রাজ্য জয়ের স্বপ্ন দেখেছিল দলটি, কিন্তু ২০০ আসন জেতা তো দূর, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে কার্যত পর্যুদস্ত হয়েছে বিজেপি। আর তারপর থেকেই বিজেপি ছাড়ার হিড়িক পড়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যেই ৫ মাসে ৫ বিধায়ক দল ছেড়েছেন। বিধানসভা ভোটের পর থেকে মুকুল রায়সহ চার বিজেপি বিধায়ক ইতিমধ্যেই নাম লিখিয়েছেন শাসক দল তৃণমূলে। একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল ছেড়ে যেভাবে বিজেপিতে যোগদান বেড়েছিল, এখন দেখা যাচ্ছে তারই উল্টোচিত্র। এখন বিজেপি ছেড়ে বাড়ছে তৃণমূলে ফেরার স্রোত। তবে এবার অভিনবভাবে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূল ফিরছেন বিজেপি নেতারা। মাথা ন্যাড়া করে, গঙ্গায় গোসল করে পবিত্র হয়ে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন।
ত্রিপুরার বিজেপি বিধায়ক আশিস দাস আগেই তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে এর আগে কলকাতার কালীঘাটে গিয়ে মাথা ন্যাড়া করে, গঙ্গায় গোসল সেরে বিজেপি করার প্রায়শ্চিত্ত করেছেন তিনি। গত মঙ্গলবার কলকাতার কালীঘাটে আদি গঙ্গার পাড়ে তিনি নিজের মাথা মুড়িয়ে নেন। বিধায়কের মাথা মুড়ানোর ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ত্রিপুরার বিধায়ক আশিস দাস কলকাতার কালীঘাটে এসে আদি গঙ্গার পাড়ে বসে মাথা মুড়িয়ে বিজেপি ত্যাগ করেছেন। আশিস বলেছেন, বিজেপিতে যোগ দেওয়া আমার অপরাধ হয়েছিল। আমি তার প্রায়শ্চিত্ত করছি। ত্রিপুরায় বিজেপি ক্ষমতা না ছাড়া পর্যন্ত মাথায় আর চুল রাখবো না।
আশিস বলেছেন, ত্রিপুরায় বহু অপকর্ম করছে রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি সরকার। ত্রিপুরায় বিজেপি রাজনৈতিক নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা উসকে দিচ্ছে। বিজেপি সরকারের কর্মকাণ্ডে রাজ্যবাসী অসন্তুষ্ট। এসব কারণে তিনি বিজেপি ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
অতীতে আশিসকে ত্রিপুরার বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের কড়া সমালোচনা করতেও দেখা গেছে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা করতে দেখা গেছে তাকে।
গতকাল আশিস ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করতে তার মাথা ন্যাড়া করেন। তিনি বলেন, ‘রাজ্যে বিজেপি সরকারের অপশাসনের জেরে প্রায়শ্চিত্ত করতে আমি আমার মাথা ন্যাড়া করেছি। আমি বিজেপি থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে।’
আশিস বলেন, ‘বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীন যে বিশৃঙ্খলা ও অপশাসন ত্রিপুরার মানুষ দেখেছে, তা আমাকে নাড়া দিয়েছে। ফলে আমি দুই বছর ধরে এ অপকর্মের সমালোচনা করেছি। দল ও রাজনীতির বাইরে গিয়ে মানুষের জন্য কাজ করে আসছি।’
গতকাল শুধু মাথা ন্যাড়া করেই ক্ষান্ত হননি আশিস। তাকে গতকাল কলকাতার কালীঘাট মন্দিরে ধর্মীর আচার পালন করতেও দেখা যায়। কালীঘাট মন্দির থেকে মমতার বাড়ির দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়।
সম্প্রতি আশিস পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশংসায় ভাসান। দিন কয়েক আগেই কলকাতার ভবানীপুর বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে বিজেপির প্রার্থীকে বড় ব্যবধানে হারিয়ে দেন মমতা। মমতার জয়ে আশিসকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মমতাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান দেশের অনেক মানুষ।
গতকাল কলকাতায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় আশিস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা করেন।
‘রাজ্যে বিজেপি সরকারের অপশাসনের জেরে প্রায়শ্চিত্ত করতে আমি আমার মাথা ন্যাড়া করেছি। আমি বিজেপি থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
বিজেপি বিধায়কের এই গল্পে অবশ্য চূড়ান্ত অস্বস্তিতে ত্রিপুরার বিজেপি শিবির।
তবে তাদের নেতা সুব্রত চক্রবর্তী বলছেন, আশিস দাস আসলে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অপমান করলেন তার ভোটারদের। যাদের দয়ায় তিনি নির্বাচিত হয়ে এসেছেন।
ত্রিপুরার সুরমার বিধায়ক আশিস দাস দল ছাড়ার কথা ঘোষণা করলেও এখনই বিধায়ক পদ থেকে পদত্যাগ করেননি। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিকে বিজেপি জানিয়েছে, আশিস দাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেন, ত্রিপুরাসহ আরও কিছু রাজ্যের বিজেপি নেতারা প্রায়শ্চিত্ত করতে চান। বিজেপি ত্যাগ করতে চান। আশিস দাস অনুভব করেছেন, মানুষ কী চাইছেন আর কী চাইছেন না। তার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি।
এর আগেও প্রায় ২০০ জন কর্মী সমর্থক মাথা ন্যারা করে বিজেপি থেকে তৃণমূলে যোগ দেন।। বিজেপির কর্মী হওয়াকে ভুল কাজ বলে স্বীকার করে মাথা ন্যাড়া করে যোগ দিয়েছেন তারা।
তৃণমূল কংগ্রেসের যোগ দেওয়া বিজেপি কর্মীদের বরাত দিয়ে জিনিউজ জানায়, বিজেপিতে গিয়ে তারা ভুল করেছিলেন। সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতেই মাথা ন্যাড়া হলেন। এখন থেকে তারা তৃণমূলের আদর্শ মেনেই কাজ করবেন।
খবরে বলা হয়, বিজেপির কর্মী হওয়াকে ভুল কাজ বলে স্বীকার করে মাথা ন্যাড়া করে যোগ দিয়ে ব্যাপক আলোচনায় এসেছেন খানাকুলের বলপাই বিজেপি নেতা বিভাস মালিকের নেতৃত্বে একঝাঁক বিজেপি নেতাকর্মী। তারা মমতার নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন। অধিকাংশ নেতাকর্মীই মাথা ন্যাড়া হয়ে তৃণমূলের পতাকা হাতে তুলে নেন।
সাধারণত কোন নির্বাচনের আগেই নামি-দামী ব্যক্তিদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোতে যোগ দিতে দেখা যায়, কিংবা এক দল ছেড়ে আরেক দলে যোগ দেওয়ার প্রবণতা চোখে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক প্রতিটি নির্বাচনেও এ চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে গত মার্চ-এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত বিধানসভার নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রায় প্রতিদিনই পালা করে রাজ্যটির ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়ক-কাউন্সিলর-পঞ্চায়েত প্রধান থেকে শুরু করে দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থকরাও দলে দলে বিজেপিতে যোগ দিতে দেখা গেছে। দলবদলের হিড়িক দেখে অনেকেই মুচকি হেসে কটাক্ষ করেছিলেন যে তৃণমূল দল আদৌ থাকবে কি না!
গত ২ মে ভোটের ফল বের হয়, তাতে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তৃতীয়বারের মতো রাজ্যে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। এরপর সরকারও গড়ে তারা। কিন্তু ভোটপর্ব মিটলেও ফের দলবদলের হিড়িক! তবে এবার ছবিটা উল্টো! বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগদানের হিড়িক পড়েছে কলকাতা থেকে জেলায় জেলায়।
রাজ্যে ক্ষমতায় আসা হয়নি, এরই মধ্যে একের পর এক ধাক্কা বিজেপিতে। আগেই দল ছেড়েছেন মুকুল রায়সহ চার বিধায়ক। তারা ছাড়াও রীতিমতো চমকে দিয়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন বাবুল সুপ্রিয়। শুক্রবার ফের ধাক্কা লাগে বিজেপি-তে৷ এবার দল ছাড়লেন রায়গঞ্জের বিধায়ক কৃষ্ণ কল্যাণী৷ তিনি এখনও তৃণমূলে যোগ না দিলেও রায়গঞ্জের সাংসদ দেবশ্রী চোধুরীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে বিজেপি ছাড়ার কথা ঘোষণা করেছেন রায়গঞ্জের বিধায়ক। এই পরিস্থিতিতে দলে ফের ভাঙন অব্যাহত থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বিজেপির নতুন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। কৃষ্ণ কল্যাণীর দল ছাড়া ও দেবশ্রী চৌধুরীর সঙ্গে তার সংঘাতের প্রসঙ্গেও সেই চিন্তার কথাই বলেছেন রাজ্য বিজেপির নতুন সেনাপতি।
এদিকে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, খেলা তো সবে শুরু হল৷ আগামীতে আরও অনেক বড় চমক অপেক্ষা করছে।’ বিজেপিতে যেভাবে ভাঙন বাড়ছে, তাতে চমক নিয়ে বেজায় জল্পনা পশ্চিমবঙ্গ রাজনীতিতে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫৭
আপনার মতামত জানানঃ