ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিক স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করার ইতিহাস বহু পুরনো। শতাব্দী আগে ভুক্তভোগী ছিল ইহুদি ও ক্যাথলিকরা। বর্তমানে লক্ষ্যবস্তু মুসলমানরা। দুই দশক ধরে মিডিয়া আমেরিকানদের মধ্যে মুসলমানদের সন্ত্রাসী হিসেবে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেছে। তবে আমেরিকায় ইসলামফোবিয়ার এই বাড়বাড়ন্ত চেহারার পেক্ষাপট তৈরি হয়েছে নাইন ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার উপর দাঁড়িয়েই। একটি ধর্মকে ঢাল বানিয়ে আর অপব্যাখ্যা দিয়ে প্রাণের পর প্রাণ কেড়ে নিয়ে সন্ত্রাসীরা সাধারণ মুসলিমদের ‘মুসলিম’ পরিচয়কে অমুসলিমদের কাছে একটি ভয়ংকর ভয়ের বস্তু হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
ইসলামফোবিয়া শব্দটার সূত্রপাত ‘৭০ এর দশকেই হয়, কিন্তু জনপ্রিয় হতে থাকে ‘৯০ এর দিকে এসে। ১৯৮৯ সালে সালমান রুশদি’র ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ বইতে হযরত মুহাম্মাদ (সা)-কে অপমান করা হয়, যার ফলশ্রুতিতে ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি রুশদির মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে ফতোয়া দেন। বিশ্ব তখন প্রথমবারের মতো দেখলো কীভাবে কোনো ফৌজদারি অপরাধ কিংবা খুনখারাবি না করেও কেউ মৃত্যুহুমকি পেতে পারে এবং সে হুমকি আসে ধর্ম থেকেই।
১৯৮৯ সালের ঘটনার পর থেকে মানুষ ইসলাম ধর্মকে ভয় পেতে থাকে। এ ধর্মকে বর্বর আর মৃত্যু-আনয়নকারী হিসেবে জানতে থাকে। ‘ইসলামোফোবিয়া’ শব্দের অর্থই তাই, ইসলামে প্রতি ভীতি, ইসলাম নামের আদর্শকে ভয় পাওয়া, ইসলাম ধর্ম পালনকারীদের কাছ থেকে ক্ষতির আশংকা করা।
আর তাই হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে লাখ লাখ মুসলমান চিকিৎসক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, আইনজীবী এবং অন্যান্য পেশাজীবী কীভাবে দেশটির সামগ্রিক উন্নয়নের ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন, তা নিয়ে এসব সংবাদমাধ্যমে খুব কমই খবর হয়েছে। ২০১৮ সালে ইউনিভার্সিটি অব আলাবামা পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে সেখানে যে পরিমাণ খবর প্রচার করা হয়েছে, কোনো সন্ত্রাসী ঘটনায় মুসলমানরা জড়িত থাকলে সে তুলনায় ৩৫৭ গুণ বেশি খবর প্রচার করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে, তাদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নজরদারি আরোপ করে এবং তাদের দেশ থেকে বের করে দিয়ে রাজনীতিকেরা মিডিয়াকে মুসলমানদের খল চরিত্র হিসেবে চিত্রায়িত করার বৈধতা দিয়েছেন।
তৎকালীন বুশ প্রশাসনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এন্ট্রি-এক্সিট সিস্টেম (এনএসইইআরএস) শীর্ষক বিশেষ নিবন্ধন প্রক্রিয়া অথবা ওবামা প্রশাসনের কাউন্টারিং ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজম শীর্ষক প্রকল্পের মধ্য দিয়ে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক উভয় শিবির থেকে আমেরিকানদের জন্য যে অভিন্ন বার্তা দেওয়া হয়েছে, তা হলো মুসলমানরা আমেরিকার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
এরপর ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসনভীতি ও ইসলামভীতিকে প্ল্যাটফর্ম বানিয়ে তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করলেন। ২০১৬ সালের মার্চে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আমি মনে করি, ইসলাম আমাদের ঘৃণা করে। আমাদের প্রতি তাদের ভয়ানক ঘৃণা আছে। এ কারণে যারা যুক্তরাষ্ট্রের মানুষকে এবং অমুসলিমদের ঘৃণা করে তাদের বিষয়ে আমাদের খুব সতর্ক হতে হবে এবং তাদের আমরা আমাদের দেশে ঢুকতে দিতে পারি না।’ ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে ঢুকেই তিনি তার নির্বাচনী প্রচারণায় দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বসলেন।
ধর্মীয় পরিচয়ভিত্তিক সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রথম নয়। এর আগে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান, আদিবাসী আমেরিকান এবং অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘু এই ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়েছে।
বর্ণবাদের ইভ্যালুয়েশনে ধর্ম সেখানে যুক্ত হয়েছে আমেরিকার হাত ধরেই। পূর্বে একজন লোকের শরীরের গড়ন, তার গায়ের রং, চুলের রং, তার মুখের আকৃতি—এসব দেখে তার জাতীয়তার উৎস সম্পর্কে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সে অনুযায়ী সে সমাজের কোন স্তরে কীভাবে কতটুকু মর্যাদা পাবে, তা সামাজিকভাবে নির্ধারিত হয়ে থাকে। কিন্তু আমেরিকার প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টানদের একটি বড় অংশ ঐতিহাসিকভাবে এই জাতিগত পরিচয়ের বাইরে ধর্মীয় পরিচয়কে বর্ণবাদের ভিত্তি হিসেবে ধরে এসেছে। তারা প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান নয়, এমন গোত্র বা অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি ঐতিহাসিকভাবে বর্ণবাদী আচরণ করে থাকে।
১৮৮০ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ এবং পূর্ব ইউরোপের লাখ লাখ অভিবাসী যখন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিল, তখন তারা স্পষ্টতই সেখানে বর্ণবাদী আচরণের শিকার হিসেবে নিজেদের দেখতে পেয়েছিল। এই লোকেরা ইউরোপিয়ান বংশোদ্ভূত ইহুদি ও ক্যাথলিক ছিল। আমেরিকার তৎকালীন আইন অনুযায়ী তারা সামাজিকভাবে ‘মধ্যম মানের’ নাগরিকের স্বীকৃতি পেয়েছিল। তাদের কৃষ্ণাঙ্গ, আদিবাসী আমেরিকান ও এশিয়ানদের চেয়ে উচ্চ স্তরের নাগরিক মনে করা হলেও তাদের উত্তরাঞ্চলীয় ইউরোপিয়ান প্রোটেস্ট্যান্টদের চেয়ে নিম্নস্তরের ভাবা হতো।
সে সময় যেভাবে ইহুদিবিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছিল, আজ ঠিক একইভাবে ইসলামভীতি ছড়ানো হচ্ছে। উনিশ শতকের গোড়ায় মূলধারার সংবাদমাধ্যমে ইহুদিদের ধোঁকাবাজ, বিচ্ছিন্নতাবাদী, পরজীবী, অসৎ, বলশেভিকদের চর— ইত্যাদি বলে উল্লেখ করা হতো। ১৯২০ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদির সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেল (যাদের বেশির ভাগই পূর্ব ইউরোপ থেকে যাওয়া) তখন প্রোটেস্ট্যান্ট স্বদেশবাদীরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বর্ণবাদী অপপ্রচার চালাতে শুরু করল। তারা বলতে লাগল, এই ইহুদিরা আদি ইহুদি নয়, এরা হলো তুর্কি বংশোদ্ভূত মোঙ্গল ও খাজার যারা পরে জুডাইজম গ্রহণ করেছে।
বিংশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়ায় ইহুদিদের চোখের রং, নাকের গঠন, মুখের আদল— ইত্যাদি নিয়ে নেতিবাচকভাবে মন্তব্য করা হতো। এই ধারাবাহিক প্রচারের ফলে ১৯৩৮ সাল নাগাদ আমেরিকানদের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মাল যে ইহুদিদের খারাপ কাজের কারণেই ইউরোপে তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছিল এবং সেই নির্যাতন তাদের পাওনা ছিল।
এদিকে মুসলিমদের নিয়েও দুই দশক ধরে ধারাবাহিক প্রচারের ফলে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অবস্থা যা দাঁড়ায় তা ভয়াবহ। পিউ রিসার্চের এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৫০ শতাংশ আমেরিকান মনে করে মুসলমানরা মূলধারার মার্কিন নাগরিক নন। ৪৮ শতাংশ আমেরিকান মুসলমানদের বিষয়ে উষ্ণ অনুভূতি প্রকাশ করেছেন।
দেখা যাচ্ছে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায়, বিশেষ করে নাইন–ইলেভেন হামলার পর আমেরিকায় মুসলমানদের কোণঠাসা করার চেষ্টা হয়েছে। ক্রিশ্চিয়ানিটিকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরা হলেও ইসলামকে ভয়ংকর একটি মতাদর্শ হিসেবে তুলে ধরায় যুক্তরাষ্ট্রে গোটা মুসলিম সম্প্রদায় বেকায়দায় পড়েছে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) সাম্প্রতিক এক জরিপে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক অপরাধ কমে আসার কথা জানালেও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ‘মূল চিত্র তার বিপরীত। সম্প্রতি মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে চলছে।’
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন দ্য কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামি রিলেশনসের (সিএআইআর) তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্রে পাঁচ শ’র বেশি ইসলামোফোবিক ঘটনা ঘটেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বেশিরভাগ মুসলমানই ইসলাম বিদ্বেষী অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানদের ওপর চালানো এক জরিপেও এমন তথ্য ওঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আদারিং অ্যান্ড বিলোংগিং ইনস্টিটিউটের পরিচালিত এই জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৬৭.৫ ভাগ অংশগ্রহণকারী জানান, তারা কথিত ইসলামোফোবিয়ামূলক মৌখিক ও শারীরিক হামলা এবং বৈষম্যমূলক নীতির শিকার হয়েছেন।
মোট এক হাজার ১২৩ অংশগ্রহণকারী এই জরিপে অংশ নেন। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে নারীদের ৭৬.৭ ভাগ জানান, তারা ইসলামোফোবিয়ার শিকার হয়েছেন। অপরদিকে পুরুষদের মধ্যে ৫৮.৬ ভাগ পুরুষ ইসলামোফোবিয়ার শিকার হয়েছেন। অন্য যেকোনো বয়সীদের তুলনায় ১৮-২৯ বছর বয়সীরাই বেশি ইসলামোফোবিয়ামূলক অপরাধের শিকার হন বলে জরিপে তথ্য প্রকাশ করা হয়।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১৮-২৯ বছর বয়সী তরুণরা বলেন, এই পরিস্থিতি এড়াতে তারা নিজেদের ধর্ম গোপন করেন। জরিপে অংশ নেওয়া ৯৩.৭ ভাগ জানান, ইসলামোফোবিয়া ও মুসলিমবিদ্বেষ তাদের মানসিক অবস্থা ও মনস্তত্বের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে।
এ অবস্থায় ধর্মীয়ভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণে ও তাদের বর্ণবাদের শিকার বানানোয় যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যে ক্ষতি হয়েছে, তা আমাদের নানা বিতর্ক ও আলাপে তুলে ধরতে হবে। সেটি করতে পারলেই আমেরিকান ইসলামভীতি দূর হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩২৩
আপনার মতামত জানানঃ