তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ হবে পানি নিয়ে উক্তিটি পোপ ফ্রান্সিসের। আর জাতিসংঘের প্রকাশিত প্রতিবেদনও এরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। পৃথিবীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ক্রমাগত বাড়ছে সুপেয় পানির চাহিদা। কিন্তু সেই সঙ্গে আনুপাতিক হারে বাড়ছে না পানি।
গতকাল মঙ্গলবার জাতিসংঘের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৫০০ কোটির বেশি মানুষ পানির সংকটে ভুগতে পারে। চলতি মাসের শেষে শুরু হতে যাওয়া জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষক সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি।
এ নিয়ে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে পানি সম্পর্কিত দুর্যোগ যেমন খরা, বন্যার ঝুঁকি বাড়ছে। সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত এই দুর্যোগে ভুক্তভোগী মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে।
জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) সম্প্রতি নতুন এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০১৮ সালে কমপক্ষে এক মাস অপর্যাপ্ত পানি পায় ৩.৬ বিলিয়ন মানুষ।
দ্য স্টেট অব ক্লাইমেট সার্ভিসেস ২০২১: ওয়াটার শীর্ষক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০১৮ সাল থেকে কমপক্ষে এক মাস বিশ্বের ৩৬০ কোটি মানুষ পর্যাপ্ত পানি পায়নি। ২০৫০ সালের মধ্যে ৫০০ কোটির বেশি মানুষ এই সংকটে পড়বে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার প্রধান প্রফেসর পেটারি তালাস বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বৃষ্টিপাতের মাত্রার পরিবর্তন হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে চাষাবাদে। এতে খাদ্য নিরাপত্তা এবং মানুষের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার ওপর বড় প্রভাব ফেলে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২০ বছর পৃথিবীর উপরিস্থ পানির পরিমাণ প্রতি বছরে ১ সেন্টিমিটার কমছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে পানি সম্পর্কিত দুর্যোগ যেমন খরা, বন্যার ঝুঁকি বাড়ছে। সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত এই দুর্যোগে ভুক্তভোগী মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। তবে বিশ্বের নিম্ন অক্ষাংশে থাকা জনবহুল এলাকায়ও উল্লেখযোগ্যভাবে পানির পরিমাণ কমছে, যা ঐতিহ্যগতভাবে পানি সরবরাহ করত।
বিশ্বে মোট পানির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পানি ব্যবহারযোগ্য।
গত ২০ বছরেও বিশ্বে পানির সংকট বেড়েছে। ২০০০ সাল থেকে বন্যাসংশ্লিষ্ট দুর্যোগ বিশ্বে আগের থেকে ১৩৪ শতাংশ বেড়েছে। আর এর বেশির ভাগই হয়েছে এশিয়ায়।
এই সময়ে খরার পরিমাণও ২৯ শতাংশ বেড়েছে। আর খরার কারণে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয় আফ্রিকার দেশগুলোকে।
ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ৯৪০ থেকে ১০২০ কোটিতে গিয়ে পৌঁছাবে। এই সময়ে প্রতি তিনজনে দুজন শহরে বাস করবে। সেই সুবাদে বিশুদ্ধ পানির চাহিদা বহুগুন বেড়ে যাবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পানির চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। এর মধ্যে আবার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জলজ অঞ্চলগুলো আরো প্লাবিত হবে এবং শুষ্ক অঞ্চলগুলো আরো শুষ্ক হবে। তাই পানির এই চাহিদা আরো বাড়বে।
এক পরিসংখ্যান বলছে, সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে বিশ্বে প্রতিদিন পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রায় ১ হাজার ৪০০ শিশুর মৃত্যু ঘটছে। অন্য পরিসংখ্যান বলছে, এ সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার হবে। তার মানে শিশুরা পানি সংকটের সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী।
সুপেয় পানি প্রাপ্তির সুযোগ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘ পানি অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। নিরাপদ পানির অধিকারবঞ্চিত বিপুল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই আবার চরম দরিদ্র। প্রান্তিক এ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ বাস করে গ্রামে। সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে নারী ও শিশুরা। এশিয়া ও আফ্রিকার সংকট ভয়াবহ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪৭
আপনার মতামত জানানঃ