাত্র সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী; যারা তাদের সম্মিলিত অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক এবং প্রযুক্তিগত শক্তি দিয়ে একটি স্থিতিশীল এবং মুক্ত বিশ্ব-ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে। কাজেই হোয়াইট হাউসে নতুন বাইডেন প্রশাসনের মন্ত্র হচ্ছে, যেখানেই প্রয়োজন সেখানেই চীনের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দাও, আর যেখানে সম্ভব সেখানে সহযোগিতা করো।
অন্যদিকে চীনও যেন একই ধরণের অবস্থান নিয়েছে। তারা একদিকে গঠনমূলক সম্পর্কের কথা বলছে। অন্যদিকে তাদের নিজেদের স্বার্থের বেলায় আরও শক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে। হংকং-এ গণতন্ত্র শক্ত-হাতে দমন করছে, সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের সঙ্গে নির্লজ্জ ব্যবহার করছে, যাকে কিনা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন ‘গণহত্যা’ বলে বর্ণনা করেছেন।
মার্কিন ব্যবস্থার ত্রুটি তুলে ধরতে কোন সুযোগই বেইজিং হাতছাড়া করে না। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায় যে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তখন সমালোচনার সুযোগ বেইজিং লুফে নিয়েছিল। এরপর যখন ট্রাম্পের শাসনের শেষ বেলায় ওয়াশিংটন ডিসিতে ক্যাপিটল ভবনে হামলা হলো, সেটাকেও বেইজিং নিজেদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যে শ্রেষ্ঠতর, তা তুলে ধরতে ব্যবহার করেছে।
জনাথান মার্কাস লিখেছেন, “তাই ওপর থেকে দেখতে গেল এই “স্নায়ু যুদ্ধের” তকমা হয়তো যথার্থ মনে হতে পারে। কিন্তু একে স্নায়ু যুদ্ধ বললে সেটা বাস্তবে কতটা কাজে লাগবে? সোভিয়েত-মার্কিন স্নায়ু যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তাদের মিত্র দেশগুলো বিশ্ব অর্থনীতি থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিল, তাদের দেশগুলোতে রপ্তানির ওপর নানা রকমের নিয়ন্ত্রণ ছিল। কিন্তু চীনের বেলায় কিন্তু ব্যতিক্রম। চীন বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এক অপরিহার্য অংশ। আর তাদের অর্থনীতি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে মার্কিন অর্থনীতির সঙ্গে।”
মার্কিন-সোভিয়েত স্নায়ু যুদ্ধে প্রযুক্তির একটা ভূমিকা ছিল; যুদ্ধাস্ত্র এবং মহাকাশে অভিযান নিয়ে দুই পক্ষ তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে পড়েছিল। নতুন চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বেও প্রযুক্তির ভূমিকা রয়েছে। তবে এখানে যেসব প্রযুক্তি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে যা ভবিষ্যতে আমাদের সমাজের ভোল পাল্টে দেবে, যেমন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা ফাইভ-জি।
জনাথান মার্কাস বলছেন, এবারের বিশ্ব প্রেক্ষাপটও ভিন্ন। গত শতকের স্নায়ু যুদ্ধের সময় বিশ্ব দুটি শিবিরে বিভক্ত ছিল, তার বাইরে ছিল আবার জোটনিরপেক্ষ শিবির (তবে মার্কিনীরা সবসময় মনে করতো এই জোটনিরপেক্ষ দেশগুলো আসলে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি সহানুভূতিশীল)। কিন্তু এখন বিশ্ব অনেক বেশি মেরুতে বিভক্ত। তবে এখনকার বিশ্বে উদারনৈতিক ব্যবস্থা যেরকম হুমকির মুখে পড়েছে, সেটা আগে কখনো দেখা যায়নি। এর ফলে চীন তাদের নিজস্ব বিশ্ব-ভাবনা পুরো দুনিয়ার ওপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য অনেক বেশি জোর পাচ্ছে।
জনাথান মার্কাস বলছেন, চীন-মার্কিন বৈরিতাকে স্নায়ু যুদ্ধের মডেলে দেখা বেশ বিপদজনক। স্নায়ু যুদ্ধ ছিল এমন রাজনৈতিক লড়াই, যেখানে কোন পক্ষই অন্য পক্ষের বৈধতাকে স্বীকার করেনি। যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মুখোমুখি সংঘাতের ঘটনা ছিল বিরল, কিন্তু দুই পক্ষের মধ্যে যে প্রক্সি-যুদ্ধ হয়েছে, তাতে বিপুল প্রাণহানি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এক পক্ষই আসলে পরাজিত হয়েছে। সোভিয়েত ব্যবস্থা আসলে ভেসে গেছে ইতিহাসের স্রোতে। কাজেই অনেকের আশংকা হচ্ছে, চীন-মার্কিন বৈরিতাকে এরকম আদর্শগত বিচারে দেখলে হিসেবে ভুল করবে দু’পক্ষই। আর এর ফলে চীন হয়তো পরাজয় এড়াতে অনেক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির ঝুঁকি পর্যন্ত নিতে পারে।
অন্যদিকে, চীন আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়। তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন বেশ ভালো অবস্থায়, তখনো তাদের জিডিপি ছিল মার্কিন অর্থনীতির তুলনায় মাত্র ৪০ শতাংশ। কিন্তু এক দশকের মধ্যেই চীনা অর্থনীতি মার্কিন অর্থনীতির সমান হয়ে যাবে। উনিশ শতক হতে আজ পর্যন্ত চীনের মতো কোন প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হয়নি যুক্তরাষ্ট্র। কাজেই চীন-মার্কিন সম্পর্ক এমন এক বিষয়, যেটিকে আগামী কয়েক দশক ধরে হয়তো মানিয়ে চলতে হবে।
এটি কোন দ্বিতীয় স্নায়ু যুদ্ধ নয়, তার চেয়েও বিপদজনক কিছু। চীন এরই মধ্যেই অনেক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী। যদিও এখনো তারা গ্লোবাল সুপার-পাওয়ার হয়ে উঠেনি, নিজেদের নিরাপত্তার জন্য যেসব বিষয়কে চীন জরুরী বলে মনে করে, সেরকম অনেক ক্ষেত্রে সামরিকভাবে তারা এরই মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৪৫
আপনার মতামত জানানঃ