বিশ্বে চলছে সোশ্যাল মিডিয়ার রাজত্ব। যুগের চাহিদায় দিন দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে। ফেসবুক ছাড়া এখন ভাবাই অসম্ভব। কী নেই এখানে? চাইলেই সবকিছু মেলে নেট দুনিয়ায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে ফেসবুক। ভুয়া তথ্য প্রচার, অশালীন মন্তব্য ও ঘৃণা ছড়ানোর অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এ মাধ্যম। এ ছাড়া ফেসবুকের বিরুদ্ধে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদে সমর্থন ও পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ তুলেছেন বিশ্বের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা। মানুষকে বিপথগামী করতে রীতিমতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দীনের অভিযোগ ছিলো সন্ত্রাসী, জঙ্গি সংগঠনগুলোকে অপপ্রচার চালাতে সহায়তার। সেই অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে জনপ্রিয় এই সামাজিক মাধ্যম বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চার হাজারের বেশি সন্ত্রাসী-জঙ্গি সংগঠন এবং ব্যক্তিকে গোপন কালো তালিকাভুক্ত করেছে; যারা অনলাইন-অফলাইনে সহিংসতার বিস্তার করেন। এই তালিকায় বাংলাদেশের এক ব্যক্তি ও ছয় জঙ্গি সংগঠনের নাম রয়েছে।
ফেসবুকের ‘ডেঞ্জারাস ইন্ডিভিজুয়ালস অ্যান্ড অর্গানাইজেশন্স’ পলিসির আওতায় গোপন এই কালো তালিকার একটি সংস্করণ প্রকাশ করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্টারসেপ্ট।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জঙ্গি সংগঠন, হিংসা-বিদ্বেষ সহিংসতার প্রচারকারী গোষ্ঠী এবং রাজনীতিবিদেরও এই তালিকায় যুক্ত করেছে ফেসবুক। তালিকায় বাংলাদেশের যে ছয় জঙ্গি সংগঠনের নাম রয়েছে সেগুলো হলো—
১. আল মুরসালাত মিডিয়া
২. ইসলামিক স্টেট বাংলাদেশ
৩. হরকাত উল-জিহাদ-ই-ইসলামী বাংলাদেশ
৪. আনসারুল্লাহ বাংলা টিম
৫. জামায়াত উল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)
৬. সাহাম আল-হিন্দ মিডিয়া
ফেসবুক বলছে, সাহাম আল-হিন্দ মিডিয়ার সঙ্গে জামায়াত উল মুজাহিদিন বাংলাদেশের এবং আল মুরসালাত মিডিয়ার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের সম্পর্ক রয়েছে।
ফেসবুকের বিপজ্জনক ব্যক্তির তালিকায় এক বাংলাদেশির নামও রয়েছে। তরিকুল ইসলাম নামে ওই বাংলাদেশির সঙ্গে জামায়াত উল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) সম্পর্ক আছে বলে জানিয়েছে ফেসবুক। তবে ওই ব্যক্তির ব্যাপারে বিস্তারিত আর কোনও তথ্য জানানো হয়নি।
দ্য ইন্টারসেপ্ট ফেসবুকের গোপন কালো তালিকাভুক্ত সব সংগঠন এবং ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন দেশে পরিচালিত দাতব্য সংস্থা, হাসপাতাল, লেখক, কয়েকশ মিউজিক ভিডিও, রাজনীতিক এবং মৃত ঐতিহাসিক ব্যক্তির নামও রয়েছে। তালিকায় ঠাঁই পাওয়া সব সংগঠন এবং ব্যক্তি বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই প্ল্যাটফর্মে নিষিদ্ধ।
যেসব ব্যবহারকারী ফেসবুকে এসব গোষ্ঠী বা ব্যক্তিকে নিয়ে আলোচনা করেন; তাদের ফেসবুকের ডিআইও নীতিমালা অনুযায়ী, তিন-স্তরের শাস্তির আওতায় আনে এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
ফেসবুক বলেছে, সন্ত্রাসী এবং জঙ্গি সংগঠনগুলোর মতো যারা অফলাইনে মারাত্মক ক্ষতিকর কাজ করতে পারেন; তাদেরকে কালো তালিকার প্রথম স্তরে রাখে ফেসবুক। এছাড়া সিরিয়ার সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মতো যেসব সহিংস বিদ্রোহী গোষ্ঠী রয়েছে তাদের দ্বিতীয় স্তর এবং তৃতীয় স্তরে এমন ব্যক্তি ও সংগঠনকে রাখা হয়; যারা ফেসবুকের বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং বিপজ্জনক সংগঠনের নীতিমালা লঙ্ঘন করে। তবে তারা অগত্যা সহিংসতায় জড়িত হয়নি বা সহিংসতায় সমর্থন দেয়নি।
বাংলাদেশের যেসব সংগঠন এবং ব্যক্তির নাম ফেসবুকের গোপন কালো তালিকায় রয়েছে; তাদেরকে নিয়ে ফেসবুকে আলোচনা করা হলে চরম শাস্তি হতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দীনের অভিযোগ ছিলো সন্ত্রাসী, জঙ্গি সংগঠনগুলোকে অপপ্রচার চালাতে সহায়তার। সেই অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে জনপ্রিয় এই সামাজিক মাধ্যম বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চার হাজারের বেশি সন্ত্রাসী-জঙ্গি সংগঠন এবং ব্যক্তিকে গোপন কালো তালিকাভুক্ত করেছে; যারা অনলাইন-অফলাইনে সহিংসতার বিস্তার করেন। এই তালিকায় বাংলাদেশের এক ব্যক্তি ও ছয় জঙ্গি সংগঠনের নাম রয়েছে।
জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বিরুদ্ধে সম্প্রতি বিভাজন সৃষ্টি, শিশুদের ক্ষতি করা, নিরাপত্তার চেয়ে লাভের দিকে বেশি নজর দেওয়া ও গুজব ছড়ানোসহ নানা অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি ফেসবুককে গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে অভিযোগ করেছেন সদ্য নোবেলজয়ী সাংবাদিক মারিয়া রেসা। এছাড়া ফেসবুকের বিরুদ্ধে ভুয়া খবর ও গুজবকে প্রাধান্য দেওয়ারও অভিযোগ তুলেছেন তিনি।
রেসা বলেন, ফেসবুক গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যটি ঘৃণা, ভুয়া তথ্য ও গুজব ছড়ানো রুখতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। ফেসবুক তথ্য নিয়ে একেবারেই নিরপেক্ষ নয় বলে অনেকবার প্রমাণ পাওয়া গেছে। নিরপেক্ষতার চেয়ে ঘৃণা, ক্ষোভ এবং মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর উপরই বেশি গুরুত্ব দেয় জনপ্রিয় এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি।
ফেসবুকের সিভিক মিসইনফরমেশন টিমের সাবেক প্রোডাক্ট ম্যানেজার ফ্রান্সেস হিউগেনও সম্প্রতি ফেসবুক নিয়ে বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করেছেন। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, ফেসবুক মানুষের চেয়ে মুনাফার দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়।
ফেসবুকের এহেন কর্মকাণ্ডে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন টাইম তাদের সর্বশেষ প্রচ্ছদেও ফেসবুকের এই বিষয়টি সামনে এনেছেন। ওই প্রচ্ছদে দেখা গেছে জাকারবার্গের মুখের ওপর একটি ‘ডিলিট ফেসবুক’ লেখা আইকন। আইকনের নিচে রয়েছে দুটি অপশন— ‘ক্যান্সেল’ আর ‘ডিলিট’।
অনলাইনে সক্রিয় দেশের জঙ্গিবাদ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে অতিমারির কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্ব একটি কঠিন সময় পার করছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ওপর এর প্রভাব পড়া স্বাভাবিক। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কোনো বড় কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি। তবে নিজেদের মতাদর্শ বিস্তার ও সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে এই সময়কে কাজে লাগানোর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বর্তমান কোভিডকালীন বাস্তবতায় আমাদের জীবনের একটা বড় সময় কাটছে কম্পিউটার পর্দার সামনে। এই ‘পর্দার সময়’ বা স্ক্রিন টাইম সাধারণভাবে ৬০ ভাগ বেড়েছে। তরুণদের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি হতে পারে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো তাদের উগ্র মতবাদ ছড়ানোর কাজে এই পরিস্থিতির সুযোগ সম্পূর্ণভাবে নিচ্ছে।
এর মাধ্যমে তারা অনলাইনে সদস্য সংগ্রহের প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ৯ কোটির বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ পুলিশের এক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, গ্রেপ্তার ২৫০ ধর্মীয় সন্ত্রাসীর মধ্যে ৮২ শতাংশই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রাথমিকভাবে উগ্র মতবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। বর্তমান কোভিডকালে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে দীক্ষিত হওয়ার যে বাড়তি সুযোগ ও পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার ফলাফল আমরা হয়তো সামনে দেখতে পেতে পারি।
তারা বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি শুধু ‘কাইনেটিক’ অপারেশন বা শক্তি প্রয়োগের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে এখনই পাল্টা উগ্রবাদ কৌশল প্রণয়নের প্রয়োজন আছে। পুরো সমাজ ও বিভিন্ন গোষ্ঠীকে যুক্ত করে এবং সরকারের সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে উগ্রবাদ মোকাবিলার প্রস্তুতি থাকতে হবে। ডির্যাডিক্যালাইজেশনের মতো বিশেষায়িত জাতীয় কৌশলনীতি প্রণয়ন করতে হবে। জঙ্গিদের পুনর্বাসনের কর্মসূচি নিতে হবে, কারাগার যেন জঙ্গিবাদ ছড়ানোর ক্ষেত্র না হয়, সেই লক্ষ্যে কর্মসূচি নিতে হবে। তরুণসমাজকে বিবেচনায় নিয়ে আমাদের এখনই প্রযুক্তিগতভাবে পাল্টা উগ্রবাদবিরোধী কৌশল নিতে হবে। অ্যাডহক বা অস্থায়ী কৌশলের পথ পরিহার করে সামগ্রিকভাবে বিষয়টিকে দেখতে হবে। তাহলেই সন্ত্রাসবাদকে শুধু সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং জাতীয় পর্যায়েই নির্মূল করার পথে অগ্রসর হতে পারব।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪৩
আপনার মতামত জানানঃ