তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশটিতে আফিমের দাম আকাশচুম্বী বেড়ে গেছে। ১৫ আগস্ট তালিবান কাবুলের দখল নেওয়ার পর থেকে দেশটিতে আফিমের দাম বেড়েছে তিনগুণ। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি’র এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
ইউরোপীয় বাজারে পাচারের আগে এসব আফিমকে হিরোইনে রুপান্তর করা হয় আফগানিস্তান, পাকিস্তান অথবা ইরানে। স্থানীয় আফিম মার্কেটে কয়েকশ’ উৎপাদনকারী, বিক্রেতা ও ক্রেতা আফিমের দাম বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা করছেন। আবহাওয়া, অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সীমান্ত বন্ধের কারণে আফিমের দাম এত বেড়েছে বলে তাদের আলোচনায় উঠে এসেছে।
আফগানিস্তানের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে থাকলেও দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের আফিম মার্কেটের বিক্রেতারা বলছেন, তালিবান নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর তাদের পণ্যের দাম বেড়েছে।
আফগানিস্তানে উৎপাদনকৃত আফিম থেকে দেশটির ভেতরেই, পাকিস্তান কিংবা ইরানে হেরোইন তৈরি হয়। এরপর এই হেরোইন ইউরোপিয়ান বাজারসহ সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আফিম উৎপাদন ও বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা থাকায় চোরাচালানকারীরা গোপনে এটি পাচার করে থাকে।
মাসুম নামে একজন আফিম বিক্রেতা বলেন, ইসলামে আফিম উৎপাদন হারাম। কিন্তু নিরুপায় হয়ে আমরা এটা করছি।
আফগানিস্তানের এই কৃষক জানান, পাচারকারীরা প্রতি কেজি আফিমের জন্য এখন ১০০ ডলার দিচ্ছে। তবে এর প্রতিগ্রাম বাজারমূল্য ৫০ ডলার।
আফগানিস্তানের আফিম মার্কেটে গিয়ে এএফপির রিপোর্টার দেখতে পান, হকার ও বিক্রেতারা বসে আফিমের উচ্চমূল্য নিয়ে আলোচনা করছেন।
তাদের ভাষায়, আবহাওয়া, অনিরাপত্তা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সীমান্ত বন্ধ আফিমের দামে প্রভাব ফেলেছে। তবে তারা এটাও বলেন যে, তালিবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদের এক বিবৃতিতেই আফিমের দাম চড়ে গেছে।
গতমাসে জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, তারা চান না, কোনো মাদকদ্রব্য উৎপাদন হোক। তবে কৃষকদের অন্যখাতে সরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
তবে তালিবান পপি চাষে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে এই গুজব ছড়িয়ে পড়াও দাম বৃদ্ধির পেছনে দায়ী বলেও জানান তারা।
২০০০ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে তালিবান আফিম চাষ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আফিম চাষকে ‘অনৈসলামিক’ আখ্যা দিয়ে তৎকালীন তালিবান নেতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমর বলেন, কেউ পপি বীজ রোপণ করলে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও তহবিল পাওযার কৌশল হিসেবে তালিবান এ উদ্যোগ নিয়েছিল। এবারও তেমনি কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আফিম উৎপাদন হয় আফগানিস্তানে। জাতিসংঘের সবশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২০ সালে সারাবিশ্বে উৎপাদিত মোট আফিমের প্রায় ৮৫ শতাংশই আফগানিস্তানে উৎপাদিত হয়েছে। পপি গাছ তথা আফিম চাষ দীর্ঘদিন ধরে আফগান জনগোষ্ঠীর আয়ের একটি বড় উৎস।
২০০০ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে তালিবান আফিম চাষ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আফিম চাষকে ‘অনৈসলামিক’ আখ্যা দিয়ে তৎকালীন তালিবান নেতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমর বলেন, কেউ পপি বীজ রোপণ করলে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও তহবিল পাওযার কৌশল হিসেবে তালিবান এ উদ্যোগ নিয়েছিল। এবারও তেমনি কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন।
সিএনএন জানিয়েছে, সম্প্রতি ক্ষমতা দখলের পরপরই তালিবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ ‘বিশ্বকে পূর্ণ আশ্বাস’ দিয়েছেন যে, তালিবান শাসনের অধীনে আফগানিস্তান কোনো ‘মাদক-রাষ্ট্র’ হবে না। দেশটিতে মাদক চাষ বন্ধ করা হবে এবং আফিম চাষীদের জন্য বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু, তালিবান কীভাবে এটি করবে বা আদৌ করবে কি না তা অনিশ্চিত।
সিএনএনর প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতিসংঘের ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী আফগানিস্তানের জিডিপির ১১ শতাংশ আফিম থেকে আসে। তালিবানও এখান থেকে লভ্যাংশ পায়। কিন্তু কতটা পায়, তা স্পষ্ট নয়।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো ভান্ডা ফেলবাব-ব্রাউন সিএনএনকে বলেন, ‘স্পষ্টতই মাদক তালিবানদের অন্যতম একটি আয়ের উৎস।’
তিনি জানান, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো সাধারণত যেসব এলাকায় তাদের প্রভাব বেশি, সেসব এলাকা থেকে এ বাবদ অনানুষ্ঠানিক কর আদায় করে থাকে। তালিবানের আয়ের ব্যাপারটিও এভাবেই ঘটে। আফিম অর্থনীতি থেকে তাদের আয়ের পরিমাণ সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তবে, তা কয়েকশো মিলিয়ন পর্যন্ত হতে পারে।
জাতিসংঘের মতে, আফগানিস্তানে আফিমের উৎপাদন মাঝখানে এক বছর কম থাকার পর আবার বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর দেশটিতে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৩০০ টন।
২০২১ সালের জুনে জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বলা হয়, তালিবান শুধুমাত্র মাদক পাচার থেকেই বছরে ৪৬ কোটি ডলার আয় করে।
আফগানিস্তানে ১৫ বছর ধরে ৮০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ ব্যয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানের আফিম, হেরোইন ব্যবসা থেকে তালিবানের মুনাফা অর্জন বন্ধ করা। এই অভিযানে পপি চাষ নির্মূল থেকে শুরু করে সন্দেহভাজন ল্যাবে বিমান হামলাও চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। এখনো গোটা বিশ্বে আফিমজাত মাদকের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী তালিবানরাই। আফগানিস্তানে তাদের ক্ষমতা দখলের ধারাবাহিকতায় পৃথিবীজুড়েই মাদক সমস্যা আরো মারাত্মক আকার নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
আফগনিস্তান বিশ্বের সবচেয়ে বড় আফিম উৎপাদনকারী দেশ। হেরোইন তৈরিতে এই আফিম প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, যুক্তরাজ্যে যে পরিমাণ হেরোইন যায়, এর ৯৫ শতাংশই আফগানিস্তান থেকে যায়। ।
আফগানিস্তানে আফিমের চাষ অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। তারপরেও দরিদ্র কৃষকরা অর্থের জন্যে এই পপি চাষে উৎসাহিত হন।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, গত ২০ বছরে দেশটির আফিম উৎপাদন ব্যাপক বেড়েছে। দেশটির ৩৪টি প্রদেশের ১২টি ছাড়া সব কটিতে আফিম চাষ হয়। পপি চাষ বন্ধ করার জন্য চাষীদের নানা ধরনের বিকল্প পণ্য যেমন আনার ও জাফরান চাষের জন্য উৎসাহিত করার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু তার পরও এই অবস্থা।
কাবুলের পতনের পর গোটা আফগান অর্থনীতিতে চরম মাত্রায় ধস নেমেছে। আসন্ন দিনগুলোয় দেশটিতে মারাত্মক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা করছেন পর্যবেক্ষকরা। গৃহযুদ্ধের কারণে এরই মধ্যে দেশটিতে বাস্তুচ্যুত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। অদূরভবিষ্যতে এ সংখ্যা আরো বাড়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে পড়া এ আফগান নাগরিকদের দুরবস্থার সুযোগ নিতে পারে তালিবানরা। তাদের নিয়োজিত করা হতে পারে মাদক উৎপাদন ও বাণিজ্যের সঙ্গে।
এছাড়া আফগানিস্তানের অর্থনীতিতে বৈদেশিক অনুদাননির্ভরতা অনেক বেশি। তালিবানদের কাবুল দখলের ধারাবাহিকতায় এ অনুদানের বড় একটি অংশ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে তালিবানরা আয়ের জন্য নিশ্চিতভাবেই মাদক বাণিজ্যের ওপর আরো নির্ভরশীল হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আফগানিস্তান এমনিতে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বড় আফিম রপ্তানিকারক দেশ। আফিম থেকে হেরোইনের মতো মাদক তৈরি করা হয়। তবে তারা যে কেবল আফিমই উৎপাদন করে তা নয়, এবার আরেক ভয়ঙ্কর মাদক মেথাম্ফেটামিনের উৎপাদনও বাড়ছে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটিতে। আফগানিস্তানের কিছু অংশে মেথাম্ফেটামিনের উৎপাদন এরই মধ্যে আফিমকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, অবৈধ মাদক ব্যবসা বাড়তে থাকলেও সেদিকে নজর দেয়া হয়নি। এখন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্বেগ বাড়তে শুরু করেছে। তাদের আশঙ্কা, আফগানদের মেথাম্ফেটামিনের সারা ইউরোপে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৩
আপনার মতামত জানানঃ