বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমন যতই বাড়ছে, ততই বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা৷ এ কারণে এই শতকেই বিশ্বের অনেক মানুষ খাদ্যাভাবে পড়বে, বাড়বে স্বাস্থ্য ঝুঁকি৷ আর তার সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানুষে মানুষে হানাহানি৷ এক প্রতিবেদনে এই শঙ্কা জানিয়েছে বৈশ্বিক থিঙ্কট্যাংক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড পিস(আইইপি)।
আইইপির বৃহস্পতিবারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রভাবে উষ্ণতা বৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ খাদ্য ও পানীয়জলের সঙ্কটে পড়েছেন এবং দিন দিন এই সংকটের আওতা বাড়ছে।
তাছাড়া, বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যার বৃদ্ধির কারণে অতিরিক্তমাত্রায় ব্যাবহার করা হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানী, ধ্বংস করা হচ্ছে বনাঞ্চল— যা জলবায়ু পরিবর্তনের গতি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দশকগুলোতে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানীয়জলের অভাবে থাকা মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা। এসব কারণে অদূর ভবিষ্যতে দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে এবং মানুষে-মানুষে সংঘাত ছড়িয়ে পড়বে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে আইইপি।
প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করতে প্রয়োজনীয় তথ্য জাতিসংঘ ও অন্যান্য উৎস থেকে নেওয়া হয়েছে বলে বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন আইইপি ইউরোপ শাখার পরিচালক সের্জ স্ট্রুব্যান্টস।
রয়টার্সকে এ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্যসমূহ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তন ও এ কারণে সৃষ্ট দুর্যোগ ও সংকটের প্রত্যক্ষ্য ভূমিকা রয়েছে।
প্রতিবেদনে এশিয়া ও আফ্রিকার ৩০ টি দেশকে দেশকে ‘হটস্পট’ হিসেবে উল্লেখ করে আইইপি বলেছে, গত একদশকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয় সবচেয়ে বেশি দেখা এই ৩০ টি দেশে। এসব বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে বন্যা, খরা ও উষ্ণতা বৃদ্ধি।
ফলে, এসব দেশে বসবাসকারী ১২৬ কোটি মানুষের একটি বিরাট অংশ ইতোমধ্যে খাদ্য ও পানীয়জলের নিরাপত্তাহীনতা ও আবাসন সংকটের মধ্যে পড়েছেন এবং তার প্রভাবে সংঘাতও বাড়ছে তাদের মধ্যে।
এক্ষেত্রে আফগানিস্তানের উদাহারণ টেনে আইইপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত প্রায় তিন দশক ধরে আফগানিস্তানে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা চলছে।
দেশটির গত ৫০ বছরের জলবায়ুর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আফগানিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি খরা, উষ্ণতা বৃদ্ধি ঘটেছে গত ৩০ বছরে। যার প্রভাবে দেশটিতে খাদ্য ও পানীয় জলের নিরাপত্তা নেই— এমন মানুষের সংখ্যরাও বেড়েছে।
এছাড়া একই চিত্র দেখা গেছে আফ্রিকার সাহেল ও হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলে।
রয়টার্সকে সের্জ স্ট্রুব্যান্টস বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যে হারে পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা যাচ্ছে, তা যদি অব্যাহত থাকে— সেক্ষেত্রে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর পুরো ব্যবস্থা ভেঙে পড়া দেখতে সম্ভবত আমাদের আর খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।’
জলবায়ু পরিবর্তনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দশকগুলোতে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানীয়জলের অভাবে থাকা মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা। এসব কারণে অদূর ভবিষ্যতে দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে এবং মানুষে-মানুষে সংঘাত ছড়িয়ে পড়বে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে আইইপি।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে বিপর্যয় শুরু হবে ২০৩০ সালে। এটি ২০৫০ সালে ভয়াবহ আকার নেবে। সেই সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চার কোটি মানুষ অভিবাসী হবে। যার অর্ধেক হবে বাংলাদেশি।
আরেকটি জরিপে দেখা গেছে, বিমান ভ্রমণ পরবর্তী ২০ বছরে বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ আরো ২ শতাংশ বাড়িয়ে দেবে। ফলস্বরূপ, দুর্যোগ আরো দ্রুত তরান্বিত হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী তিন দশকে ২১৭ মিলিয়ন মানুষ গৃহহীন হবে।
আন্তর্জাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং বিশ্বজুড়ে সম্পদের বৈষম্য কমাতে জরুরি পদক্ষেপ না নেওয়া হলে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে না। প্রতিবেদনে সংকট মোকাবিলায় ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমন কমাতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ফলস্বরূপ, অভিবাসনের হার পর্যন্ত কমানো সম্ভব।
এপি ও আলজাজিরার তথ্য মতে, বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি একটি ‘গ্রাউন্ডসওয়েল’ রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানির সংকট, ফসলের উৎপাদন হ্রাস এবং সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংস্থাটি আশঙ্কা করছে যে ২০৫০ সালের মধ্যে ছয়টি অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অভিবাসী হতে পারে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে ভয়াবহ পরিস্থিতি শুরু হবে, যা ২০৫০ সালের মধ্যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর অন্যতম। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় খুবই সাধারণ ঘটনা। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশের বসবাসের এই এলাকাগুলো ওইসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সাধারণত বর্ষাকালে উজানে প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে নদীর পানি বেড়ে যায় এবং তা প্রচণ্ড গতিতে সমুদ্রের দিকে ধাবিত হয়। এ সময় উপকূলীয় অঞ্চলের নদীসংলগ্ন স্থলভাগে পানির তীব্র স্রোতে সৃষ্টি হয় নদীভাঙনের।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক উৎপাদনের জন্য যেখানে ছিল যথাযোগ্য তাপমাত্রা, ছিল ছয়টি আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ঋতু, সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতুবৈচিত্র্য হারিয়ে যেতে বসেছে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা সবকিছুতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী ৩৫ দশমিক ৭ মিলিয়ন মানুষ দক্ষিণ এশিয়ার জলবায়ু অভিবাসী হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার জলবায়ু অভিবাসীদের অর্ধেকই হবে বাংলাদেশি। ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ অভিবাসনের ঝুঁকিতে পড়বে। যার মধ্যে নারীর সংখ্যাই হবে বেশি ।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের ফলে প্রাকৃতিক যে বিপর্যয় হবে তার রূপটা হবে ভয়াবহ৷ বিশ্ব এই অবস্থার মুখোমুখি হওয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়৷ বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা যদি ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায় তবে ঝুঁকির পরিমাণও সেই অনুপাতে বাড়বে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব থেকে বিশ্বের কোনো মানুষই রেহাই পাবে না৷
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা সমাধানযোগ্য। আমাদের কাছে প্রযুক্তি আছে। বিজ্ঞান আছে। প্রয়োজন নেতৃত্ব এবং পথ পরিবর্তন করার সাহস। দূষণ রোধ করার জন্য শক্তির সুব্যবহার জরুরি। আমাদের ২০৫০ সালের মধ্যে বা শিগগিরই ‘নিট জিরো’ কার্বন নির্গমকে নিশ্চিত করতে হবে। নিট জিরো মানে— ক্রমান্বয়ে কার্বনের ভারসাম্যে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনা। নিট শূন্য নির্গমন অর্জনের জন্য, আমরা যেভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করি এবং ব্যবহার করি তার ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার।
আমাদের একটি নতুন, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা দরকার। বনভূমি উজাড় বন্ধ করা আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। উডল্যান্ড ট্রাস্ট আগামী ১০ বছরে ৬৪ মিলিয়ন গাছ লাগানোর কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তাকে অনুসরণ করাই হতে পারে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার একটি বিকল্প পথ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২৪
আপনার মতামত জানানঃ