করোনাকালে বেড়েছে নারী উন্নয়নে বড় বাধা বাল্যবিবাহ, যা নারী নেতৃত্বের পথেও অন্তরায়। করোনাকালে স্কুলগুলো বন্ধ, কাজ না থাকা, যৌন সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ায় বাল্যবিবাহের সংখ্যা। বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে বাল্য বিয়ে আক্রান্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় আলোচ্য অবস্থানে। বাল্যবিবাহের ফলে অল্পবয়সে গর্ভধারণ ও সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে প্রতি বছর মারা যায় ২০০০ কিশোরী। দৈনিক হিসেবে এই মৃত্যুসংখ্যা ৬ জন।
শিশু অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানিয়েছে ভারতের অন্যতম জাতীয় দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমস।
তবে বাল্যবিবাহের ফলে অল্পবয়সে গর্ভধারণ ও সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতিদিন বিশ্বজুড়ে মারা যাচ্ছে ৬০ জনেরও বেশি কিশোরী; আর এই মৃত্যুর অর্ধেকই ঘটছে পশ্চিম ও মধ্য আফিকার দেশসমূহে।
সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোতে গর্ভধারণ ও সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় ৯ হাজার ৬০০ কিশোরী, যা এ জনিত কারণে বার্ষিক মৃত্যুর প্রায় অর্ধেক। অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ৩০ জন কিশোরীর মারা যাচ্ছে আফ্রিকায়।
এছাড়া, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে সন্তান ধারণ ও জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি বছর মারা যায় ২০০০ কিশোরী। দৈনিক হিসেবে এই মৃত্যুসংখ্যা ৬ জন।
এছাড়া পূর্ব এশিয়ায় প্রতি বছর মারা যায় ৬৫০ জন এবং লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে এই সংখ্যা ৫৬০। এই কিশোরীদের সবাই বাল্য বিবাহের শিকার এবং সন্তান ধারণ ও জন্মদান করতে গিয়েই তাদের মৃত্যু হয় বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে সেভ দ্য চিলড্রেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাল্যবিবাহ বন্ধে গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বজুড়ে নানামুখী তৎপরতা চলছিল এবং তাতে কিছু সাফল্য আসাও শুরু করেছিল, কিন্তু করোনা মহামারির কারণে সেসব তৎপরতা অনেকাংশে সীমিত হয়ে পড়ায় ফের উন্নয়নশীল ও আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোতে বাড়ছে এই সামাজিক সমস্যা। এছাড়া, বিশ্বজুড়ে নারীর প্রতি সহিংসতাও বাড়িয়েছে মহামারি।
২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে আরও এক কোটি কিশোরী বাল্যবিবাহের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে আছে বলে প্রতিবেদনে শঙ্কা জানিয়েছে সেভ দ্য চিলড্রেন।
আন্তর্জাতিক এই উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রধান নির্বাহী ইঙ্গের অ্যাশিং এক বার্তায় বলেন, ‘কিশোরী অবস্থায় নারীদের সন্তান ধারণ ও জন্মদানের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত থাকে না, এ কারণেই বাল্যবিবাহের শিকার কিশোরীদের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার বেশি থাকে। এই ক্ষতিকর সামাজিক প্রথা কিশোরীদের প্রধান হত্যাকারী।’
বাল্যবিবাহ বন্ধে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশসমূহের সরকারদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন ইঙ্গের অ্যাশিং।
মার্চে জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ ‘কোভিড-১৯: অ্যা থ্রেট টু প্রোগ্রেস এগেইনস্ট চাইল্ড ম্যারেজ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে সতর্ক করে বলা হয়, বিদ্যালয় বন্ধ থাকা, আর্থিক চাপ, সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া, গর্ভাবস্থা ও মহামারির কারণে বাবা-মায়ের মৃত্যু সবচেয়ে দুর্বল মেয়েশিশুদের বাল্যবিয়ের ভয়াবহ ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি টোমো হোযুমি বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্ল্যেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও, বাল্যবিয়ের প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। কোভিড-১৯ সমস্যাটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। লাখ লাখ মেয়ে এর মুখোমুখি। বিদ্যালয় বন্ধ থাকা, বন্ধু ও সাপোর্ট নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এবং দারিদ্র বেড়ে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো এই মেয়েদের বাল্যবিয়ের উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।’
বাল্যবিবাহ কিশোরী মেয়েদের সহজাত উচ্ছ্বাস, বৃদ্ধি ও গতিশীলতাকে থামিয়ে দেয়। প্রচলিত শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকার কারণে পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত জ্ঞানের অভাব থাকে। এর ফলে অধিক সন্তান গ্রহণের প্রবণতা তৈরি হয়। কৈশোরকালে গর্ভধারণের ফলে মেয়েরা অপুষ্টিতে ভোগে এবং গর্ভকালে বিভিন্ন জটিলতা তৈরি হয়। অপ্রাপ্ত বয়সে সন্তান প্রসবের কারণে মা ও শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
এ কারণে বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে রক্ষা পেতে সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পাশাপাশি বাল্যবিবাহবিরোধী পদক্ষেপের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত। সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাল্যবিবাহকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশ বাল্যবিয়ে রোধে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করলেও নীতিনির্ধারকরা হঠাৎ করে আসা মহামারির কবলে পড়ে অজান্তেই বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে এর বিরূপ প্রভাব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তারা মনে করেন, মহামারিতে বাল্যবিয়ের শিকার হওয়া মেয়েরা যাতে স্কুলে ফিরে আসতে পারে, তার জন্য এখন সরকারের সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
এসডব্লিউ/কেএইচ/১৭৫২
আপনার মতামত জানানঃ