যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ক্রমাগত বাড়ছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি। ছাড়িয়ে যাচ্ছে অতীতের সব রেকর্ড। টপকে গেছে চীন ও ভিয়েতনামকে। মূলত করোনা মহামারির মধ্যেই পণ্য রপ্তানিতে নতুন রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ। গত সেপ্টেম্বর মাসে দেশের উদ্যোক্তারা মোট ৪১৭ কোটি ডলার বা প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছেন। যার মধ্যে সাড়ে ৮২ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে।
সূত্র মতে, জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ৪৩২ কোটি ১১ লাখ (৪.৩২ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৬০ পয়সা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
করোনা মহামারির মধ্যে রপ্তানির এই অর্থ গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৪ দশমিক ১১ শতাংশ বেশি। যুক্তরাষ্ট্র গত বছরের একই সময়ে অর্থাৎ জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে বাংলাদেশ থেকে ৩৪৮ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের পোশাক আমদানি করেছিল।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, একক দেশ হিসেবে বালাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয় বড় বাজার হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র। এই বাজারে সবচেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানি হয়েছিল ২০১৯ সালে; ৫৯২ কোটি ১৯ লাখ ডলার।
২০২০ সালে করোনার কারণে তা কমে ৫২২ কোটি ৮২ লাখ ডলারে নেমে আসে। ওই বছরে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকের রপ্তানি কমেছিল ১১ দশমিক ৭১ শতাংশ। গত ৫ অক্টোবর প্রকাশিত ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ কমার্সের আওতাধীন অফিস অফ টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলস (অটেক্সা) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৪৩২ কোটি ১০ লাখ ৯৪ হাজার ডলারের পোশাক আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি গত বছরের একই সময়ে আমদানি করে ৩৪৮ কোটি ৪৯ লাখ ৪০ হাজার ডলারের পোশাক। এ হিসাবে আমদানি বেড়েছে ২৪ দশমিক ১১ শতাংশ।
যে কারণে বাড়ছে রপ্তানির হার
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি করা পোশাকের অধিকাংশই কটনভিত্তিক। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে মার্কিন বাজারে সবচেয়ে বেশি আমদানি হওয়া পণ্য হলো মেনস বা বয়েজ কটন ট্রাউজার। ১৮ দশমিক ১৯ শতাংশ বেড়ে ৯৮ কোটি ডলারের এ পণ্য আমদানি হয়েছে। এ ছাড়া উইমেন বা গার্লস কটন স্ল্যাকস, মেনস বা বয়েজ নিট শার্ট, ওইমেনস বা গার্লস নিট ব্লাউজে পোশাক পণ্যগুলোর আমদানি বেড়েছে যথাক্রমে ২৮, ৭৪ ও ৫৯ শতাংশ।
গত জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ক্রয় পূর্বাভাসসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। ‘২০২১ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বেঞ্চ মার্কিং স্টাডি’ শীর্ষক ওই জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি বাণিজ্যের গতি এখনও দুর্বল। পাশাপাশি শিল্পের সামাজিক ও শ্রম কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থাপনায় এখনও ঝুঁকি দেখছেন তারা।
তবে সোর্সিং কস্ট বা পণ্য ক্রয় বাবদ ব্যয় বিবেচনায় বাংলাদেশ এখনও আকর্ষণীয়। মূলত মূল্য সুবিধায় পণ্য কিনতেই ঝুঁকি সত্ত্বেও বাংলাদেশমুখী হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক পণ্যের ক্রেতারা।
ডিসেম্বরে বড়দিনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন পোশাকশিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ-এর সভাপতি ফারুক হাসান। তিনি বলেন, ‘সে হিসাবে এবার যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বালাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি সাড়ে ৬ বিলিয়ন (৬৫০ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যাবে। আর এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।’
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘বিপুলসংখ্যক মানুষকে করোনার টিকা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। তাই ওই দেশের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো আগামী গ্রীষ্ম ও বসন্ত মৌসুমের জন্য করোনার আগের মতোই ক্রয়াদেশ দিচ্ছে। তা ছাড়া মিয়ানমারে সেনাশাসন ও ভারতে করোনার ভয়াবহতার কারণেও কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হয়।
তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে থেকেই কিছু ক্রয়াদেশ চীন থেকে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে স্থানান্তর করেন আমেরিকার ক্রেতারা। ভিয়েতনামে লম্বা সময় লকডাউন থাকার কারণেও কিছু ক্রয়াদেশ এসেছে। সব মিলিয়ে ২০১৯ সালের তুলনায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশের বেশি ক্রয়াদেশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তার সুফল আগামী দিনগুলোতে পাওয়া যাবে।’
চীন ও ভিয়েতনামকে টপকে গেছে বাংলাদেশ
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধিতে চীন ও ভিয়েতনামকে টপকে গেছে বাংলাদেশ। একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে করোনা পরিস্থতি উন্নতি হওয়ায় তৈরি পোশাক পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতেও আগের চেয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ। আর্থিকভাবে এর পরিমাণ ৩১৩ কোটি ডলার। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ২০ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং চীনের বেড়েছে ২৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময়ে পোশাক পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশ চীন এবং ভিয়েতনামের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ কর্মাসের ‘অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেলস (ওটেক্সা)-এর প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বিভিন্ন দেশ থেকে পোশাক আমদানির পরিসংখ্যান নিয়ে ওটেক্সা তাদের প্রতিবেদনটি তৈরি করে।
ওটেক্সার প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার কারণে ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পোশক পণ্যের রপ্তানি কমে যায় ৩০ শতাংশ। ওই সময়ে বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি কমে ২০ শতাংশ।
তবে চলতি বছর দেশটিতে ব্যাপকভাবে মানুষকে করোনার টিকা দেয়া শুরু হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এর ফলে অভ্যন্তরীণ ভোগ ব্যয় ও মানুষের কেনাকাটাও বেড়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ওপর। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানিতে উল্লম্ফন দেখা গেছে, যার সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশও।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬২০
আপনার মতামত জানানঃ