যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন দল কনজারভেটিভ পার্টির এমপি স্যার ডেভিড অ্যামিস খুন হয়েছেন। গতকাল শুক্রবার এসেক্সে নিজের নির্বাচনী এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে বৈঠকের সময় তার ওপর এই হামলা হয়। এ ঘটনা জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে। পুলিশের এমন সন্দেহের খবরে দেশটির মুসলিম কমিউনিটিতে নতুন করে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।
স্থানীয় সময় গতকাল সকালে এসেক্সের লেহ-অন-সি শহরের একটি গির্জায় হামলার শিকার হন এমপি ডেভিড অ্যামিস। তিনি সেখানে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। একাধিকবার ছুরিকাঘাত করে তাকে হত্যা করা হয়। ঘটনাস্থলে চিকিৎসা দেওয়া হলেও তাকে বাঁচানো যায়নি। এ ঘটনায় ২৫ বছর বয়সী সন্দেহভাজন একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
পুলিশ বলছে, শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর ১২টার পর তারা এ হামলার খবর পান এবং সেখানে ছুটে গিয়ে একজনকে আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে জরুরি বিভাগের কর্মীরা তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ধারণা করা হচ্ছে, ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।
অ্যামিস হত্যায় জড়িত সন্দেহে সোমালি বংশোদ্ভূত যুক্তরাজ্যের স্থানীয় অধিবাসী ২৫ বছরের এক তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র গার্ডিয়ানকে জানিয়েছে, তিনি ঝুঁকিপূর্ণ উগ্রবাদীদের তালিকায় ছিলেন।
যুক্তরাজ্যের মেট্রোপলিটন পুলিশ এক বিবৃতিতে জানায়, কাউন্টার টেররিজম পুলিশের সমন্বয়ক উপসহকারী কমিশনার ডিন হেডন আনুষ্ঠানিকভাবে এ হত্যাকাণ্ডকে সন্ত্রাসীকাজ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ইসলামপন্থী উগ্রবাদীরা জড়িত। পুলিশ তদন্তের অংশ হিসেবে লন্ডনের দুটি ঠিকানার খোঁজ করছে। পুলিশের ধারণা, গ্রেপ্তার ব্যক্তি একাই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন।
মেট্রোপলিটন পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনা জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারে। তদন্তের অংশ হিসেবে লন্ডনের দুটি স্থানে তাল্লাশি চালানো হয়েছে। এছাড়া পুলিশ ধারণা করছে, হামলায় গ্রেপ্তার যুবক একাই ছিলেন। এরপরও আর কারও সম্পৃক্ততা আছে কি-না, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তিনি বর্তমানে অ্যাসেক্স পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন।
৬৯ বছর বয়সী স্যার ডেভিড অ্যামিস প্রায় ৪০ বছর ধরে পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৩ সাল থেকে বাসিলডন নামের একটি এলাকা থেকে এমপি নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৭ সাল থেকে কাছের সাউথএন্ড ওয়েস্ট আসনটি ধরে রেখেছেন তিনি। তার পাঁচ ছেলেমেয়ে রয়েছে।
ডেভিড অ্যামিসের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে টুইট করেছেন যুক্তরাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী নাধিম জাহাবি। তিনি লিখেছেন, ‘চির শান্তিতে থাকুন, স্যার ডেভিড।’ প্রাণী অধিকার, সুবিধাবঞ্চিত ও সাউথএন্ড ওয়েস্টের বাসিন্দাদের উন্নয়নে স্যার ডেভিড অ্যামিসের ভূমিকা স্মরণ করেছেন তিনি।
প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ইসলামপন্থী উগ্রবাদীরা জড়িত। পুলিশ তদন্তের অংশ হিসেবে লন্ডনের দুটি ঠিকানার খোঁজ করছে। পুলিশের ধারণা, গ্রেপ্তার ব্যক্তি একাই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন।
রোমান ক্যাথলিক হিসেবে বেড়ে ওঠা স্যার ডেভিড অ্যামিস রাজনৈতিকভাবে সামাজিক সমতার পক্ষে ছিলেন। গর্ভপাতবিরোধী অবস্থান ও বন্য প্রাণী সুরক্ষায়ও সোচ্চার ছিলেন তিনি।
যুক্তরাজ্যে গত পাঁচবছরে ডেভিড অ্যামিসসহ দুইজন এমপি হামলায় নিহত হলেন। এর আগে ২০১৬ সালে লেবার পার্টির এমপি জো কক্সকে হত্যা করা হয়। উত্তর ইংল্যান্ডে নিজের নির্বাচনী এলাকায় প্রথমে তাকে গুলি ও পরে ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল।
এর আগে ২০১০ সালে লেবার পার্টির এমপি স্টিফেন টিমস তার নিজ কার্যালয়ে ছুরিকাঘাতের শিকার হয়েছিলেন। চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
মুসলিম কমিউনিটিতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা
ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দেশটিতে জঙ্গি হামলার শঙ্কার কথা জানান দিচ্ছিল। এর মধ্যেই একজন পার্লামেন্টারিয়ানের হত্যার ঘটনায় মুসলিম জঙ্গিবাদের সংশ্লিষ্টতার খবরকে উদ্বেগজনক হিসেবে দেখছেন মুসলিম কমিউনিটির নেতারা।
যুক্তরাজ্যে মুসলিমদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ৩০ লাখের বেশি মুসলিমের মধ্যে অন্তত সাত লাখই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত।
সাউথ লন্ডনের লেবার পার্টির প্রবীণ নেতা মোহাম্মদ ইসলাম। এবার তিনি ক্রয়োডন কাউন্সিলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শনিবার সকালে সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, এই ঘটনা নিঃসন্দেহে ব্রিটিশ মুসলিমদের বিপাকে ফেলবে। যুক্তরাজ্যের মুসলিম কমিউনিটিতে এই মুহূর্তে বাংলাদেশিরা নানা সেক্টরে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সেই সময়ে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য উদ্বেগের।
এই ঘটনায় যুক্তরাজ্যে ইউকিপ, উগ্র ডানপন্থী ব্রিটিশ ন্যাশনাল পার্টির মতো বর্ণবাদী দলগুলো সুযোগ পাবে। অতীতের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ ধরনের কোনও জঙ্গি হামলার পর যুক্তরাজ্যে হেট ক্রাইম বা বিদ্বেষমূলক অপরাধ বেড়ে যায়। আর এসবের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন মুসলিমরা। বিশেষ করে দাড়িওয়ালা মানুষ, হিজাব পরিহিতা মুসলিম নারীরা হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন।
মোহাম্মদ ইসলাম বলেন, ইসলাম সব সময় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। এই সত্যকে ধারণের পাশাপাশি আমাদের সন্তানদের প্রজন্মকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলতে হবে।
বাংলাদেশি কমিউনিটির বর্ষীয়ান সাংবাদিক, লেখক ড. রেনু লুৎফা ওই সংবাদমাধ্যমকে বলেন, পৃথিবীতে মুসলমানদের খুবই খারাপ সময় যাচ্ছে। প্রধান কারণ হলো অশিক্ষা ও কুশিক্ষা। সন্দেহ নেই এই ঘটনা ব্রিটিশ মুসলিমদের বেকায়দায় ফেলবে। তবে নিরাপত্তার জন্য এখন ব্রিটিশ সরকার যে আইন করবে তাতে মুসলমানদের আলাদা করে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনও কারণ আছে বলে মনে হয় না। মিডিয়া একে মুসলিম নাম দেবে। কিন্তু উগ্রবাদীর কোনও ধর্ম নেই। যেমন এমপি জো কক্সের হত্যাকারীরও ছিল না। ব্রিটিশ মুসলমানদের উচিৎ, এই অপরাধী ও অপরাধের বিরুদ্বে কথা বলা, জনমত গঠনে কাজ করা।
যুক্তরাজ্যে চলমান জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সৌদি আরবই প্রধান বৈদেশিক পৃষ্ঠপোষক বলে ব্রিটিশ বিশ্লেষকদের একটি অংশ দাবি করেছেন। তাদের অভিযোগ, ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর দেশের বাইরে থেকে অর্থায়ন, বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের প্রচারক এবং সহিংসতা বাড়াতে কাজ করা জঙ্গি দল— এ বিষয়গুলোর মধ্যে একটি পরিষ্কার সম্পর্ক রয়েছে, যা দিন দিন আরও স্পষ্ট ও বিস্তৃত হচ্ছে।
তারা বলেন, ইরানসহ বেশ কয়েকটি উপসাগরীয় দেশ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন মসজিদ এবং অন্যান্য ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। তারই অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানে মৌলবাদী মতাদর্শ প্রচারকরা তাদের বক্তব্য প্রচার করছে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো জঙ্গিবাদী উপকরণ ও সরঞ্জাম ছড়ানোর ঘাঁটি হিসেবে বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছে।
দাবি করা হয়, সহায়তাকারীদের তালিকায় প্রথমেই রয়েছে সৌদি আরব। দেশটির বহু ব্যক্তি ও ফাউন্ডেশন ‘অনুদার, ধর্মীয় গোঁড়ামিপূর্ণ ওয়াহাবি মতবাদ’ প্রচারে ব্যাপকভাবে জড়িত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০৯
আপনার মতামত জানানঃ