কোনও একটি জায়গায় বছরের পর বছর ধরে আবহাওয়ার যে গড়-পড়তা ধরন, তাকেই বলা হয় জলবায়ু। আবহাওয়ার সেই চেনাজানা ধরন বদলে যাওয়াকেই বলা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। পৃথিবী গরম হয়ে পড়ছে এবং তার ফলে দ্রুত বদলে যাচ্ছে আবহাওয়ার বহুদিনের চেনাজানা আচরণ। আর এই বদলে যাওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ হাতটিই মানুষের। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিসহ প্রকৃতির ওপর নানা অত্যাচারে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান ক্রীড়নক ভাবা হয় মানুষকে। বৈশ্বিক এই উষ্ণতা বিশ্বের ৮০ শতাংশ ভূ-অঞ্চলে প্রভাব ফেলেছে। এদিকে বিশ্বের অন্তত ৮৫ শতাংশ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তন দ্বারা সৃষ্ট আবহাওয়া বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছেন। সোমবার ‘ন্যাচার ক্লাইমেট চেঞ্জ’ সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণায় এই তথ্য পাওয়া গেছে। খবর দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।
মেশিন লার্নিং (এমএল) পদ্ধতিতে ভূ-মানচিত্র তৈরির মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতার সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে এমন এক লাখের বেশি ঘটনার বিশ্লেষণ করেন গবেষকরা। জীবাশ্ম জ্বালানি এবং কার্বন নিঃসরণের অন্যান্য উৎস থেকে সৃষ্ট তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠিত তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে এই বিশ্লেষণ মেলানো হয়।
গবেষণায় ফসল উৎপাদন হ্রাস, বন্যা, তাপদাহের মতো ঘটনাগুলো প্রাধান্য পায়। সম্মিলিত ফলাফল থেকে গবেষকরা মানুষের দৈনন্দিন কার্যক্রমের সঙ্গে আবহাওয়া বিপর্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার স্পষ্ট সংযোগ খুঁজে পান। সেই অনুসারে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বিশ্বের ৮০ শতাংশ ভূ-অঞ্চলে প্রভাব ফেলেছে বলে জানান গবেষকরা।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ুর এই পরিবর্তনে বদলে যাবে আমাদের জীবন যাপন। পানির সঙ্কট তৈরি হবে। খাদ্য উৎপাদন কঠিন হয়ে পড়বে। কোনো কোনো অঞ্চল বিপজ্জনক মাত্রায় গরম হয়ে পড়বে এবং সেই সাথে সমুদ্রের পানি বেড়ে বহু এলাকা প্লাবিত হবে। ফলে সে সব জায়গা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
অতিরিক্ত গরমের পাশাপাশি ভারি বৃষ্টি এবং ঝড়ের প্রকোপ অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকবে। ফলে জীবন এবং জীবিকা হুমকিতে পড়বে। গরীব দেশগুলোতে এসব বিপদ মোকাবেলার সক্ষমতা কম বলে তাদের ওপর এই চরম আবহাওয়ার ধাক্কা পড়বে সবচেয়ে বেশি।
তাপমাত্রা বাড়ায় উত্তর মেরুর জমাট বাধা বরফ এবং হিমবাহগুলো দ্রুত গলে যাচ্ছে। ফলে সাগরের উচ্চতা বেড়ে উপকূলের নিচু এলাকাগুলো ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।
এছাড়া সাইবেরিয়ার মত অঞ্চলে মাটিতে জমে থাকা বরফ গলতে থাকায় বরফের নিচে আটকে থাকা মিথেন গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়বে। ফলে, মিথেনের মত আরেকটি গ্রিনহাউজ গ্যাস জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে। পৃথিবীর উষ্ণতা তাতে আরো বাড়বে এবং বন-জঙ্গলে আগুন লাগার ঝুঁকি বাড়বে।
কিন্তু জলবায়ুর এই পরিবর্তন এত দ্রুত হারে এখন ঘটছে যে অনেক প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। যেমন, বরফ গলতে থাকায় পোলার বিয়ার বা উত্তর মেরুর শ্বেত ভালুকের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছে।
পাশাপাশি, আটলান্টিক মহাসাগরের স্যামন মাছ বিপন্ন হবে, কারণ যেসব নদীতে ঢুকে তারা ডিম পেড়ে বাচ্চার জন্ম দেয়, সেগুলোর পানি গরম হয়ে যাচ্ছে।
ট্রপিক্যাল অঞ্চলের কোরাল রিফ বা প্রবাল-প্রাচীর উধাও হয়ে যেতে পারে, কারণ বায়ুমণ্ডলের অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড সাগরের পানিতে মিশে পানির অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।
কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া বর্তমান গতিতে চলতে থাকলে ২১ শতকের শেষ নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে, খাদ্য ও পানির সংকটসহ ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে বিশ্ব।
জার্মানির মার্কেটর রিসার্চ ইন্সটিটিউট অন গ্লোবাল কমনস অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জের গবেষক ও গবেষণাটির প্রধান লেখক ম্যাক্স কালাগ্যান বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে আমাদের সমাজ ও বাস্তুতন্ত্রে প্রভাব ফেলছে তার প্রমাণ হিসেবে আমাদের কাছে এখন বিশদ তথ্য রয়েছে।”
নিউ ইয়র্ক শহর থেকে শুরু করে দক্ষিণ সুদানের মানুষের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য প্রদান করেছে এই গবেষণা। কালাগ্যান বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন দৃশ্যমান এবং বিশ্বের প্রায় সকল স্থানেই তা চোখে পড়ছে।”
আগামী মাসে স্কটল্যান্ডের গ্লাসকোতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনের শীর্ষ সম্মেলন কপ-২৬ কে সামনে রেখে প্রকাশিত হলো এই গবেষণা। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর ওপর দৃঢ় জলাবায়ু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে চাপ প্রয়োগ করবে বলেই আশা করছেন গবেষকরা।
গবেষণায় বিশ্বের ৮৫ শতাংশ মানুষের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। তবে, লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজের গ্র্যানথাম ইন্সটিটিউট ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্টের সিনিয়র লেকচারার ফ্রেডরিক অটো এই হারকেও কম বলে মনে করছেন।
তিনি বলেন, “মানব নিঃসৃত গ্রিনহাউজের প্রভাবে বিশ্বের সকল মানুষেরই চরম আবহাওয়ার সম্মুখীন হওয়ার কথা।”
এর আগে এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া বর্তমান গতিতে চলতে থাকলে ২১ শতকের শেষ নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে, খাদ্য ও পানির সংকটসহ ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে বিশ্ব।
চীন ও ভারতসহ বিশ্বের শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো এখন পর্যন্ত ২০৩০ সাল নাগাদ নিঃসরণ কমানোর নতুন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আনুষ্ঠানিক অঙ্গীকার গ্রহণ করেনি। পরিবেশবাদী ও আন্দোলনকারীরা বাড়তে থাকা জ্বালানি সংকট নিয়ে চিন্তিত। জ্বালানি সংকটে বাড়ছে পণ্যের দাম, দেখা দিয়েছে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা। ফলে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি রক্ষায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো নিয়েও বাড়ছে অনিশ্চয়তা।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট এবং ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের হিসাব অনুসারে, চলতি বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইতোমধ্যে আবহাওয়াজনিত বিপর্যয়ে ৩৮৮ জনের প্রাণহানিসহ ১০০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রাকৃতিক কারণে জলবায়ুতে স্বাভাবিকভাবেই কিছু পরিবর্তন হয়। কিন্তু যে মাত্রায় এখন তাপমাত্রা বাড়ছে তার মানুষের কর্মকাণ্ডেই প্রধানত দায়ী। মানুষ যখন থেকে কল-কারখানা এবং যানবাহন চালাতে বা শীতে ঘর গরম রাখতে তেল, গ্যাস এবং কয়লা পোড়াতে শুরু করলো সেই সময়ের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা এখন ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে।
বায়ুমণ্ডলে অন্যতম একটি গ্রিন হাউজ গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ উনবিংশ শতকের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। গত দুই দশকে বেড়েছে ১২ শতাংশ। বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণেও বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন বাড়ছে। গাছপালা কার্বন ধরে রাখে। ফলে, সেই গাছ যখন কাটা হয় বা পোড়ানো হয়, সঞ্চিত সেই কার্বন বায়ুমণ্ডলে নিঃসরিত হয়।
তারা মনে করেন, শিল্প বিপ্লব শুরুর আগে বিশ্বের যে তাপমাত্রা ছিল তার থেকে বৃদ্ধির মাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা গেলে বড় ধরণের বিপদ এড়ানো যাবে। তা না পারলে বিপজ্জনক হয়ে পড়বে প্রকৃতি, পরিবেশ এবং মানুষের জীবন। অনেক বিজ্ঞানীর আশঙ্কা যে ভয়ঙ্কর এই পরিণতি ঠেকানোর আর কোনো উপায় নেই এবং চলতি শতকের শেষে গিয়ে বিশ্বের তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের ফলে প্রাকৃতিক যে বিপর্যয় হবে তার রূপটা হবে ভয়াবহ৷ বিশ্ব এই অবস্থার মুখোমুখি হওয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়৷ বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা যদি ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায় তবে ঝুঁকির পরিমাণও সেই অনুপাতে বাড়বে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব থেকে বিশ্বের কোনো মানুষই রেহাই পাবে না৷
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা সমাধানযোগ্য। আমাদের কাছে প্রযুক্তি আছে। বিজ্ঞান আছে। প্রয়োজন নেতৃত্ব এবং পথ পরিবর্তন করার সাহস। দূষণ রোধ করার জন্য শক্তির সুব্যবহার জরুরি। আমাদের ২০৫০ সালের মধ্যে বা শিগগিরই ‘নিট জিরো’ কার্বন নির্গমকে নিশ্চিত করতে হবে। নিট জিরো মানে— ক্রমান্বয়ে কার্বনের ভারসাম্যে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনা। নিট শূন্য নির্গমন অর্জনের জন্য, আমরা যেভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করি এবং ব্যবহার করি তার ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার।
আমাদের একটি নতুন, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা দরকার। বনভূমি উজাড় বন্ধ করা আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। উডল্যান্ড ট্রাস্ট আগামী ১০ বছরে ৬৪ মিলিয়ন গাছ লাগানোর কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তাকে অনুসরণ করাই হতে পারে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার একটি বিকল্প পথ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫০
আপনার মতামত জানানঃ