করোনাকালে দেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে বাল্যবিয়ে। সবচেয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থানে রয়েছে খুলনার বাগেরগাট জেলা। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেড় বছরে বাগেরহাটে তিন হাজার ১৭৮ জন শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এত কম সময়ে বিপুল সংখ্যক বাল্যবিয়ের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও অভিভাবকদের অসচেতনতাকে দায়ী করেছেন সচেতন মহল।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, করোনার সংক্রমণ শুরুর পর ২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে চলতি বছরের ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেলার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ৫২২ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তিন হাজার ১৭৮ শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে কচুয়া উপজেলায় সর্বোচ্চ ৫১৬ স্কুলছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। পাশাপাশি সদরে ৪৯৭, চিতলমারীতে ৪০৭, ফকিরহাটে ৩৯১, মোল্লাহাটে ৩৪৪, মোরেলগঞ্জে ৩৫৫, রামপালে ২৩৭, মোংলায় ২১৮ এবং শরণখোলায় ২১৩ বাল্যবিয়ে হয়েছে।
এর বাইরে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বাল্যবিয়ে হয়েছে। ঝরে পড়া, বিদ্যালয়ে না আসা হতদরিদ্র পরিবারের অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রীদের বিয়ে হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে কি পরিমাণ বাল্যবিয়ে হয়েছে তার সঠিক তথ্য নেই কোনও দপ্তরে।
জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে জেলায় পাঁচ হাজার ৭৩৯ বিয়ে হয়েছে। এই সময়ে দুই হাজার ৭৯৯ তালাক হয়েছে। রেজিস্ট্রারদের মাধ্যমে হওয়া সব বিয়েতে সরকারি বয়সসীমা মানা হয়েছে বলে দাবি করেছেন জেলা রেজিস্ট্রার।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, জেলার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজিরা খাতাসহ শিক্ষকরা বিভিন্নভাবে করোনাকালীন সময়ে বাল্যবিয়ের তথ্য সংগ্রহ করেছেন। শিক্ষকদের তথ্য অনুযায়ী, ৫২২ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তিন হাজার ১৭৮ শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। ভবিষ্যতে বাল্যবিয়ে থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে আমরা নানা উদ্যোগ নিয়েছি।
জেলা রেজিস্ট্রার মনিরুল হাসান বলেন, যারা রেজিস্ট্রার কাজি; তারা বিয়ে পড়ানোর আগে বয়স প্রমাণের বৈধ কাগজপত্র দেখে বিয়ে পড়ান। রেজিস্ট্রার কাজিদের বাল্যবিয়ে পড়ানোর সুযোগ নেই। এরপরও যদি কোনও কাজি অনৈতিক সুবিধা নিয়ে বাল্যবিয়ে নিবন্ধন করেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রথম শ্রেণির একজন সরকারি কর্মকর্তা বলেন, বাল্যবিয়ে বন্ধের জন্য মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ও স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন কাজ করে। এর সঙ্গে স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, নারী সংগঠন, জেলা মহিলা সংস্থা, মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন রয়েছে। একটি জেলায় এতগুলো বাল্যবিয়ে হলো, তারা কি করেছেন— এই প্রশ্ন তুলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন এই কর্মকর্তা।
বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, বাল্যবিয়ের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা ইতোমধ্যে সকল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছি। তারা যেখানেই বাল্যবিয়ের খবর পাবেন— তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে গিয়ে বিয়ে বন্ধ করবেন। এছাড়া নিকাহ রেজিস্ট্রার ও স্থানীয় ইমামদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। যদি কোনো নিকাহ রেজিস্ট্রার বাল্যবিয়ের সঙ্গে জড়িত থাকেন তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একটি পরিসংখ্যান বলছে, করোনার কারণে ২০২০ সালে কমপক্ষে পাঁচ লাখ অপরিণত বয়সের মেয়েকে বিয়ে দেয়া হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হতে পারে আরো অতিরিক্ত ২৫ লাখ মেয়ে। গত ২৫ বছরের মধ্যে এবারই বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি।
করোনার কারণে ২০২০ সালে কমপক্ষে পাঁচ লাখ অপরিণত বয়সের মেয়েকে বিয়ে দেয়া হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হতে পারে আরো অতিরিক্ত ২৫ লাখ মেয়ে। গত ২৫ বছরের মধ্যে এবারই বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি।
জাতীয় সংসদের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি তথ্য চাইলে মন্ত্রণালয় করোনাকালে কিছু জেলায় বাল্যবিয়ে বেড়ে যায় জানিয়ে চার মাসের তথ্য উপস্থাপন করেছে। সংসদীয় কমিটির বৈঠকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব করোনাকালে বাল্যবিয়ের তথ্য তুলে ধরে বলেছেন, নরসিংদী, নাটোর, কুড়িগ্রাম, যশোর, কুষ্টিয়া ও ঝালকাঠি জেলায় বাল্যবিয়ের হার কিছুটা বেড়েছে। মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৪ জেলায় ২০২০ সালের মার্চ থেকে জুন এই চার মাসে ২৩১টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। অর্থাৎ মাসে গড়ে ৫৮টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। মন্ত্রণালয় করোনার আগের মাস হিসাবে শুধু ফেব্রুয়ারির তথ্য তুলে ধরেছে। ফেব্রুয়ারিতে বাল্যবিয়ে হয়েছিল ছয়টি।
ইউনিসেফ, ইউএনএফপি ও প্লান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সহায়তায় ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সাত মাসে দেশের মোট ৬৪টি জেলার মধ্যে ২১টি জেলার ৮৪টি উপজেলায় বাল্যবিয়ের মাত্রা নিয়ে পরিচালিত জরিপের ফল সংস্থাটি প্রকাশ করে। যাতে দেখা যায়— ওই সময়ে এ জেলাগুলোতে অন্তত ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। জরিপে বলা হয়, যে সব শিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে তাদের ৫০ দশমিক ৬ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ১৭ বছর, ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছর এবং ১ দশমিক ৭ শতাংশের বয়স ১০ থেকে ১২ বছর। করোনাকালে মানুষের আয় হ্রাস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা ও নিরাপত্তাহীনতাকে বাল্যবিয়ের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
ব্র্যাকের গবেষণায় বলা হয়েছে, ৮৫ শতাংশ বাল্যবিয়ে হয়েছে মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে। ৭১ শতাংশ হয়েছে মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য। বাইরে থেকে আসা ছেলে হাতের কাছে পাওয়া ৬২ শতাংশ বিয়ের কারণ ছিল। করোনা ঠেকাতে ব্যস্ত প্রশাসনের বিয়ে ঠেকানোর কড়াকড়িতে যে শৈথিল্য আছে, তা ব্র্যাকের গবেষণায় স্পষ্ট। জোর করে বিয়ে দেয়ার ঘটনা আগের চেয়ে বেড়েছে। আর আমাদের সহযোগী সংগঠনগুলো জানিয়েছে, প্রত্যন্ত এলাকায় বাল্যবিয়ে বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন, বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে ২১টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। অথচ বাংলাদেশসহ বিশ্ব নেতারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অধীনে ২০৩০ সালের মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতা, বাল্যবিয়ে নির্মূলের অঙ্গীকার করেছিলেন।
জাতিসঙ্ঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, বাল্যবিয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থতম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে মেয়েদের ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ৬৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের বিয়ে হচ্ছে ১৫ বছরের আগেই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ ছেলেদের সমান বা কিছু বেশি হলেও উচ্চশিক্ষা এবং চাকরিতে অনেক পিছিয়ে মেয়েরা। বর্তমানে সরকারি চাকুরেদের মধ্যে নারী মাত্র ২৭ শতাংশ।
আর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ। মেয়েদের এই পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ বাল্যবিয়ে। শিশু মেয়ে হয় শিশু মা। ফলে বাড়ে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার। বাল্যবিয়ে বন্ধে এখনই উদ্যোগ না নিলে চ্যালেঞ্জ হবে এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে। বিশ্বজুড়ে ১৮ বছরের বেশি বয়সে বিবাহিত মেয়েদের তুলনায় ৫০ শতাংশের বেশি শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ১৫ বছরের কম বয়সী বিবাহিতা মেয়েরা।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দারিদ্র্য দেশে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। করোনা মহামারি দরিদ্রের সংখ্যা আরও বাড়িয়েছে। অভাবের কারণে দরিদ্র পরিবারের অভিভাবক অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে সংসারের খরচ কমাতে চান। বিয়ের পর মেয়েটির স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়।
তারা বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সব সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করা, প্রতি মাসে উপবৃত্তি প্রদান নিশ্চিত করা এবং দুপুরের খাবার নিয়মিত দেওয়া হলে দরিদ্র অভিভাবকরা মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী হবেন। তারা তখন আর মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইবেন না। এতে বাল্যবিয়ে কমবে, নারী শিক্ষার হারও বাড়বে।
আরও বলেন, বাল্যবিয়ে স্থায়ীভাবে প্রতিরোধ করতে প্রথমেই প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। বাল্যবিয়ের কুফল সব অভিভাবককে বুঝতে হবে, অথবা তাদের বোঝাতে হবে। ছেলেমেয়েদেরও বোঝাতে হবে যে, অল্প বয়সে বিয়ে করা ভালো নয়। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সর্বত্র প্রচার-প্রপাগান্ডা চালিয়ে যেতে হবে। যেসব কারণে বাল্যবিয়ে হয়, তা দূর করার জন্য অভিভাবক, সমাজ ও সরকারকে সমন্বিতভাবে কাজ করে যেতে হবে। একইসঙ্গে জেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ের বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটিগুলোকে কার্যকরভাবে সক্রিয় রাখা প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০১
আপনার মতামত জানানঃ