পরপর দুই দিনে ঢাকার তিনটি বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ঢাকার গণমাধ্যমগুলো ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছে। ‘দুই দিনে পুড়ল তিন বস্তি, আগুনে ষড়যন্ত্রের গন্ধ’ এভাবেই এ সংক্রান্ত খবরের শিরোনাম করেছে জাতীয় পত্রিকা দৈনিক সমকাল। ‘এক মাসে ৫ বস্তিতে আগুন, হতভাগা বস্তিবাসীর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা, নিছক দুর্ঘটনা, নাকি উদ্দেশ্যমূলক তা পর্যবেক্ষণ করা উচিত -নগর পরিকল্পনাবিদ’ এমন শিরোনাম করেছে দৈনিক যুগান্তর। ‘মাসোহারা ভোগীদের দায় নিতে হবে’ লিখেছে দৈনিক প্রথম আলো। ‘আগুনে ছোট হয় বস্তি পাল্টে যায় দখল’ এমন শিরোনাম করেছে দৈনিক কালের কন্ঠ। ‘তিন বস্তিতে আগুন উদ্দেশ্যমূলক না দুর্ঘটনা?’ এমন শিরোনাম করেছ জাগো নিউজ ২৪ ডট কম।
আগুন পিছু ছাড়ছে না বস্তিবাসীর। গত ১ মাসে রাজধানীতে ছোট-বড় ৫টি বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন হাজারও মানুষ। তারা বলছেন, সব হারিয়ে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই আবারও সব পুড়ে ছারখার করে দেয় আগুন। ক্ষুধার আগুন নেভাতে গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে বস্তিতে বারবার সর্বগ্রাসী আগুনে পুড়ে নিঃস্ব হতে হচ্ছে। কিন্তু কেন বারবার আগুন লাগে, সেই প্রশ্নের উত্তর মেলে না। জনমনে ধারণা, প্রভাবশালীরা আগুন লাগিয়ে বস্তি খালি করে সেই জায়গা দখল করেন। প্রতিবার আগুন লাগার পর বস্তির আকার ছোট হয়, এমন খবরও এসেছে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে ৩১ বার আগুন লাগে।
চলতি সপ্তাহে ঢাকার তিনটি বস্তিতে আগুনের ঘটনায় জনমনে প্রবল সন্দেহ দানা বেধেছে। সংবাদমাধ্যমগুলো এ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রথম আলো ‘মাসোহারা ভোগীদের দায় নিতে হবে, ঝিলপাড় বস্তিতে আগুন’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘রূপনগরে পুড়ে যাওয়া ঝিলপাড় বস্তিটিতে আগুন লাগার প্রাথমিক কারণ সেখানে কোনো শৃঙ্খলা না থাকা। সেখানে আইনের শাসন ছিল না। প্রচলিত ব্যবস্থার আওতায় বস্তিবাসীদের পক্ষে বৈধভাবে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সরবরাহ পাওয়ার দরজা বন্ধ ছিল। ঐতিহ্যগতভাবে বস্তির অস্তিত্ব কোনো না কোনো মাত্রায় ‘অবৈধ’ হতে পারে। সে কারণেই বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনের নীতিমালা অনুসরণে উচ্চ আদালত সব সময় গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু কখনো তাতে সরকারের টনক নড়েনি। ঝিলপাড়ের বস্তি ‘অবৈধ’, তাই সরকার কখনো ভাবেনি তাদের নিরাপত্তা ও বৈধভাবে ইউটিলিটি সার্ভিস দেওয়ার ব্যাপারে। ঝিলপাড় বস্তিটি কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপরে নয়, গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের জমিতে গড়ে উঠেছিল। সুতরাং সরকারি জমির ওপরে গড়ে ওঠা বস্তি থেকে যারা প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের মাসোহারা নিয়েছেন, তাঁরা আগুন লাগার কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির দায় এড়াতে পারেন না। কারা কত টাকা নিয়েছিলেন, তার একটা জবাবদিহি দরকার। স্থানীয় সাংসদ দাবি করেছেন, বস্তির বিদ্যুৎ–সংযোগ বৈধ ছিল। কিন্তু গ্যাস ও পানি বৈধ ছিল কি না, তা তিনি জানতেন না। এই স্বীকারোক্তিতে স্পষ্ট যে বস্তির নাগরিকদের জীবনের প্রতি তিনি পূর্ণ দায় অনুভব করেননি। গৃহায়ণ অধিদপ্তর ১৯৭৩ সালে জমি কিনে কেন ফেলে রেখেছে, তার কোনো সদুত্তর মেলেনি’।
সমকাল ‘দুই দিনে পুড়ল তিন বস্তি, আগুনে ষড়যন্ত্রের গন্ধ’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘এভাবে বস্তিতে একের পর এক আগুনের ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে, এসব কী নিছক দুর্ঘটনা, নাকি কোনো নাশকতা? কেউ কেউ বলছেন, এসবের জন্য বিদ্যুৎ-গ্যাস সরবরাহ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাই দায়ী। কারণ তিন ক্ষেত্রেই বস্তিতে অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ পাওয়া গেছে। অনিরাপদ বৈদ্যুতিক সংযোগ বা গ্যাসের চুলা থেকেই বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বস্তির নিয়ন্ত্রণ নিতে ষড়যন্ত্র করে আগুন লাগানো হয়ে থাকতে পারে। কারণ সেখানে অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ থেকে কোটি কোটি টাকা আয় হয়। আর সেই টাকা স্থানীয় রাজনৈতিক অসাধু নেতাকর্মীদের পকেটে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। অতীতে একাধিক ঘটনায় দেখা গেছে, আগুন লাগার পর বস্তির জায়গাটি অন্য নতুন পক্ষ দখলে নিয়েছে। তাই আগুন লাগার ঘটনা অনেক সময় বস্তি উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা’।
[soliloquy id=”2156″]
যুগান্তর ‘এক মাসে ৫ বস্তিতে আগুন, হতভাগা বস্তিবাসীর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা, নিছক দুর্ঘটনা, নাকি উদ্দেশ্যমূলক তা পর্যবেক্ষণ করা উচিত -নগর পরিকল্পনাবিদ’ শিরোনামে লিখেছে, ‘বস্তির এসব অগ্নিকাণ্ড নিছক দুর্ঘটনা, নাকি উদ্দেশ্যমূলক তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। সাধারণত বস্তিগুলো সরকার বা ব্যক্তি মালিকানাধীন পরিত্যক্ত জমিতে গড়ে ওঠে। অনেক সময় ভূমি মালিক জমি খালি করার জন্য বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেন। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। তাই সিটি কর্পোরেশন, থানা-পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের তদন্ত করে অগ্নিকাণ্ডের কারণ বের করতে হবে। পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের সহায়তায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, অর্থাৎ সিটি কর্পোরেশনকে এগিয়ে আসতে হবে। নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, এখনই সরকারের উচিত সিটি কর্পোরেশনকে দায়িত্ব দেয়া। পাশাপাশি সব সেবার বৈধ সংযোগ ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন তিনি’।
কালের কন্ঠ ‘আগুনে ছোট হয় বস্তি পাল্টে যায় দখল’ এই শিরোনামে লিখেছে, ‘অগ্নিকাণ্ডের পর দেখা যায়, ঘর কমে বড় বস্তিগুলোর আকার ছোট হয়ে আসে। এরপর চালানো হয় উচ্ছেদ কার্যক্রমও। বস্তিবাসীর অভিযোগ, স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখল, বিরোধ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন কারণে কৌশলে বস্তিতে আগুন লাগানো হয়। আবার সরকারি কর্তৃপক্ষের উচ্ছেদ অভিযানও চলে। আগুনে হতদরিদ্র মানুষের জীবনে মহাদুর্যোগ নেমে আসে। ঘটে প্রাণহানিও। ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগানোর অভিযোগ বারবার উঠলেও তদন্তে প্রমাণ মেলে না’।
জাগো নিউজ ‘তিন বস্তিতে আগুন উদ্দেশ্যমূলক না দুর্ঘটনা?’ এমন শিরোনামে লিখেছে, ‘এসব অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি এবং উচ্ছেদের কৌশল। প্রতি বছরই এসব অপতৎপরতার বলি হচ্ছেন তারা। কিন্তু তাদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসছে না সরকার’।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, দেশে গত বছর অন্তত ১৪৪টি বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতেই ২৫টি বস্তিতে আগুন লেগেছে। এসব আগুনে ক্ষতির পরিমাণ শত কোটি টাকার বেশি। এ বছরের পরিসংখ্যান এখনও প্রস্তুত হয়নি।
শুধু রাজধানীতে কমবেশি ৩০ লাখ লোক বিভিন্ন বস্তিতে বাস করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পোশাকশ্রমিক। বস্তিতে যাঁদের ঘর পুড়েছে, তাঁদের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই অনেক পোশাককর্মী রয়েছেন। পোশাকশিল্প বা বিচিত্র যে পেশাতেই তাঁরা জড়িত থাকুক না কেন, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে তাঁরা ভূমিকা রেখে চলেছেন। নগরীর অর্থনৈতিক জীবনে বস্তিবাসীর ভূমিকা অপরিহার্য। অথচ তাঁরা নানা সময় উচ্ছেদ এবং চাপের মুখে থাকেন। বস্তিবাসীদের পর্যায়ক্রমে কী করে আবাসনসংকট নিরসন করা যায়, সেটা নীতিনির্ধারকদের কখনো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে দেখা যায়নি।
মিই/আরা/১৪২০
আপনার মতামত জানানঃ